আজ অনুরাধার কবিতা পাঠের দিন I শহরের নামকরা এক পত্রিকার পূজা সংখ্যা প্রকাশ হবে আজ।ওই পত্রিকা অনুরাধার একটি কবিতা সংকলনও প্রকাশ করতে চলেছেI আজ অনুরাধার হাত দিয়েই সংকলনটি প্রকাশ হবে I
আজকাল শহরের বিশিষ্ট কয়েকজন সাহিত্যিকের সাথে অনুরাধা গুপ্তের নামটাও সমানভাবে উচ্চারিত হয় I বেশ কয়েকটি নামকরা পত্রিকায় ওর লেখা গল্প কবিতা নিয়মিত প্রকাশ হয় I ফলে মাঝেমাঝেই ওকে বাইরে বেরোতে হয় ,বিভিন্ন মিটিং অনুষ্ঠানে যোগদান করতে হয় I কিন্তু ডিম্পিকে একা রেখে এভাবে বেরিয়ে যাওয়াটাকি ঠিক হচ্ছে অনুরাধার ?
অনুরাধা ও ইন্দ্রনীলের একমাত্র সন্তান ডিম্পি I ইদানিং ওর মধ্যে কিছু পরিবর্তন ওর বাবা মাকে অত্যন্ত ভাবিয়ে তুলেছে I উচ্চমাধ্যমিকের পর থেকে নতুন কলেজে ওর কিছু নতুন বন্ধু হয়েছে I যাদের সাথে সারাদিন ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে ডিম্পি I এইসব বন্ধু বান্ধবদের অনুরাধা ও ইন্দ্রনীলের একদম পছন্দ নয় I বাড়িতে যখন –তখন প্রবেশ ,ওদের নিয়ে সারাদিন আড্ডা ,যখন –তখন বেরিয়ে পড়া ,দেরি করে বাড়ি ফেরা ডিম্পির রোজকার রুটিনে পরিণত হয়েছে I মেয়েকে নানাভাবে বুঝিয়েছে ওরাI কিন্তু ডিম্পি বুঝেও বোঝেনা ,কোনো কথাই শোনে না ডিম্পি I কোনো শাসন মানেনা Iএকমাত্র সন্তান কে নিয়ে ওরা যে কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা I
মেয়ের এই বাড়াবাড়ির জন্য ইন্দ্রনীল কিছুটা অনুরাধাকেই দায়ী করেI সে বলে -‘এই লেখালেখি সাহিত্য চর্চা একদম ছেড়ে দাও Iবাড়িতে থেকে মেয়েকে সামলাও Iআমাকে বাড়ির বাইরে বেরোতে হয় রোজগারের জন্য, আড্ডা দিতে নয় I তাও যদি বুঝতাম কবিতা লিখে কিছু রোজগার করছো ,তোমার এই যখন –তখন বেরিয়ে যাওয়াটাই ডিম্পি কাজে লাগাচ্ছে ‘i
ইন্দ্রনীল কোনোদিনই অনুরাধাকে বুঝতে চায়নি I কোনোদিনই অনুরাধার ইচ্ছের কোনো মূল্য ছিল না ইন্দ্রনীলের কাছে I এত ভালো গাইতো অনুরাধা ! কিন্তু বিয়ের পর সেটাকেও ছাড়তে হয়েছে সংসারের চাপে I ইন্দ্রনীল বলে –‘নিজের অপূর্ণ স্বপ্নগুলো সন্তানের মধ্যেই খুঁজে নিতে হয় I তাতেই শান্তি ‘I
ইন্দ্রনীল কোনোদিনই চায়নি অনুরাধা বাইরে বেরিয়ে কিছু করুক Iব্যক্তি হিসাবে ওর নিজের একটা পরিচয় হোক I ইন্দ্রনীল বরাবরই চেয়েছে অনুরাধা বাড়িতেই থাকুক I অনুরাধার আসল পরিচয় থাকুক ইন্দ্রনীল গুপ্তর স্ত্রী হিসাবে Iআসলে ইন্দ্রনীল অনুরাধাকে ঠিক ভরসা করতে পারেনা, বা ভরসা করতে ভয় পায় l আজকাল অনুরাধার অল্প –সল্প নাম ডাক হয়েছে, লেখালেখির কারণে অনেকেই ওকে পছন্দ করে I অনুরাধা যদি অন্য কোনো পুরুষের প্রতি ,বা অন্য কোনো পুরুষ যদি অনুরাধার প্রতি আকৃষ্ট হয় !
