• Uncategorized
  • 0

গল্পে সীমা ব্যানার্জী রায়

এক ছটাক চৈতন্যবোধ

কফি কই গো”… বলে অলংকার বাবু সকালের খবরের কাগজ হাতে নিয়ে এসে রোদে পিঠ দিয়ে বসলেন ঠিক জানলার কাছে কিচেনেরই লাগোয়া কফি টেবিল এ। নভেম্বরের ভোর । সূর্য ঝকঝক করছে । আকাশ ঘন নীল, স্বচ্ছ। জানলা দিয়ে বেশ মিঠে রোদ এসে পড়েছে টেবিলটায়। অলংকার বাবু কাগজের প্রথম পাতা দেখেই মন্তব্য করলেন, “কি হয়ে দাঁড়াচ্ছে দিনকাল। এই নিয়ে গ্যাঙের দৌরাত্মিতে বছরের প্রথম দুমাসে প্রায় কুড়িটা খুন হল শহরের মধ্যে। ”
অলংকারের বাবুর স্ত্রী নিকিতা দেবী রবিবারের সকাল -দুপুর মেলানো জলখাবার তৈরি করছিলেন। মুখ না ফিরিয়ে বললেন- “নতুন আবার কি দেখলে? কাগজে তো রোজই বেরোচ্ছে গ্যাঙের দৌরাত্মিতে মানুষ মরার হিসেব। তবু ভাগ্য ভালো যে, হচ্ছে বেশির ভাগই শহরের কালো পাড়াতে। কি রকম জায়গায় এলাম বলতো? আর শোনো: তুমি পড়ছো পড়ো না। আমাকে শোনাতে কে বলেছে, বলোতো? দিলে তো সকালটা বারোটা বাজিয়ে?”
মাস ছয়েক হলো অলংকারবাবু সপরিবারে এসেছেন আমেরিকার নিউ-অরলিন্সে চাকরী নিয়ে। শুনেছেন লুইজিয়ানার এই নিউ অরলিন্স শহরে কালোরা সংখ্যা গরিষ্ঠ।
বড় মেয়ে টিউলিপ স্কুল পাশ করে এখন পাশের শহর লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। এখানে আসায় অনেক দূর হয়ে গেছে ওর। সব সময় দেখা হয়না আর। এই কারণেই নিকিতা প্রথমের দিকে এই চাকরীটা নেওয়ার কথায় ইতস্তত: করেছিলেন।
আজ ছয়মাসে মনটা একটু সয়ে এসেছে। ভাবী বিচ্ছেদের ভয়েই বোধহয় ওনারা ছোটছেলে স্বর্ণকে আরও একটু বেশি জড়িয়ে ধরেছেন। ওই বা আর কদিন? বছর দু-একের মধ্যেই তো স্কুল পাস করে কলেজে চলে যাবে। এখনই তো নিকিতার সাধের দেওয়া নাম ‘স্বর্ণ’ ওর বন্ধুদের ঝাঁকের কাছে শন হয়েও গেছে। তবু ভালো শহরতলির এই সাদা পাড়ায় ওর সঙ্গীগুলো বেশ ভালো ও ভদ্র। তাও ভয় লাগে বেশ নিকিতা দেবীর।
যা শুনি এদিক থেকে ওদিক হলেই নাকি গুলি করে দ্যায়। ভাগ্য ভালো অফিসের লোকেরাই এই জায়গায় বাড়ির খোঁজখবর দিয়েছিল। মন্ত্রণা দিয়েছিল কোথায় না কিনতে। না জেনে বাজে জায়গায় বাড়ি কিনলে এই কালো পাড়ার গ্যাঙের পাল্লায় পড়ে যে কি হতো। কে জানে। সাদারা ওনাদের মোটামুটি ভাল চোখেই দেখে। ওদের দেখে তো তাই মনে হয়।”
সত্যি এই কালোদের স্বভাবটা যে কেন এরকম বোঝা ভার। দেখতেও যা সব -কাছে এলেই ভয়ে প্রাণ উড়ে যায়। কথাগুলো মনে করেই মনে মনে লজ্জা পেলেন অলংকারবাবু। ওনারা দুজনেই উচ্চশিক্ষিত। শিক্ষার পালিশে তো জাতি বিদ্বেষের অনুভূতি মুছে যাওয়ার কথা। তাছাড়া কালোদের অপরাধই বা কি। মানুষের রূপ তো আর নিজের হাতে নয়। ভালো খারাপ তো সব জাতেই আছে। ওটাতো কারুর একচেটে নয়। জোর করে লজ্জাকর চিন্তাটা মন থেকে সরিয়ে দিলেন নিজে। দেশে থাকতে এইসব কালো-সাদা-বাদামী-হলুদ রং নিয়ে চিন্তা ছিল না। আর সত্যি এটা আমাদের ভাবা অন্যায় যে শুধু কালোরাই এসবের পিছনে। সাদা বাদামী চামড়ার লোকেরাও তো খুন খারাপি করে। করে না?”
