শান্ত গ্রামটি ক্রমশ অশান্ত হয়ে উঠছে। দুলদুলি নদীর তীরে ছোট্ট সেই গ্রামটির নাম শান্তপুর।এতদিন বিশ গাঁয়ের মানুষজন বলে এসেছে,
’শান্তপুর গ্রামের নামটি যথার্থই বটে। এমন শান্ত গ্রাম সারা দেশ খুঁজে দ্বিতীয়টি পাওয়া শুধু মুশকিল নয়, অসম্ভবই।‘
প্রশস্ত, কিন্তু অগভীর এবং অত্যন্ত শান্ত নদী দুলদুলি। সে’ই শান্তপুর গ্রামটিকে তিনদিক থেকে ঘিরে রেখেছে।ঠিক যেভাবে মা নিজের আঁচল দিয়ে সন্তানকে জড়িয়ে আগলে রাখে, ঠিক সেভাবে। তার স্নেহের পরশে শান্তপুরের মানুষ সত্যি খুব সুখ-শান্তিতে বসবাস করে আসছে বহু বছর ধরে।
দুলদুলি নদীতে জল থাকে বারোমাস। তবে ঘন বরষায় জল অনেকটাই বেড়ে যায়।কিন্তু তা কখনোই কূল ছাপিয়ে গ্রামবাসীদের দুঃখ ডেকে আনেনা।বরং তখন নদীতে নানা রকম মাছের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায়, গ্রামবাসীদের অতিরিক্ত দু’পয়সা রোজগারের ব্যবস্থা হয়ে যায়। তাই শান্তপুর গ্রামের অনেকেই দুলদুলিকে আদর করে দুলদুলি- মা নামে ডাকে।
এ গ্রামের মানুষজন সত্যিই খুব শান্তিপ্রিয়। কোনো ঝঞ্ঝাট-ঝামেলায় এরা কখনও জড়াতে চায় না। চাষ-আবাদ আর নদীতে মাছ ধরা এদের প্রধান উপজীবিকা। গাঁয়ের মধ্যে কয়েকজনের ছোটখাটো দোকানও রয়েছে। তবে তা থেকে সংসার চালানোর মতো আয়-রোজগার হওয়ার নয়। ঐ একটু ঠেকনা দেয়া হয় আর কী। মোটের ওপর, অল্পে-খুশি এই গ্রামের মানুষ জন এতদিন অশান্তি কী জিনিস তা আন্দাজ করতে পারেনি। তাই আচমকা সেই অশান্তি এসে পড়ায় সবাই ভীষণ বিপদ এবং ভয়ানক দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছে।
শান্তিপ্রিয় শান্তপুর হঠাৎ অশান্ত হয়ে উঠেছে গ্রামে সামান্য একটি ঠাকুর মন্দির গড়ে তোলাকে কেন্দ্র করে।এতো দিন গ্রামের মধ্যে কোন দেব-দেবীর মন্দির ছিল না। মাস কয়েক আগে গ্রামের সকলে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছে গ্রামের মধ্যে একটি মন্দির গড়ে তোলা হবে। সকলেরই ভাবনা, গ্রামে একটা বারোয়ারি মন্দির থাকা দরকার।মন্দির এবং বিগ্রহ তৈরির জন্য যে খরচ হবে তা চাঁদা তুলে জোগাড় করা হবে। যার যেমন সামর্থ, সে তেমনই দেবে। আর চাঁদা যেমন উঠবে তেমনই কাজ হবে। মোট কথা, একটা ঠাকুর মন্দির এবার হচ্ছেই। ষোলোয়ানা কমিটির মাতব্বরেরা বসে এগারো জনের একটি কমিটিও গঠন করে দিয়েছে।কমিটির প্রধান করা হয়েছে গ্রামের একমাত্র এম এ পাশ, প্রাইমারি ইস্কুল মাষ্টার গগন মাঝিকে।
তার অক্লান্ত পরিশ্রম এবং প্রচেষ্টায় গ্রামের প্রাইমারি ইস্কুল মাঠ ছাড়িয়ে বটতলায় ঠাকুর মন্দিরের কাজ শেষ হয়ে গেল অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। পাকা দালান-ঘর তো নয়; টিনের ঘর। তাই সময় তেমন লাগল না।
কিন্তু এর পরই বাধল যত গন্ডগোল। মন্দিরে কোন ঠাকুরের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হবে- তা নিয়েই অশান্তি। গ্রামবাসীরা তিন-চারটি দলে বিভক্ত হয়ে গেল। শুরু হয়ে গেল নিজেদের মধ্যে তুমুল বাদানুবাদ, ঝগড়া।
