• Uncategorized
  • 0

ছোটগল্পে মো. আরিফুল হাসান

প্রভাষক, বাংলা বরকোটা স্কুল এন্ড কলেজ দাউদকান্দি, কুমিল্লা

মানবের অতৃপ্ত আত্মা ও ঈশ্বর-কলার সন্ধান

তখন ভোর রাত। আমরা চার বন্ধু ওরশ শেষে ফিরছি। করিমপুর দরবারের ওরশ। গিয়েছিলাম আমি, জহুর, শান্ত আর বিল্লু মিলে। দরিরামপুর থেকে আমরা এ চারজনই গিয়েছিলাম। প্রায় চার মাইল পথ। এতদূর মাড়িয়ে অন্য কেউ আসতে চায়নি। আমরাও আসতাম না। এখানে বিল্লুর খালার বাড়ি, তাই আসা। অনেক বড় ওরশ হয়। হাজার হাজার লোক জমায়েত হয়। বাউলরা গান গেয়ে নাচে। ভক্তরা আবেগে আপ্লুত হয়।
আমরা অবশ্য গিয়েছিলাম অন্য একটি উদ্দেশ্যে। বিল্লু বলেছিলো, অনেক মেয়েরা আসে। মেলা হয়। মেয়েরা ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করে। চাইলে দুয়েকজন মেয়ের সাথে আলাপ পরিচয় করিয়ে দিতে পারবে বিল্লু। আমরা উৎসাহিত হলাম। আমাদের তখন বয়সন্ধি পেরিয়ে একটু যৌবনতার দিকে বয়েস। আমরা রাজি হলাম। দীর্ঘ চারমাইল পথ পাড়ি দিলাম বিকেলের সবটাজুড়ে হেঁটে। আমরা এখন ফিরছি। ওরশ শেষ হয়েছে রাত তিনটার দিকে। আমরা চাইলে বিল্লুর খালার বাড়িতে থাকতে পারতাম, কিন্তু রাতের অভিজ্ঞতা আমাদের কারোরই সুখকর হয়নি। তাই ওরশ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আমরা হাঁটা ধরলাম। আমাদের দলে জহুর আর বিল্লুর হাতে টর্চ বাতি ছিলো। আমরা করিমপুরের মাঠটি পেরিয়ে দোলাগদা গ্রামের খালে এসে নেমেছি। শীতের খাল, তলায় ঘাসের বুকে শিশির। আমরা পা বাঁচিয়ে খালটি পার হই।
রাতে বিল্লু তার খালাতো বোনের হাত চেপে ধরে বলেছিলো, তোর কি তাহলে এই সিদ্ধান্ত? খালাতো বোন পারুল দৃঢ় কন্ঠে জানিয়েছিলো, হ্যাঁ। বিল্লু তখনই চলে আসতে চাইলো। কিন্তু শান্তকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আর আমিও আমার নিজেকে ঢেকে বিল্লু আর পারুলকে দেখার চেষ্টা করছি। তাদের মাঝে জহুরও আছে। জহুর আমাদের মাঝে একেবারেই আলাদা। আমাদের সব কাজে সায় দেয়, কিন্তু কোনো কাজেই সে ডুব দিতে পারে না। ওরশে মেয়ে দেখতে এসেও তাই সে সবসময় এ জনের কাঁধ, ও জনের কাঁধ ছুঁয়ে থাকে। আমি অনেক কষ্টে জহুরকে আলাদা করতে পেরেছি। তাও এক মিষ্টির দোকানে বসিয়ে দিয়ে। মেলায় অনেক দোকানপাট বসেছে। একটি মিষ্টির দোকানে জহুরকে বসিয়ে টাকা ভাঙ্গানোর নাম করে উঠে গিয়েছিলাম। অন্য একটি দোকানের আঁড় থেকে লক্ষ করলাম জহুর অনেক্ষণ বসে হাঁফ ছেড়ে উঠে গেলো। কিছুটা হাল্কা বোধ করলাম। সে তারপর গিয়ে মিশেছে বিল্লুর সাথে। বিল্লু প্রথমে একটু কাচু মাচু করলেও পরে সাথে সাথে রাখছে। আমি লুকিয়ে ওদের দু’জনের উপর চোখ রাখছি। ওরা পারুলকে খুঁজে বের করলো। আমি লক্ষ করলাম, ওরা একটা ঝোঁপের দিকে চলে গেলো। পারুল যেতে চায়নি। বিল্লু অনেকটা অধিকারের জোরে তাকে নিয়ে গেলো। আমিও তাদেরকে অনুসরন করলাম ছায়া হয়ে। পারুলের এক কথা। সে তার সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও নড়বে না।