কি জানি বাবা”- দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন নিকিতা দেবী- “মনে হয় আমাদের দেখলেই যেন গা ঘেঁষে আসতে চায় কালোগুলো। আর কথাগুলোও কেমন করে যেন বলে। আমার তো একদম ভালো লাগে না বাবা, যাই বলো।”
আমরা খালি সাদা চামড়ার লোকেদের সুন্দর ভাবি, ভালো ভাবি”- বলে হাসলেন অলংকারবাবু। কফির কাপটা এগিয়ে দিয়ে নিকিতা দেবী বললেন, “তা হয়তো ঠিক কিন্তু এই সব ভয়ংকর কালো লোকেদের দেখলেই আমার বুক ঢিপ ঢিপ করে। যাই বলো না কেন!”
কাগজ পড়া শেষ করে টেলিভিশন দেখবার জন্য মিডিয়া রুমে উঠে গেলেন অলংকারবাবু। অনেকগুলো খেলা দেখার আছে আজ।
খাওয়া সেরে শনকে সঙ্গে নিয়ে সপ্তাহের বাজার করার জন্য প্রস্তুত হলেন নিকিতা দেবী। জানেন স্বামীকে সঙ্গী করার কোন আশা নেই। সত্যি কি করে যে সারাটা দিন টিভির সামনে বসে থাকেন মাথাতেই ঢোকেনা ওনার। ফিরে এসে আবার কেনাকাটা করতে বেরোবার প্রয়োজনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে গেলেন, যাবার আগে।
বিকেলে বাড়ি ফিরে তাড়া দিতে উঠে পড়লেন তিনি। বললেন, “কোথায় যেতে হবে, শুনি?”
শনের ফরমাস শুনে বোঝা গেল বড় শপিং মলে না গেলে চলবে না। বড় হয়েছে আজকাল-নিজের পছন্দ মত জিনিস না হলে চলে না। সময়ে কুলালে হয় দোকান বন্ধ হবার আগে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে মলে পৌঁছে গাড়িটা পার্ক করলেন অলংকারবাবু। “এখনও ঘণ্টা দুই আছে। যথেষ্ট সময় কেনাকাটা করার জন্য পাবে নিকিতা দেবী।”
বিরাট শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঢাকা মলের দরজা দিয়ে হাঁটতে লাগলেন। রেডিওর সত্ত্বর কোলাহলে ওনাদের নজর পড়লো মলের বাইরে ছেলেমেয়েদের জটলাতে। নিকিতা দেবী বললেন, “দেখেছো ! ওদের? মনে হছে গ্যাঙের ছেলেরা। তুমি সকালে বলছিলে না?”
