নির্মাল্য বললো ~ ওদের কি আপনাকে বলতে আসতে হবে !
কবে যেন বলেছিলে !
সামনের রোববার । ডিসেম্বর ১৫ ।
তারিখটা দেখলামা । বহু দূরের একটা ডাক ছিল জলঙ্গী উৎসবের । নদী বাঁচাও কমিটি । সুপ্রতিম ডেকেছিল । খুব শক্ত বিষয় । এলোমেলো বললে হবে না । কেন নদীর ক্ষয় হচ্ছে । মানুষের লোভ আমাদের কোন পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে ~ এসব আর কি !
সুপ্রতিম কিছুতেই ‘না’ শব্দটা শুনবে না । অগত্যা নিমরাজী হতে হলো ।
বললাম – যাবো । কিন্তু কি বলবো !
বাহ , নদীর কথা বলতে পারবেন না !
সব বিষয়ে কি কথা বলা যায় ! নিজের ভাবনার মধ্যে না এলে কি করে ছবি আঁকবো । সে জীবিত বা মৃত যাই হোক না কেন !
বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো । সত্যিই যদি একদিন নদীর মৃত্যু হয় ।
আমাদের মফস্সলে শহরে নদীর কাছে যেতে অনেকটা পথ সাইকেলে যেতে হতো । সিগারেটে সুখ-টান দেওয়ার নদীর ধার ছিল আদর্শ জায়গা । এছাড়াও ডিমের ডেভিল , মাংসের ঘুগনি ~ সবটাই সেই নদীর তীরবর্তী দোকানে পাওয়া যেতো ।
সুপ্রতিমকে বললাম – কই আমার যুবক বয়সের গঙ্গার এখনও তো কিছু হয়নি !
আপনি সেভাবে খোঁজ রাখেননি । নাব্যতা কমে যাচ্ছে ।
আমি বললাম – এটা খুব বাড়াবাড়ি এরকম করে একদিন ‘নদী’ শব্দটাই হারিয়ে যাবে ।
আপনাকে বোঝানো বৃথা । আসুন , অনেক কিছু জানতে পারবেন ।
কঠিন কঠিন করে বলো তোমরা ~ আমি কিছু বুঝতে পারবো না ।
হো হো করে হেসে উঠলো সুপ্রতিম ।
আপনি নদী নিয়ে না-হয় কোন পুরোনো রূপকথা বলবেন ।
হাসলাম । ‘নদী’ নিয়ে সুপ্রতিমের স্কিজোফ্রেনিয়া রয়েছে । ওর ধারণা পৃথিবী ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে । আমি ওসব বুঝি না । দিব্যি ঋতু পরিবর্তন দেখি ।
কাঠবেড়ালি , থুতুপোকা , কমলা বউ ~ ভোরের পলাশিপাড়ায় কতো দেখেছি ।
জলঙ্গীর ধারে যাওয়ার দু-দিন আগে আমার জ্বর এলো । কৃত্রিম জ্বর ।
ফোন করলাম – সুপ্রতিম – আমার শরীর খারাপ ।
সে বললো – মোটেই না ।
তখন বললাম – এছাড়াও নির্বাচনের কাজ রয়েছে ।
এখন !
বলেই সে রাগ করে মোবাইলটা সুইচ অফ করে দিলো ।
যাই হোক , আমি তো বাঁচলাম । বরাবরই আমি ভূগোলে খারাপ এবং অংকেও ।
ইস্ সেই খারাপ ছেলেটা কি কখনও পারে ‘নদী’ নিয়ে বলতে ।
নির্মাল্যের ডাকে সাড়া দিয়ে গেলাম মিশন গার্লসে ।
নির্মাল্যের বউ – মৌ-রাও এই স্কুলের প্রাক্তনী ।
শ্রেয়ানকে আর ঝুমুর শিল্পী মধুমিতাকে সম্বর্ধনা দেওয়া হলো ।
এরপর শুরু হবে গানের ওয়ার্কশপ ।
মনোজ মুরলি নায়ার এসেছেন শেখাতে । ‘নদী’র চেয়ে রবীন্দ্রনাথ নিরাপদ । তাঁর কোন ভূমিক্ষয় নেই । বললাম , মন্দ না । কারণ লোকজন হাতাতালিও দিলো ।
আমার বউও এসেছে গানের ওয়ার্কশপে । আমাকে অপেক্ষা করতে হবে অনেকক্ষণ । রাতে বিয়েবাড়িও আছে ।
কংসাবতীর ধারে গেলাম । অবশ্য তার আগে মেদিনীপুরের বিখ্যাত সাহুর হোটেলে খেলাম । পোস্তবড়া , বেগুণ-ভাজা , ডাল , ধোঁকার ডালনা ।
মিশন গার্লসে গেলাম খেয়ে দেয়ে ।
তখনও গানের কর্মশালা চলছে ।
ভেসে আসছে গানের কলি
তুই ফেলে এসেছিস কারে
মন , মনরে আমরা ।
আমার প্রিয় রবীন্দ্র সংগীত কিন্তু আজ যেন খুব অস্থির লাগছে । দাঁড়ালাম না । এলাম কংসাবতীর ধারে । এখানকার সূর্যাস্ত নাকি অসাধারণ ।
শীতের বেলা ঝুপ করে সন্ধে হয়ে গেলো । আকাশে অবশ্য তখন কৃশচাঁদ আর কানের কাছে গুনগুন করছে ঝিঁ ঝিঁ পোকা আর মশার দল ।
‘মাই চাইল্ড’ ।
চাঁদের মৃদু আলো আর কুয়াশায় মাখামাখি হয়ে একজন মেম-সাহেব দাঁড়িয়ে রয়েছেন ।
আবার বললেন – মিশন গার্লসে যাবে তুমি !
