গল্পে ঋতব্রত গুহ

জন্মদিন
১।
“ হ্যাপি বার্থ ডে ! ” আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলল শ্লোক । সময় যে কোথা দিয়ে চলে যায় কেউ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না । সবাই এগিয়ে চলেছে গন্তব্যের দিকে , একদিন সবাই হারিয়ে যাবে । আবার নূতন প্রজন্ম আসবে , তারাও হারিয়ে যাবে । এ নিয়মের ব্যতিক্রম নেই , কোন আড়াল নেই । যত পরাক্রমী মানুষই হোক না কেন কোন কিছুর বিনিময়েই এর থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব নয় । দেখতে দেখতে চল্লিশ টা বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল । এ এক অদ্ভুত অনুভূতি । শ্লোক নিজেই নিজের দিকে অবাক ভাবে তাকিয়ে রইল । তেমন কি বদলেছে মুখ টা ! একই তো আছে । শুধু মাথার চুলগুলো উধাও হয়ে গিয়েছে । চোখের নীচে ডার্ক সার্কল বাসা বেধেছে , আর কি কিছু চেঞ্জ হয়েছে ! নিজের পরিবর্তন খুব একটা আন্দাজ করা যায় না । তবে হঠাৎ দশ বছর আগের নিজের ছবি দেখলে একটু চমক লাগে বৈকি । সব পরিবর্তন চোখের সামনেই হয় । প্রতিদিনের চর্চায় সেটা ধরা পড়ে না শুধু । শ্লোকের কাছে জন্মতারিখ টা একটু স্পেশাল । তার মূল কারণ এই দিনের আর দু দিন পরেই শ্লোকের বিয়ে হয়েছিল অনন্যার সাথে । এখন অবশ্য সেই দিনটি আলাদা করে মনে রাখবার প্রাসঙ্গিকতা নেই । কারণ বছরখানেক হল ওদের মধ্যে সেপারেশন চলছে । একটু পড়েই সোশ্যাল মিডিয়ায় শুভেচ্ছার ঝড় আছড়ে পড়বে । কাল অফিসে কেক কাটাও হবে । কিন্তু ঘুম থেকে উঠে মা কে হাসিমুখে আর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবে না শ্লোক । স্নান করে নূতন জামাকাপড় পড়ে হয়ত এখনও তৈরি হবে শ্লোক কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও কাউকে প্রণাম করতে পারবে না সে । বিয়ের পর অনন্যা প্রত্যেক বছর এই দিনে নূতন সারপ্রাইজ দিত শ্লোক কে । সেই পরম্পরাও বিগত হয়েছে ।সম্পর্ক গুলো আজকাল কত সহজে ভেঙে যায় ! অনুভূতি গুলো সব আধুনিকতার ব্ল্যাকহোলে হারিয়ে গিয়েছে । শ্লোকও কি পালটে যায় নি ! এই সেপারেশনে তো তার প্রভাবটাই বেশী ছিল । মা অ্যালজাইমার্সের রুগী । তিনজন লোক রেখে দিয়েছে শ্লোক মা এর জন্য । কিন্তু প্রায় ছ মাস হয়ে গেল মাকে তো সে নিজে দেখতে যায় নি । অফিস , টার্গেট , প্রফিট এসবের গোলকধাঁধায় সে তো নিজেও হারিয়ে গিয়েছে । আয়নার দিকে তাকিয়ে আবার একটু হাসল শ্লোক । বয়সের সাথে কি শুধু শরীর বদলায় ! তার অধিক হারে মন টাও তো বদলে যায় ।
মোবাইল টা ইচ্ছে করেই সাইলেন্ট করে রেখেছে শ্লোক । জীবনের রেসে ছুটতে গিয়ে জীবন থেকে ক্রমাগত প্রিয় জিনিসগুলো হারিয়ে যাচ্ছে । কাল অফিস যেতেও মন চাইছে না শ্লোকের । কালকের দিনটা নিজের সাথে কাটাতে ইচ্ছে করছে ।একদম নিজের সাথে । এমন ইমোশনাল ব্রেকডাউন শ্লোকের আজকাল হামেশাই হয় । শ্লোক মোবাইল টা হাতে নিয়ে চেক করল । অনন্যার তো নিশ্চয় মনে আছে আজকে শ্লোকের জন্মদিন । কোন মেসেজ পাঠিয়েছে কি !