ভাল করে তাকিয়ে দেখলেন অলংকারবাবু। সাদা আর কালো ছেলেমেয়েদের দুটো দল গাড়ি পার্কিং এর মাঠের দুই প্রান্ত থেকে পরস্পরকে ব্যঙ্গ করছে। দেখে একটু অস্বস্তি বোধ করলেন। বিশেষ করে কালোদলের একটা ছেলেকে দেখে। হাতকাটা টি-সার্ট আর পুঁথি লাগানো প্যান্ট পরা। কানে, ঠোঁটে জুয়েলারি।। বলিষ্ঠ চেহারা, ঝাঁকড়া চুলের নীচে কপাল থেকে কান পর্যন্ত বীভৎস কাটা দাগ।
তাড়াতাড়ি ভেতরে চলো। এই কালোদের মনগুলো আজকাল শহর ছেড়ে শহরতলিতেও আসতে শুরু করেছে। একটু দেখে শুনে চলাফেরা করা দরকার। কোথাও গিয়ে শান্তি নেই আজকাল, বা-বাঃ। পুলিশগুলোই বা কোথায়?-এদের এখানে এরকম গজল্লা করতে দেয়ই বা কেন? সবাই বলে এখানকার পুলিশি ব্যবস্থা নাকি খুব ভালো। ধ্যুস! এই ভালোর নিদর্শন?” নিজের মনেই গজগজ করতে লাগলেন নিকিতা দেবী।
মলের ভেতরে উজ্জ্বল আলোর নীচে এসে স্বস্তি বোধ করলেন সবাই। স্ত্রী ও ছেলের উপর পছন্দ মত কেনাকাটার ভার ছেড়ে দিয়ে নিজে ‘বার্ন্স এন্ড নোবল’ বইয়ের দোকানের দিকে এগিয়ে গেলেন । দোকান ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করার আসক্তি কোনদিনই নেই। স্ত্রীকে মজা করে বলেন মেয়েরা নাকি হা্ত দিয়ে আর গন্ধ শুঁকেই জিনিস কিনতে ভালোবাসে। আরো বলে দিয়ে গেলেন ওদের কেনা হয়ে গেলে বইয়ের দোকান থেকে ওনাকে ডেকে নিতে।
বইয়ের দোকানে নতুন বই খুলে চোখ বোলাতে বড় ভাল লাগে অলংকারবাবুর। বিশেষ করে ছেলেবেলার না পড়া কোন প্রিয় বই খুঁজে পেলে। বই ঘাঁটতে কতক্ষণ সময় গেছে খেয়াল ছিল না। চমক ভাঙলো শনের ডাকে। তাকিয়ে দেখলেন শনের পরনে একটা নতুন চামড়ার জ্যাকেট । শন হেসে বলল, “মা কিনে দিয়েছে-কেমন লাগছে, ড্যাড?”
বাহ! এক্সেলেন্ট!”
নিজের হাতের বইটার দিকে আরেকবার তাকালেন অলংকারবাবু। রনিকা ধর এর ইংলিশ নভেল। বেশ কিছু ভালো ভালো মন্তব্য রয়েছে বইটাতে। কিনবেন ভেবেও রেখে দিলেন বইটা। এখনকার বাস্তববাদী মনের কাছে এই বইটা বেশ ইন্টারেস্টিং লাগল। আরো লাগল বাঙালি বলে। আজকাল তো বই পড়ার স্বাদ লোকে মেটায় ইন্টারনেটে।
ছেলের হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে এলেন অলংকারবাবু। দোকান বন্ধ হবার আধঘণ্টা আগেই হয়ে গেছে কাজ ওনাদের। গাড়িতে পৌঁছে দরজাটা খুলতে গিয়ে হঠাৎ আবার ফিরে গিয়ে রনিকা ধর এর “বিজৌ রায়” বইটা কিনে আনার ইচ্ছেটা দুর্দমনীয় হয়ে উঠল অলংকারবাবুর।
ইচ্ছে হলেও স্ত্রী -ছেলেকে গাড়িতে রেখে আবার ভেতরে যেতে অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। বিশেষ করে কালো ছেলেদের দলটা তখনও জটলা করছে কাছের মধ্যেই। ওদের হাবভাব ও সন্দেহ জনক মনে হচ্ছিল- যদি ঝামেলা করে ওনার অনুপস্থিতিতে ?