বিল্লু কোনো কথা বলছে না। আমরা শেষরাতের অন্ধকার কুয়াশা কেটে কেটে পথ চলছি। কিছুটা ভয় এসে শীতকে আরও শিরশিরানি দিয়ে যায়। জ্যাকেটের ভেতর, চাদরের ভেতর আমাদের হাত পাগুলো বরফ হয়ে যাচ্ছে। একটি সরিষা খেতের পাশ দিয়ে আমরা যাচ্ছিলাম। দরিরামপুর থেকে করিমপুর পর্যন্ত তিনটি গ্রামের ফসলি মাঠ। মাঝখানে খাল দিয়ে সীমানা নিশ্চিত করা আছে এই বিশাল অখন্ড সবুজের। এখন শীতকাল। রবি শষ্যের পাশাপাশি দোলাগদার মাঠের ভাটির দিকে কিছুটা যায়গা জুড়ে ইরি চাষও করেছে কৃষকেরা। আমরা যে পথ ধরে যাচ্ছি সেটি টান অংশ। রবি শষ্যের গায়ে বিছিয়ে শিশির জমে আছে। ক্ষেতের আলে উঠা মটর মসুরির ঢগাগুলো আমাদের মোজাকে ভিজিয়ে দিচ্ছিলো। সরিষা ক্ষেতটা পেরিয়ে হঠাৎ থেমে গেলো বিল্লু। পকেট থেকে একটি সিগারেটের প্যাকেট বের করলো। আমরাও আমাদের সিগারেটের পেকেট থেকে সিগারেট জ্বালালাম। তারপর আবার পথ চলতে থাকলাম। চলতে চলতে জহুর আমার কাছ ঘেসে আসলো। আমি মূলত জহুরের টর্চের আলোতেই চলছি। বিল্লু শান্তকে নিয়ে একটু আগে আগে চলছে। কেমন যেনো মেঘগম্ভীর ভাব বিল্লুর চোখে মুখে। শান্তকে নিয়ে কেমন যেনো আলাদা আলাদা চলছে সে। আমার নিজেকে অপরাধী অপরাধী লাগছে। জহুর আমার কাধে হাত রেখে বললো, তুই কিছু চিন্তা করিস না।
বিল্লু পারুলকে অনেক করে বুঝানোর চেষ্টা করলো। শেষে হুমকি দিলো, তোরা কিভাবে প্রেম করিস আমি দেখে নিবো। আড়াল থেকে আমিও ভয় পেয়ে গেলাম। বিল্লু আমাদের বছর দুয়েকের বড়। তার খালার বাড়িতেই আমরা এসেছি। এখন বিল্লু যদি বৈরি হয় তাহলে কেমন করে হবে? কিন্তু পারুলের বিকল্পও আমি আর কাউকে পাচ্ছিলাম না। বিল্লুর চাচাতো খালাতো বোনেরা এসে কয়েকবার চোখের সামনে দিয়ে বেনী দুলিয়ে চলে গেলো। দুয়েকজন যেচে এসে কথা বলতে চাইলো, কিন্তু আমি তো পারুলের রূপেই মজেছি। অন্য কাউকে ভালো লাগবে কেনো আমার? বিল্লুও মনে মনে পারুলকেই পছন্দ করতো। কিন্তু আজ প্রথম দেখাতেই পারুল আমাকে পছন্দ করে ফেলে। আমিও পছন্দ করে ফেলি পারুলকে। দুজনের একান্তে ভাব বিনিময় হয়। এ কথা গিয়ে বিল্লুকে জানায় পারুলের এক চাচাতো বোন। তা জেনেই বিল্লুর রক্ত যেনো মাথায় উঠে যায়। বয়সে ছোট হলেও বিল্লু আমাকে সমীহ করে। লেখাপড়ায় ভালো বলে বেশ গা-ঘেসে থাকে। তাই সে আমাকে