একদল বলছে, ‘মন্দিরে রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ থাকবে। ‘আরেক দল বলছে, ‘কখ্খোনো না। মন্দিরে লক্ষী-নারায়ণের বিগ্রহ থাকবে। ‘আবার আরেক দল আরও গলা চড়িয়ে দাবি করছে, মা দক্ষিণাকালীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার জন্য। তারা আবার, তাদের সেই দাবির পিছনে একটি দারুণ যুক্তিও খাড়া করেছে। বলছে, ‘বটতলার মন্দিরে একমাত্র মা কালীর বিগ্রহই থাকা উচিৎ।ওখানে অন্যদেব দেবীর বিগ্রহ রাখা যুক্তি যুক্ত হবে না। বটের নিচে শিব-কালীর মন্দিরই তো শাস্ত্র-সম্মত হয় বলে আমরা এতদিন জেনে এসেছি।‘
এখন এই একটি সামান্য বিষয় নিয়ে গ্রামে ভয়ংকর গোষ্ঠী সংঘর্ষ বেধে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।ষোলোয়ানা কমিটি দফায় দফায় আলোচনা করেও কোন সমাধান সূত্র বের করতে পারছে না। গ্রামবাসীরা যে যার সিদ্ধান্তে অনড়।নিজেদের দাবি থেকে কেউ এক চুলও সরতে রাজী নয়।
এ দিকে, গ্রামের ষোলোয়ানা কমিটির মাথারা গ্রামবাসীদের মধ্যে এতো অশান্তি দেখে অত্যন্ত বিরক্ত।তারা একদিন গ্রামের সবাইকে নিয়ে শেষবারের মতো একটি বর্ধিত সভায় বসল। সেখানে তারা তাদের চরম অসন্তোষ এবং বিরক্তি প্রকাশ করল।একজন মাতব্বর তো গ্রামবাসীদের সামনে কড়া ভাষায় এমন কথা বলেই ফেলল,
‘এই গাঁয়ে, আমরা প্রত্যেকেই হিন্দু। এখানে অন্য কোনো ধর্মের মানুষ বসবাস করে না।তা সত্ত্বেও, কেবলমাত্র মন্দিরে কোন বিগ্রহ বসবে তাকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে এতো অশান্তি, এতো বিরোধ!আমি কিছুতেই ভাবতে পারছি না, তাহলে গ্রামে কয়েক ঘর মুসলিম অথবা খ্রিস্টান থাকলে, কী হোত? এতদিনে তো গ্রামে ভয়ংকর দাঙ্গা বেধে যেতো। এসব কী এক প্রকার অসুস্থ চিন্তা নয়? দিন কাল, সমাজ, সংস্কৃতি অনেক ভাবে বদলেছে। তোমাদের চিন্তা-ভাবনা বদলাবে কবে শুনি? ছি:ছি: !আমারতো এখনই এই গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবার কথা ভাবতে ইচ্ছে করছে।‘
এ সব শুনে,সভায় উপস্থিত সকলে লজ্জায় দীর্ঘক্ষণ মাথা হেঁট করে চুপ চাপ বসে থাকল।অবশেষে ষোলোয়ানায় একটি সিদ্ধান্তই গৃহীত হল। সমস্ত গ্রামবাসী সেই সিদ্ধান্ত মেনে চলার জন্য অঙ্গীকারও করল।সিদ্ধান্তটি হল, ‘মন্দিরে কোন দেবদেবীর বিগ্রহ বসবে, তা ঠিক করবে গগন মাষ্টার একা। তার একার সিদ্ধান্তই গ্রামের সবাই মেনে চলবে।এ’ নিয়ে আর কোনও বিতর্কিত মন্তব্য অথবা প্রতিবাদ করা চলবে না।‘
গগন মাষ্টার পাশের গ্রাম রাধিকাপুরে মাষ্টারী করে। স্কুলে পড়ানোর বাইরে তার প্রধান সখ ঘুরে বেড়ানো।তবে সে বেড়ানো আর পাঁচজনের মতো নয়। সে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে প্রান্তিক মানুষের খোঁজ খবর নেয়। নিজের সাধ্য মতো তাদের সাহায্য করে। আর তাদের কথা বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লিখে দেশবাসীকে জানায়।সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের পাশে দাঁড়াতে অনুরোধ করে। এই সব সামাজিক, সেবামূলক কাজ করতে গিয়ে মাষ্টার মশাইয়ের বিয়ে-থাটা পর্যন্ত করার সময় হয়নি।
রাধিকাপুর গ্রামের সনাতন পাল একজন প্রথিত যশা মৃৎশিল্পী। দশ গ্রামে তার নাম ডাক আছে।গগন মাষ্টারের সঙ্গে তার আবার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। অতএব মাষ্টারের চিন্তা এবং কাজ অনেকখানি হাল্কা হল বৈকি!
