• Uncategorized
  • 0

গল্পবাজে সুপ্রতীক চক্রবর্তী

বেনু ফেরেনি 

দিনের শুরুটা ঝলমলে ছিলো। হাকিমের বাড়ির খোঁয়ারের মুরগীটা যখন “সকাল হয়েছে” জানিয়ে উচ্চস্বরে ডেকে উঠলো তখোনো পশ্চিমের জলাটা অন্ধকার আর কুয়াশায় দৃষ্টিগোচর নয়। মুরগীর ডাকেই ঘুমটা চটকে যায় রোজ বেনুর।  কিন্তু এর পরে যে ও সবিক্রমে শয্যামায়া ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ায়,তা নয়,বরং সাদা কালো মোবাইলটায় সময় দেখে আয়েশ করে উল্টো পাশে ফেরে। টালির ফাঁক দিয়ে এক ফোঁটা আকাশ দেখা যায়, আলো ফুটলে সেই ফুঁটো দিয়ে এক ফোঁটা রোদ টুপ করে বেনুর শরীরে এসে পড়ে। তখোনি বেনুর সকাল হয়। শীত গত সপ্তাহে যাবো যাবো করলেও এ সপ্তাহে পূর্বপরিকল্পনা বিস্মৃত হয়ে পূর্ববৎ জাঁকিয়ে বসেছে। বেনু লজঝড়ে কেঠো দরজা খুলে উঠোনে এসে দাঁড়ায়। মেটেলি আঙিনায় ভেজা পায়ের ছাপ,টাটকা। বাপ উঠে পেচ্ছাপে গেছিল নির্ঘাত। বেনুর বাপের নাম নিমাই গুছাইত, এককালে সাইকেল সারানোর দোকান ছিলো সদরের বটতলায়। একখানি সস্তার শতরঞ্চি পেতে তাতে লোহালক্কড় নিয়েই কাটিয়ে দিলো ষাট বছর। এখন সে সময় গেছে, চামড়া কুচকে গেছে,দৃষ্টিশক্তি ক্ষীন হয়েছে, এখন দমকা কাশি আসে, কাশির সাথে রক্ত বেরোয়। সেদিনই বেনু সকালে উঠেই উঠোনে টাটকা রক্তের ফোঁটা দেখতে পেয়েছিলো। বাপ কাশলে বেনু সেদিকে চেয়ে থাকতে পারেনা। ভঙ্গুর শীর্ণ শরীরটা ছিঁড়ে পড়তে থাকে যেনো, বিস্ফারিত চোখে নিমাই হাঁপাতে থাকে। নিমাইয়ের এক ছেলে বেনু, স্ত্রী মারা গেছে বহু আগে। নিমাইয়ের শরীর প্রতিবন্ধকতা তৈরী করলে কাজের খোঁজে নামে বেনু। কাশিমপুর কে গঞ্জ বলাটা অতিস্বীকৃতি হয়ে যাবে,বরং গাঁ বলাই ভালো। বাইরের শহুরে আধুনিকতা ছোঁয়াচে হলেও তা কাশিমপুর কে সংক্রমিত করতে পারেনি এখোনো। গ্রামের বেশীর ভাগ ঘরেই দারিদ্রতা সুস্পষ্ট, ধান আর শশার আবাদি চললেও বেশীরভাগ কর্মঠ যুবকই নদী পেরিয়ে সদরে যায়। বেনুও যায়। সদরে রাস্তায় রাস্তায় বেলুন ফেরি করে। সকালে উঠেই বেনু স্নান সারে সামনের জলায়। মালতী তখন রোজকার মতো বাসন মাজতে আসে। মালতীর বয়স কুড়ির কাছাকাছি, যৌবন উপচে না পড়লেও চোখ মুখের শানিত উচ্ছলতা আকর্ষণ করে। মালতীর প্রতি বেনুর যে দূর্বলতা আছে,তা বলা যায় না,বরং মালতীই আগ বাড়িয়ে বেনু কে নানান কথা বলে। আজকেই যেমন বেনু আদুল গায়ে তেল মাখছিলো পুকুর ধারে, মালতী তখনই এঁটো বাসন গুলো নিয়ে ছড়িয়ে বসলো, তারপর বেনুর নগ্ন উর্ধ্বাংশের প্রতি একঝলক দেখে বললো “বেনু দা,তুমি ব্যায়াম করো নাকি গা??” বেনু স্মিত হেসে চোখে রহস্য ঘনিয়ে জবাব দেয় ” তুই শুইনে করবি কি!