বিষয়টি বলতে পারে না। খোঁজে খোঁজে বের করে পারুলকে। ঝোঁপের আড়ালে পারুলের হাতে লেইস-ফিতা তুলে দিয়ে নিজের প্রেমের বাসনা জানায়। আমি আড়ালে দাঁড়িয়ে মনে মনে আতঙ্কে ছিলাম, পারুল আবার আমার সাথে খেলছে নাতো! না পারুল আমার  সাথে খেলেনি। সে বিল্লুকে না করে দিয়েছে। বিল্লুর হাত থেকে নিজের হাতদুটোকে টেনে নিয়ে বলেছে, আমি আবিরকেই ভালোবাসি। খুশিতে আমার ভেতর দোতরা বাজতে শুরু করে। কিন্তু বিল্লুর চোখে মুখে কি একটা যেনো আগুন জ্বলতে থাকে।
আমরা দোলাগদা মাঠের মাঝামাঝি চলে এসেছি। আর পৌনে এক মাইল হাটলেই আমরা নিজেদের গ্রামে চলে আসবো। মাঘের শেষ রাত। হুহু করে শীত বইছে। সিগারেট আমাদের শরীরকে গরম রাখতে পারছে না। তীব্র শীতের মুখে আমরা রাতের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি ভুলতে শুরু করেছি। জহর খচ করে আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে আমার হাতে দেয়। একটু যদি আগুন পোহাতে পারতাম! জহুর ককিয়ে উঠে। সাথে সাথে শান্ত পেছন ফিরে তার কথায় সায় দেয়। হ্যা, এরকম শীতে একটু আগুন পোহাতে পারলে মন্দ হতো না। গুঞ্জনটা চারজনের মাঝেই গুনগুন করে বেড়ে উঠে। বিল্লু কিছুটা শান্ত হয়ে এসেছে। তার কপালের রগগুলো হয়তো কিছুটা মিশে মিশে গেছে, যা আমরা অন্ধকারে টের পাচ্ছি না। বিল্লু হাত উঁচিয়ে সবাইকে থামায়। চাইলে আমরা সবাই মিলে আগুন পোহাতে পারি। তবে একটা কাজ করতে হবে। আমি শুনে গা ঝাড়া দিয়ে না করলাম। কিন্তু বাকি তিনজন আমার কথাকে উড়িয়ে দিয়ে কাজে লেগে গেলো। নিরুপায় হয়ে আমিও হাত লাগালাম। একটি খেতের মাঝখানে একটি নাড়ার গাদা। কোনো কৃষক হয়তো মাঠেই শুকোতে দিয়েছিলো। তারপর শীতের সিজনে বৃষ্টি নেই বলে মাঠেই গাদা করে রেখেছে আউশের মরা গাছগুলো। আমরা হাত চালিয়ে গাদা থেকে নাড়া খুলতে লাগলাম। গাদার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে শুকনো নাড়া বের করছি। দেখতে দেখতে আমরা একটি স্তুপ সমান নাড়া বের করে ফেললাম। এখন আমরা এমন ভাবে কাজ করছি যেনো রাতে আমাদের মাঝে কিছুই হয়নি।
পারুলের কাছ থেকে চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়ে রাতে বিল্লু আমার কলার চেপে ধরেছিলো। দরাম করে চোয়ালে বসিয়ে দিয়েছিলো একটি ঘুসি। আমিও ছাড়বার পাত্র নই। দরাম দরাম করে দু’চার ঘা বসিয়ে দিলাম। শান্ত আর জহুর এসে আমাদের দু’জনকে দুদিকে টেনে নিলো। নাহলে রাতের বেলায় একটা রক্তারক্তির ব্যাপার ঘটে যেতো। আমি হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে পারুলদের নলকূপে হাতমুখ ধু’লাম। আওয়াজ পেয়ে পারুল বেরিয়ে