ইন্দ্রনীলের এইরূপ ভাবাটা কোনো অস্বাভাবিক কিছু নয়, অনুরাধা এখনও আগেr মতোই সুন্দর যেমনটা ছিল ঠিক বাইশ বছর আগে Iইন্দ্রনীলের থেকে প্রায় ষোলো বছরের ছোট অনুরাধা সত্যিই খুব সুন্দরী l উচ্ছমাধমিক পাশ করে যেই বছর অনুরাধা বাংলায় অনার্স নিয়ে ‘কমলিনী গার্লস কলেজে ‘ভর্তিহয় ,সেই বছরই ইন্দ্রনীল এই কলেজে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হয় I প্রথম দেখায় প্রেম ,তারপর গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে ওরা বিয়ে করে I বিয়ের কুড়ি বছর পরেও ইন্দ্রনীল কেনযে অনুরাধাকে পুরোপুরি ভরসা করতে পারেনা ,সে সম্বন্ধে অনুরাধাও কিছুটা অবগত I তবু কোনো অজুহাতেই অনুরাধা ওর ভালোলাগার জায়গা থেকে সরে আসবেনা Iকারণ গানকে সে হারিয়েছে ,তার জন্য তাকে অনেক মানসিক যন্ত্রনা পেতে হয়েছেI এখন যদি লেখাটাও এভাবে বন্ধ হয়ে যায় ,তবে ওর অস্তিত্ব বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না I
‘নাঃ, আমাকে যেতেই হবে !কিন্তু মেয়েটাযে এখনও ফিরে এলনা Iসেই সকালে বেরিয়ে এখনো ফিরলোনা, কোথায় গেল বলেও গেলনা I’ মেয়ের মোবাইলে ডায়াল করলো অনুরাধা , কয়েকবার বেজে থেমে গেল মোবাইল I’ উফফ! কি মুশকিল ! ফোনটা কেন ধরছেনা ডিম্পি ?’ হোয়াটস্ অ্যাপ-এ অনলাইন হয়েছিল সকাল১০`৫এ ,তারপর আর অনলাইন হয়নি I তবু মেসেজ করে জানিয়ে দিলো অনুরাধা —‘ডিম্পি আমি বেরিয়ে গেলাম ,তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে খেয়ে নাওI তোমার খাবার গরম করে টেবিলএ সাজিয়ে রেখেছি।’ ‘অনুরাধা আর সময় নষ্ট করলো না I সম্পাদকের পাঠানো গাড়িতে রবীন্দ্রসদন এর উদ্দেশ্যে রওনা হলI কিন্তু মনতো কিছুতেই মানছে না, এতো দেরীতো কোনোদিন করেনা ডিম্পি ! সম্পাদক মহাশয় অনুরাধার জন্য রবীন্দ্রসদনে এক নং গেটে অপেক্ষা করছিলেন —‘স্বাগতম দিদি ! চলুন তাড়াতাড়ি ভিতরে চলুন I আপনার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে, এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে ‘ Iসম্পাদকের কথায় অনুরাধা মনে হয় একটু লজ্জা পেল I ঠিকইতো ,ডিম্পির জন্য অপেক্ষা করতে করতে অনুরাধা সত্যিe অনেকটা দেরী করে ফেলেছে I
মাথা নিচু করে সভাঘরে প্রবেশ করলো অনুরাধা I সঠিক সময় পৌঁছতে না পারার জন্য প্রথমেই সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিল I সভা শুরু হল উদ্বোধনী সঙ্গীত দিয়ে —‘জগতে আনন্দলোকে আমার নিমন্ত্রণ ‘ Iতারপর অনুরাধারবইয়ের মোড়ক উন্মোচন Iতখন সভাঘর দর্শকে পরিপূর্ণ ,মঞ্চে বিশিষ্ট অতিথিদের সাথে সেও উপবিষ্ট I অনুরাধা নিজের কবিতা পাঠ শুরু করল I চারবছর আগের লেখা ‘ আমার মেয়েবেলা’ আজও সমান জনপ্রিয় I মন্ত্রমুদ্ধের মতো উপভোগ করল সারা সভা অনুরাধার স্বরচিত কবিতা পাঠ I করতালিতে মুখর হল সভা I এই কবিতাটিই প্রথম ওকে জনসমক্ষে এনেছিল I পাঠ শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে ,ফলের তোড়া ,মিষ্টি ,মেমেন্ট, আরও কিছু উপহার নিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে বেরিয়ে এল অনুরাধা I