মল বন্ধ হবার সময় আশেপাশে লোকজনও বিশেষ নেই আর। অবশ্য সাদা ছেলেমেয়ে গুলোও রয়েছে ধারে কাছে এটাই ভরসা। স্ত্রীকে বললেন, “তোমরা দরজা বন্ধ করে গাড়িতে একটু বসো। আমি চট করে বইটা কিনে আনছি।”
তাড়াতাড়ি এসো, কিন্তু।”- স্বামীর পুরোন স্মৃতির টান-অনুভব প্রবণতা ওনার মোটেই অজানা নয়।
ফিরে গিয়ে বইটা কিনতে মিনিট পনেরো লাগল। কাগজের মোড়াটা হাতে নিয়ে তাড়াতাড়ি মল থেকে বেরিয়ে এলেন। ওনার গাড়ির কাছে দাঁড়ানো পুলিশের গাড়ির লাল-নীল আলোর ছটায় চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। ছুটে গিয়ে দেখেন জানলার কাঁচ ভাঙা। ভেতরে শনকে ভয়ে জড়িয়ে ধরে অসহায়ের মত মুখ করে বসে আছেন নিকিতা। স্বামীকে দেখে অঝোরে কেঁদে ফেলে বললেন, “ কি সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছিল গো আজ। ঐ ছেলেগুলো গাড়ির জানলা ভেঙে শনের হাত ধরে টানছিল।”
ওদের সুস্থ দেখে হঠাৎ ভয়ের ধাক্কাটা কেটে যাওয়ার পর রাগে মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো অলংকারবাবুর। আশপাশ তাকিয়ে কালো ছেলেগুলোকে খোঁজবার চেষ্টা করলেন। পুলিশের সাহায্য নিয়ে এদের একটু শিক্ষা দেওয়া দরকার। কিন্তু পুলিশ আসার আগেই তারা পালিয়েছে, মনে মনে ভাবলেন তিনি। আশেপাশে জড়ো হওয়া লোকেদের মাঝে সাদা দলের ছেলেগুলোকে ঠিক চিনে নিতে পারলেন না ধন্যবাদ দেবার জন্য।
একজন পুলিশ অফিসার গাড়ির পাশে মাটিতে পড়ে থাকা একটা ছেলেকে ফার্স্ট এড দিচ্ছিলেন। কাছে যেতে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “বেঁচে গেছে আপনার ছেলে এর কল্যাণে । গাড়ির দরজা ভেঙে আপনার ছেলের চামড়ার জ্যাকেট কেড়ে নেবার চেষ্টা করছিল। বাধা দিতে একেই মেরে দিয়েছে। আশায় অভিভূত হয়ে জানতে চাইলেন অলংকার ওর আঘাতের গুরুত্ব। শুনে আশ্বস্ত হলেন যে ছোড়ার আঘাতে কেটে গেলেও প্রাণভয়ের কিছু নেই।
সত্যি এদেশের লোকেদের কাছে অনেক কিছু শেখার আছে। লোকের বিপদ দেখলে এক কথায় এগিয়ে যায় এরা সাহায্য করতে নিজের বিপদের কথা না ভেবে। ছেলেটিকে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য কাছে যেতে এ্যাম্বুলেন্সের আলোয় ওর মুখটা ভাল করে চোখে পড়ল। চমকে উঠে দেখলেন ঝাঁকড়া চুলের নীচে কপালের সেই কাটা দাগ আর মুখের সেই কালো রঙ রক্তের লালে এক হয়ে গেছে। সেখানে তো কোন পার্থক্য দেখতে পেলেন না। তিনি আর এগুতে পারলেন না। নির্বাক দাঁড়িয়ে পড়লেন।
বাড়ি ফিরে এলেন একটিও কথা না বলে। গাড়ি গ্যারেজে পার্ক করেই ভেতরে এসে সোফা সেটে গা এলিয়ে দিলেন। নিকিতা দেবিও সব রেখে এসে বসে পড়লেন স্বামীর গা ঘেঁষে। অলংকারবাবু স্ত্রীকে বল্লেনঃ “ আমরা ধিক! আজ উচিত শিক্ষা হল। আমরাও তো বাদ যাই না বর্ণ বৈষম্যের দিক থেকে। তবে আমরা কেন এরকম? বলতে পারো? জানো তো একটা গান মনে এলো … “চেতনা চৈতন্য করে দাও মা, চৈতন্যময়ী।” নাঃ, নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছি না। মানুষকে মানুষ বলে যেদিন আমরা চিনতে পারব, সেদিন আমাদের সত্যিকারের অবজ্ঞার বন্ধন ছিন্ন হবে। আমরা মোহে আবৃত হয়ে মানুষের সত্য রূপটা দেখতে পাই না, আমাদের বিশ্বাসটাকেই ধরে রাখি। পবিত্রতাকে যেন চিনতে পারি।” আমাদের উত্তরসূরীদের ও এই মন্ত্রে দীক্ষিত করতে হবে।
Any genera or species of a society has no right to endorse or enforce the jargons of prevailing beliefs of the society .
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।