আসলো। চাঁদের আলোতে অসম্ভব সুন্দর লাগছিলো পারুলকে। ইচ্ছে হচ্ছিলো বুকের ভেতর টেনে নিয়ে একটু আগের ঘটে যাওয়া ঘটনাটা চেপে ফেলি। কিন্তু পারুল আমার শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনেই সব বুঝে গিয়েছিলো। সে প্রশ্ন করে, বিল্লু ভাই আপনার সাথে ঝগড়া করেছে বুঝি? আমি মুখ চেপে বললাম, না নাতো! বিশ্বাস করলো না পারুল। বললো, আপনি এসে বাসায় শুয়ে থাকেন। আর ওরশ শোনার দরকার নেই। আমি যাইনি। হাতমুখ ধুয়ে আবার ওরশে চলে গিয়েছিলাম। পারুল পেছন থেকে ডেকে বললো, আবার যেনো ঝগড়া না বাধিয়ে ফেলেন।
আর ঝগড়া বাঁধাইনি। ওরশ শেষ হলে পারুলের করুণ চোখ বলছিলো আমরা যেনো থেকে যাই। কিন্তু বিল্লু আর একমুহুর্তও এখানে থাকতে চায় না। সে তখনই পা বাড়ায়। বাধ্য হয়ে আমরাও তার পিছু পিছু হাঁটি। এখন এই জনশূন্য প্রান্তরে শীতের তীব্রতায় থির থির করে কাঁপছি চারজন। কাঁপা কাঁপা হাতে নাড়া খুলে খুলে মাথা সমান স্তুপ করে ফেললাম আমরা। একটু দূরে নিতে হবে। এখানে আগুন দিলে বড় গাদাটিতে আগুন লেগে যাবার সম্ভাবনা আছে। তাই, শতাংশ ত্রিশেক দূরে আমরা নাড়াগুলোকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছি। ভোর ছুঁই ছুঁই নিস্তব্ধতার মধ্যে আমাদের শন শন শব্দ কারো কানে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। একেবারে মাঠের মাঝখানে অবস্থান করছি আমরা। বিল্লুই সবচে বেশি খর বহন করলো। সে সাথে শান্ত আর জহুরও হাত লাগালো সমান তালে। আমিও বয়ে চলছি খরের দঙ্গল। যেনো আগুন জ্বালিয়ে আমরা পুড়িয়ে ফেলতে চাচ্ছি বিগত রাতের নষ্টস্মৃতি সব।
নাড়াগুলো একত্র করে বিল্লু তাতে আগুন দিলো। আমরা হাত পা সেকতে লাগলাম নাড়ার আগুনে। যে দ্বন্দ্ব কাল আমাদের মাঝে হয়েছিলো, এখন কে দেখলে বলবে সেটি? বুঝার উপায় নেই যে পারুলকে নিয়ে আমার আর বিল্লুর মধ্যে চলছে গভীর অন্তর্দ্বন্দ্ব। বিল্লু তার পকেট থেকে একটি সিগারেট বের করে নাড়ার আগুনে জ্বালিয়ে নেয়। তারপর কয়েকটা লম্বা টান দিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়। আমি হকচকিয়ে যাই। বিল্লু ম্লান হাসে। নাড়ার আগুনের উজ্জ্বলতায় তার মুখ জ্যোতির্ময় মনে হতে থাকে আমার কাছে। আমরা চারজন মিলে আগুনকে ঘিরে নাচতে থাকি। জহুর একটি গানে টান দেয়, গানটি গতরাতে শিউলি বাউল গেয়েছিলো– “ভবরঙ্গে আদম সঙ্গে, কি খেলা খেলিলেন সাঁই।” আমরা সবাই গানের তালে তালে হাত তালি দিতে দিতে আগুনকে ঘিরে নৃত্য করতে থাকি। আগুনের লেলিহান শিখাও যেনো আমাদের সাথে একাত্ম হয়ে নৃত্য করতে থাকে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।