আমি বললাম – হ্যাঁ । কিন্তু আপনি কে ম্যাম !
রুথ ড্যানিয়েল ।
তিনি আবার বললেন , কংসাবতী থেকে মিশন গার্লস অনেকটা দূরে । আমি তোমাকে এগিয়ে না দিলে যেতে পারবে না ।
তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে আসতে লাগলেন । আমি কথা বাড়ানোর জন্য বললাম , কংসাবতী খুব শুকিয়ে গেছে ।
ইয়েস ডিয়ার । হিউমেন গ্রিড ।
সুপ্রতিমের কথার প্রতিধ্বনি যেন , তবে আর কিছু বললেন না ।
হাঁটতে হাঁটতে মিশন গার্লসের গ্যেটের কাছে কখন চলে এলাম ।
বললাম , ম্যাডাম থ্যাংকস । ভিতরে যাবেন না !
রুথ ড্যানিয়েল বললেন – ওরা আমায় ভুলে গেছে । খুব দুষ্টু ।
মিষ্টি করে হাসলেন তিনি ।
বললাম – এখন আপনি কোথায় যাবেন !
সেই কংসাবতী রিভার-সাইডে । অনন্ত আয়ার আসবে ।
তিনি কে ?
বই নিয়ে আসবে অনন্ত আয়ার । তার নতুন সাইকেলে তাড়াতাড়িই চলে আসবে ।
গোরুর গাড়িতে খুব দেরী হতো ।
আমি অবাক হয়ে বললাম – মেদিনীপুরে এখনও গোরুর গাড়িতে যাতায়াত হয় !
হাসলেন রুথ ড্যানিয়েল ।
বললেন – মাই চাইল্ড , আই হ্যাভ ট্যু গো নাউ । আয়ার একটা বই আনছে ।
আমি হেসে বললাম – কি বই !
রুথ ড্যানিয়েল বললেন – লাইফ অফ দ্য ফ্লোয়িং রিভার ।
পাইলো কোলহোর লেখা ।
অ্যামাজনেও পেয়ে যেতেন ।
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন রুথ ড্যানিয়েল যেন কোন দুর্বোধ্য শব্দপ্রবাহ । খুব অচেনা তাঁর ।
তারপর সামলে নিয়ে বললেন – আয়ার ইজ মাই অ্যামাজন ।
বিবেকের দংশন হলো কি আমার ! জানি না । তবে মৌ , লীনা , মধুপর্ণিদের কলহাস্য নদীর স্রোতের মতোন ধেয়ে এলো ।
আমি প্রাক্তনীদের বললাম – রুথ ড্যানিয়েল এসেছিলেন ।
আমাকে ওদের শুধু দুর্বোধ্য নয় খুব অচেনা মনে হচ্ছিল ওদের । মধুপর্ণি কোনক্রমে বললো – ম্যাম কি করে আসবেন ।
আমি বললাম , যতোটুকু কথা হলো অভিমান রয়েছে তোমাদের উপর ।
এবার মৌ বললো – সেসব অনেক বছর আগের কথা । তখন কংসাবতী নদী মিশন গার্লসের খুব কাছে ছিল । ম্যাম খুব ভালোবাসতেন তাঁর ছাত্রীদের আর নদী কংসাবতীকে ।
আমি বললাম – আর অনন্ত আয়ার !
দুস্প্রাপ্য সমস্ত বই থাকতো তাঁর কাছ থেকে । এসব দিদিমার কাছ থেকে শোনা ।
মধুপর্ণি বললো ।
মৌ বললো – কিন্তু ম্যাম তো আমেরিকা ফিরে গেছিলেন ।
গীর্জার ঘন্টা বেজে উঠল ।
আর মাত্র দশ দিন । বড়দিন ।
মধুপর্ণি বললো আরো – ম্যাম খ্রিস্টমাস মিশন গার্লসে সেলিব্রেট করতে আসতেন সেই সুদূর আমেরিকা থেকে ।
আমি একা নই , মিশন গার্লসের সমস্ত প্রাক্তনীরা শুনতে পেলো বহতা নদীর শব্দ আর কেউ একজন আসছেন সাইকেলের ঘন্টি বাজিয়ে ।
কুয়াশা আর মরা চাঁদের আলোয় মাখামাখি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন রুথ ড্যানিয়েল ।