শুরু থেকেই মাষ্টারের মাথায় বিগ্রহের রূপ নিয়ে একটু ভিন্ন ধর্মী ভাবনা কাজ করেছে।কিন্তু সে মুখ ফুটে তার মনের কথা গ্রামের আর কাউকে বলেনি। সে তাদের শুধু জানিয়ে দিয়েছে, ‘বিগ্রহ সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কেউ মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবে না।এমনকি উঁকি দিয়েও বিগ্রহ দর্শন করা যাবে না। ‘গ্রামের মানুষ এবং ষোলোয়ানা কমিটির মাতব্বরেরাও মাষ্টারের এই সামান্য দাবি এককথায় মেনে নিয়েছে। আসলে, মাষ্টারের ওপর তাদের সকলের অগাধ বিশ্বাস এবং আস্থা।তাদের ধারণা, অনেক লেখাপড়া করা, সারা দেশ ঘুরে বেড়ানো মাষ্টারের বাস্তব অভিজ্ঞতা তাদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি।সে যা করবে, তাতে গ্রামের সকলের মঙ্গলই হবে।
ইস্কুল ছুটির দিন গুলোতে গগন মাষ্টার এবং তার শিল্পী-বন্ধু সনাতন পাল মন্দিরের ভিতরে বিগ্রহ গড়ার কাজে দীর্ঘক্ষণ গভীর ভাবে মগ্ন থাকল। কেউ তাদের কাজ উঁকি দিয়ে ও দেখতে এল না। সবাই ভাল করে জানে, বিগ্রহের কাজ সম্পূর্ণ হলে, মাষ্টার নিজেই তাদের ডেকে দেখাবে।
এভাবে কেটে গেল কয়েকটি মাস। একদিন মাষ্টার গ্রামের ষোলোয়ানা কমিটির কাছে বিগ্রহ সম্পূর্ণ হওয়ার খবরটি দিল।সেইসঙ্গে জানাল, ‘আগামীকাল মাঘী পূর্ণিমা, অত্যন্ত শুভদিন। তাই আগামীকাল প্রভাতেই গ্রামের সকলের জন্য মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়া হবে। সবাই যেন বিগ্রহ দর্শনের জন্য উপস্থিত হয়। ‘মুহূর্তে, ঝড়ের বেগে এই খবর পৌঁছে গেল গ্রামের প্রতিটি ঘরে।
পরদিন সূর্য ওঠার অনেক আগে গগন মাষ্টার তার শিল্পী-বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে মন্দিরের সামনে হাজির।কিন্তু সে যেটা কখনও ভাবতে পারেনি, সেটাই তার চোখের সামনে ফুটে উঠেছে।সে অবাক চোখে দেখতে লাগল, তার আসার অনেক আগে থেকে মন্দির চত্বরে উপস্থিত গ্রামের প্রায় সমস্ত মানুষ। আজকে যেন কেউ নিজের ঘরে বসে নেই। ছোট থেকে বুড়ো-বুড়ি, সমস্ত গ্রামটি আজ সাত সকালে মন্দিরের দরজায় হাজির। মাষ্টার অবশ্য এজন্য খুব খুশি।
ষোলোয়ানা কমিটির সভাপতি এগিয়ে গিয়ে মন্দিরের দরজা হাট করে খুলে দিল।সবাই বিস্ময়ের চোখে দেখতে লাগল, তাদের নতুন মন্দিরে অধিষ্ঠিত দেবতার রূপ। কিন্তু তারা তা দেখে ভীষণ অবাকই হল। এ কেমন দেবতা! এমন দেবতার স্বরূপ তো তারা আগে কখনও দেখেনি। কিন্তু এ নিয়ে কেউ একটি কথাও বলতে পারল না। পারল না মানে, তাদের মুখের সমস্ত কথা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। সবাই হঠাৎ করে কীভাবে যেন বোবা হয়ে গেল।
বিগ্রহের পা থেকে মাথা পর্যন্ত আড়াআড়ি দু’ভাগে বিভক্ত। তার বাঁ-দিকের অর্ধেকটা নারী আর ডান-দিকের অর্ধেকটা পুরুষের রূপ। দেবতার পা দুটি হলেও, হাত দুই-দুই চারটি। নারীর দুই হাতে রয়েছে যথাক্রমে একটি বই ও একটি কুলো।আর পুরুষের দুটি হাতে যথাক্রমে একটি কাস্তে এবং একটি দাঁড়িপাল্লা।বিগ্রহটি এতো সুন্দর, এতো নিখুঁত ভাবে গড়া হয়েছে যে, তার থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়া যায় না। এমন নয়নাভিরাম দেবতার রূপ গ্রামবাসীরা সত্যিই আগে কখনও দেখেনি।
ষোলোয়ানা কমিটির মাতব্বররা অতি কষ্টে বিগ্রহ থেকে চোখ সরিয়ে এক সাথে মাষ্টারের চোখে চোখ রাখল।গগন মাষ্টার তাদের সেই চাহুনির অর্থ সহজেই বুঝতে পারল। সে মৃদু হেসে, অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘আপনাদের অবাক হওয়ারই কথা।দেবতার এমন রূপ দর্শনে আপনারা তো অবাক হবেনই। কিন্তু বিশ্বাস করুন, সমস্ত দেশ ঘুরে ঘুরে আমি দেখেছি, আমাদের দেবতার প্রকৃত স্বরূপটি আসল ঠিক এমনই।‘