আজকে মাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে শ্লোকের । মা এর কি মনে আছে আজকে তার একমাত্র ছেলের জন্মদিন ! কিছুই তো আজকাল আর মনে করতে পারে না ।
শ্লোক ল্যাপটপ টা খুলল । সকাল নটায় একটা ফ্লাইট আছে । আজ বাড়ি গেলে মন্দ হয় না । জন্মদিন মা এর কাছে কাটানোর থেকে ভালো আর কিছু হতে পারে কি ! অফিসে এক দুদিন না গেলে এমন কি আর হবে ! শ্লোকের মনে ভীষণ একটা জেদ তৈরি হল । জীবন টা খুব বেশী সময়ের জন্য তো নয় । এই তো সপ্তাহ খানেক আগে অনিমেষ , শ্লোকের থেকে বছর খানেক ছোট হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেল । সারা জীবন ছুটেই গেল বেচারা । টাকা পয়সা নিয়ে তো আর পরপারে যাওয়া যায় না । ছোট ছোট মুহূর্ত গুলো বরং অনেক বেশী সুখ দেয় মানুষকে । টিকিটের দাম প্রায় এগারোহাজার । আজকে এই টাকাটা শ্লোক অনায়াসে অ্যাফরড করতে পারে ।সে টিকিটের দাম যতই হোক না কেন মাকে দেখবার আনন্দের তুলনায় তা অতি নগণ্য ।
২।
বাইশ বছর আগে নিজের বাড়ি ছেড়ে প্রথম অন্য শহরে পড়তে যাওয়া শ্লোকের । খুব মনে পড়ছে পূজার ছুটিতে সেই প্রথম বাড়ি ফেরার কথা । বহুদিন বাদে সেই একই রকম অনুভব হচ্ছে শ্লোকের । মাঝখানে শ্লোক বিভিন্ন সময় কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় থেকেছে । ধীরে ধীরে একটা অন্য লাইফ স্টাইলে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে । প্লেনের চাকাটা মাটি ছুঁতেই শ্লোক বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল । শেষ কোন বছর মা এর সাথে সে তার জন্মদিন কাটিয়েছিল মনে নেই শ্লোকের । মা যদি শ্লোককে চিনতে পারতেন তবে তিনি নিশ্চয় আজ খুব আনন্দ পেতেন ।
“ দাদা বাবু আপনি ! ”
শ্লোক কে দেখে বেশ অবাক হলেন প্রমীলা দি । প্রমীলা দি বহুদিন থেকেই এ বাড়িতে থাকে । বাড়ির সব কাজ কর্মের দেখভাল করে । এমন ভালো মানুষ চট করে আজকাল পাওয়া যায় না ।
“ হুম চলে এলাম ! মা কেমন আছে ! ”
“ ওই মা যেমন থাকে ! খুব পুরনো কথা বলেন । বিশেষ করে আপনার ছোটবেলার কথা ! “
শ্লোক এগিয়ে গেল মা এর ঘরের দিকে । ছোটবেলায় এই দিনটি ঘিরে বাড়িতে বিশেষ ব্যস্ততা থাকত । ছেলের জন্মদিন বলে কথা । তখন এই বাড়িতে বাবা , কাকা দের পরিবার একসাথে থাকত । তারপর সময়ের সাথে সাথে সবাই আলাদা হয়ে গেল । বাড়ির ভাগ বাটোয়ারা হল । দুই কাকা নিজেদের অংশ বেচে দিয়ে অন্য জায়গায় সেটলড । শ্লোকের বাবাই শেষপর্যন্ত এখানে থেকে গিয়েছিলেন । মাঝখানে শ্লোক ভেবেছিল মা কে ব্যাঙ্গালোরে নিয়ে যাবে আর এই বাড়িটা বেচে দেবে । মা অবশ্য রাজি হন নি । আজ সবই একটু অন্যরকম লাগছে শ্লোকের । নিজের রুটের কাছাকাছি যেতে ইচ্ছে করছে খুব ।
মা এর চেহারা আরেকটু খারাপ হয়েছে । ক্রমশ যেন শেষের দিকে এগিয়ে চলেছে মা । শ্লোক একটা চেয়ার নিয়ে মা এর বিছানার সামনে বসল । মা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্লোকের দিকে ।
শ্লোক হাসল ।
“ চিনতে পারছ মা ! ”
“ টুবাই ! স্নান করেছিস ! ”
“ মা তুমি চিনতে পারছ আমাকে ! আমি টুবাই ! ”
“ আজ তো তোর জন্মদিন বাবা । স্নান করে বাবা কে প্রণাম করে নে । আমি আবার তোর নামে পূজা দিতে যাব ! তিতলি কোথায় বল তো ! “
শ্লোক গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না । মা এর মন এখন অতীতে পড়ে রয়েছে । তবে কি অদ্ভুত সমাপতন ! না কি মা এর মনে ছিল আজ শ্লোকের জন্মদিন । শ্লোকের চোখে জল ! ডাক্তার বাবু বলছিলেন এই রোগে এমনটা হয় । শ্লোকের গলাটা ধরে এল । অস্ফুট স্বরে একবার বলল
“ মা ! ”
“ তোর বাবাকে অনেকদিন দেখি না ! হারিয়ে গেছে নাকি ! “
শ্লোক মায়ের মাথায় হাত টা রাখল ।
“ তুমি ঘুমোও মা । আমি বাবাকে খুঁজে নিয়ে আসব । চিন্তা করো না ! “
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল মা । এই বিশেষ দিনগুলোতে কাছের মানুষগুলোকে সবচেয়ে বেশী মনে পড়ে । অনন্যার সাথে একবার দেখা করতে খুব ইচ্ছে করছে শ্লোকের । পাশের পাড়াতেই তো থাকে । অবশ্য এখন গিয়ে লাভ নেই ! এখন অনন্যার স্কুলে থাকার কথা । একবার কি স্কুলে যাবে ! অন্যসময় হলে শ্লোক হয়ত এতটা ডেস্পারেট হত না । কিন্তু আজকে আর কোনকিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না । শুধু মনের কথা শুনতে ইচ্ছে করছে শ্লোকের ।
“ ভালো আছ ! ”
কাল রাত থেকে শ্লোকের মনের মধ্যে যেন একটা প্রবল অস্থিরতা চলছে । মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না । স্কুলের ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছে প্রায় আধঘণ্টা হল । খবর পাঠিয়েছে । কিন্তু অনন্যা পুরো ক্লাস না করিয়ে যে আসবে না শ্লোক তা বিলক্ষণ জানে ।