‘এবার বাড়ি ফিরতে হবে I ঘড়িতে সাতটা বেজে পাঁচ মিনিট I ইন্দ্রনীল মনেহয় এতক্ষনে বাড়ি ফিরে খাতাপত্র নিয়ে বসে গেছে, ডিম্পিকি আজও বাড়ি ফিরে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মসগুল ? উফঃ, মেয়েটাকে নিয়ে আর পারলাম না ! ইন্দ্রনীল মনেহয় পাশের ঘর থেকে খুব বিরক্ত হচ্ছে I ওর অফিসের কাজ করার সময় কোনো রকম হই হট্টগোল একদম সহ্য করতে পারে না I’ অনুরাধা একটা ট্যাক্সি নিল I ব্যগে রাখা মোবাইলটা হঠাৎ বেজে উঠলো ,ইন্দ্রনীল ফোন করেছে ‘ঘরে কেউ নেই ! তুমি কতক্ষণে ফিরবে? ডিম্পি কোথায় ?’অনুরাধা —ডিম্পি কোথায় মানে? ডিম্পি বাড়ি ফেরেনি ? সেই সকালে বেরিয়ে এখনো ফেরেনি ?তবে কোথায় গেল মেয়েটা ?
একই প্রশ্ন ইন্দ্রনীলে রমনেও —- ‘ডিম্পি কোথায় গেল?’ ডিম্পি ইন্দ্রনীলের চোখের মণি I একটু বেশি বয়সে বিয়ে করার জন্য ওর ধারণা ছিল, হয়তো কোনোদিনই সে সন্তানের বাবা হতে পারবে না I কিন্তু ডাক্তারবাবু যেদিন ভরসা দিয়েছিলেন ওরা সন্তানের জন্মদিতে সক্ষম ,সেদিন মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিইন্দ্রনীল ,ওদের যেন একটা মেয়ে হয় ! ইন্দ্রনীলের খুব শখ একটা মেয়ে হবে ওদের I তাই হয়েছিল I ঈশ্বর ওদের মনের কথা শুনেছিলেন I ডেলিভারি রুম থেকে বেরিয়ে নার্স যখন প্রথম ওকে বলেছিলো —‘- আপনি একটি ফুটফুটে সুন্দর কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছেন’ ,সেদিন ইন্দ্রনীল বাবা হবার আনন্দে আত্মহারা হয়েছিল Iজীবনে এতখানি তৃপ্তি মনে হয় আর কিছুতে পায়নি ইন্দ্রনীল I সারা হাসপাতালে সেদিন মিষ্টি আর ফল বিবরণ করেছিল ইন্দ্রনীল I কিন্তু তার কিছুদিনের মধ্যেই অনুরাধাকে আবার হাসপাতালে যেতে হয়েছিল I সন্তানের জন্ম দেবার পর অনুরাধা সুতিকা রোগে আক্রান্ত হয়ে বহুদিন হাসপাতালে ছিল I
ফলে বাচ্চার সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়লো বাবার উপর I সদ্যজাত সন্তানকে লালন –পালন করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল ইন্দ্রানীলকে I কতরাত যে মেয়েকে কোলে নিয়ে বিছানায় জেগে কাটিয়েছে ! ,মাঝেমাঝেই অফিস কামাই করে মেয়েকে নিয়ে কখনও হাসপাতাল কখনও ডাক্তারের চেম্বারে ছুটেছে ইন্দ্রনীল I ছোটবেলায় মাঝেমাঝেই ঠান্ডা লেগে ওর জ্বর আসত I একটু এদিক ওদিক হলেই জ্বর অনেকটাই বেড়ে যেত Iইন্দ্রনীল মেয়ের ছোট্ট শরীরটা নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে বলত—‘এই দ্যাখ্ ma ,তোর জ্বর আমার গায়ে চলে এল I এবার তুই তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবি ‘I ছোট্ট ডিম্পি বাবার কথা বুঝতে পারত কিনা ইন্দ্রনীল জানেনা ,তবে তৎক্ষণাৎ ওর কান্না থেমে যেত I
এইসব সুখের স্মৃতিগুলো অনেকদিন পর ইন্দ্রনীলের মনে নতুন করে জেগে উঠেছে I সেই ছোট্ট ডিম্পির কথা ,যেই ডিম্পির জগৎটা ছিল শুধু বাবা আর বাবা I বাবা ছাড়া আর কিছুই জানত না ডিম্পি I যেখানে যাকিছু ঘটত সমস্তটাই বাবার সাথে শেয়ার করত ডিম্পি I বাবাই ছিল ওর সবচেয়ে কাছের I
কিন্তু কি এমন ঘটল যে ডিম্পি বাবার থেকে ধীরে ধীরে সরে গেল ?তার সঠিক উত্তর ইন্দ্রনীলের কাছে নেই I মাধ্যমিকের পর থেকেই ডিম্পি যেন বাবার থেকে অনেকটাই দূরে চলে গেল Iবাবার থেকে মা যেন বেশি পছন্দের হয়ে উঠলো ডিম্পির কাছে I মাধ্যমিকের পর থেকেই ডিম্পি যেন বাবার থেকে অনেকটাই দূরে চলে গেল I মায়ের সাথেই বেশি বন্ধুত্ব I তবেকি অনুৰাধাই ডিম্পিকে ইন্দ্রনীলের কাছ থেকে সরিয়ে নিল ? জানেনা ইন্দ্রনীল ,তার কোনো সঠিক প্রমাণও নেই, তবু অনুরাধার প্রতি ইন্দ্রনীলের একটা চাপা অভিমান ধীরে ধীরে জমা হতে লাগলো I
কিন্তু তাতে কি ?সত্যিই যদি অনুরাধা ডিম্পিকে ইন্দ্রনীলের কাছ থেকে সরিয়েও নেয়, কিন্তু অনুরোধও তো পারেনি ডিম্পিকে আগলে রাখতে ! সকল বন্দন ছিন্ন করে ডিম্পি এখন স্বাধীন ,এখন ওর কাছে সবচেয়ে আপন ওর বন্ধুরাই I ভালো -মন্দ বিচার না করে বন্ধুদের দেখানো রাস্তাতেই ডিম্পি এখন হাঁটতে ভালোবাসে I
রাত বেড়ে চলেছে ,সাথে সাথে ইন্দ্রনীলের মনটাও অস্থির হয়ে উঠেছে ,নানা দুঃচিন্তা কুকথা ওর মনটাকে ঘিরে ধরেছে,নিজের কাছে নিজেই আজ হেরে গেছে ও Iএক অসহ্য যন্ত্রনায় শরীর ও মন অবশ হয়ে আসছে ওর I বাবা হয়ে সন্তানকে রক্ষা করতে না পারার যন্ত্রনা ——‘ না ,আমি পারিনি !কিন্তু অনু ?অনুতো পারত মেয়েকে আগলে রাখতে I কিন্তু ,সেটা সে করেনি I নিজের জগৎ নিয়ে সে এতটাই ব্যস্ত’——– পাশের ঘর থেকে অনুরাধা— ‘তুমি আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকবে ? কিছু একটা করো !’ইন্দ্রনীল বলল–‘কিছু একটা কি করব? এখন আমার পুলিশে খবর দেওয়া ছাড়া আর কিচ্ছু করার নেই ‘ তারপর একটু থেমে বলল –‘মেয়েটা যে তিল তিল করে শেষ হয়ে যাচ্ছে মা হয়ে তুমি টের পাওনি কোনোদিন ?’ প্রতিবাদে ফেটে পড়ল অনুরাধা ,বলল– ‘তুমি বাবা হয়ে কি করেছো ?তুমি পারলেনা মেয়েটাকে সামলে রাখতে ?’ ইন্দ্রনীল বলল –‘সে চেষ্টাতো করেছিলাম, তুমি তথন মাতৃত্বের অজুহাত দেখিয়ে কেড়ে নিলে আমার থেকে ‘I অনুরাধা —‘আমি কেড়ে নিয়েছি ?’ ইন্দ্রনীল —‘হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি , তোমার জন্য আজ আমার মেয়ের এই পরিণতি …. হটাৎ ওর যেন মনে হল কলিং বেলটা বাজলো I ইন্দ্রনীল ব্যস্ত হল নীচে যাবার জন্য I অনুরাধা —‘ একি, উঠলে যে ?কোথায় যাচ্ছ ?
——–‘কেন তুমি শুনতে পেলে না নীচের বেলটা বাজলো ?মনে হয় মেয়েটা আমার বাড়ি ফিরে এসেছে ‘ কথাটা বলে ইন্দ্রনীল আর দাঁড়ায় না I তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে দরজার দিকে এগিয়ে যায় II