নিজের কাজ কর….” মালতী ঈষৎ রক্তাভ অধোবদনে নিজের কাজে মন দেয়। বেনু বড় আশ্চর্য এক ছেলে!গভীর রাতে যখন ঘুম আসতে চায় না,পাশের ঘর থেকে বাপের একটানা খ্যাকর খ্যাকর কাশি যখন শ্রবনে হানা দেয় দস্যুর মতোন,তখন বেনু ভাবতে থাকে ওর বেলুন গুলোর কথা। নীল,লাল,হলুদ,সবুজ……..ও বহুবার ভেবেছে বেলুন লোকে কেন কেনে? বিবর্ণতা ভুলতে??নাকি হাওয়ায় ভাসতে? বেনু দু মুঠো সিদ্ধ ভাত খেয়ে বেড়িয়ে পড়ে সদরে। সদর বেশী দুরে নয়।মধ্যিখানে শুধু একটা শীর্ণকায় নদী। অবশ্য বর্ষায় দুকূল প্লাবিত করে মারনাত্মক রূপ নেয়,তবুও শীত শেষের এসময়টা চরাচর বড়ই শুষ্ক ঠেকে। বর্ষায় নৌকা চললেও এখন বাঁশের সাঁকো বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাঁকোর এপাশে কাশিমপুর,মোহনপুরের মতো গ্রাম গুলো গা ঘেষাঘেষি করে থাকে,আর ওদিকে শহর, চাকচিক্য,বৈভব চির আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে সচ্ছলতার হাতছানি দেয়। বেনু সাঁকো পেরিয়ে ভুবনের দোকানে এককাপ দুধ চা খায়। ভুবন অনেকদিনের পরিচিত, বেনুর হাতে খুচরো পয়সা না থাকলে পরে নিতেও রাজি হয়। চা খেয়ে সাথে আনা বাঁশের লাঠিটায় গুনে গুনে দশ খানা বেলুন ফুলিয়ে বেঁধে  রাখে। আজও তাই করেছিলো। ভুবন চায়ের পয়সা নিয়ে বললো “আইজ বেশী দেরী কইরো না ফিরতে…..সদরে গোলমাল হচ্ছে..” বেনু লাঠিটা কাঁধে নিয়ে মাথা নেড়ে এগিয়ে যায়। শহরের চিত্ত যে আজ একটু চঞ্চল তা বেনু টের পেয়েছিলো। আজ যেনো রোজকার তুলনায় লোকজন বেশী। সবাই যেনো ছোটো ছোটো জটলা বেঁধে কিছু গুরুতর আলোচনায় ব্যাপৃত। বেনু হাঁটতে থাকে। প্রতিদিনের মতো ও যায় মহারাণী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে। ছুটির পরে একঝাঁক কচিকাঁচা গুলো বেরোয়, তাদের মধ্যে কেউ কেউ  খুদে হাত উঠিয়ে অভিভাবক কে দিকনির্দেশ করে বেনুর বেলুন গুলোর প্রতি।বেনুর চোখ ঝলমল করে ওঠে,দরদাম হয়। এরপর বাজারের দিকটায় যায় বেনু,আজও গেছিলো। আজ বড্ড ভিড়। ব্যানারে ব্যানারে ছেয়ে গেছে রাস্তা। বেনু ভুবনের চায়ের দোকানের সামনের এক জটলার কানাঘুষোয় শুনেছিলো আজ শহরে মিছিল মিটিং আছে। সব কিছু বেনুর কাছে ভীষন অস্পষ্ট ঠেকে, দূর্বোধ্য মনে হয়। রাজনীতি মানে শুধুই ভোট বেনুর কাছে, যে ভোট নাগরিকত্বকে প্রতিবিম্বিত করে, যে ভোট দিনের শেষে কোনো ইন্দ্রজাল তৈরী করে না। বেনু সমাজের কাছে কিছু চায় না। দেশ মানে ওর কাছে কাশিমপুর। বেনু শুধু সবকটা বেলুন একদিনে বিক্রী করে সাঁকো পার হয়ে ফিরে আসতে চায় কাশিমপুরের ভিটে ঘরে। আজ এই মধ্যাহ্নে, সূর্য যখন ঠিক মাথার ওপরে,  বেনু তখন বাজার থেকে স্টেশনের দিকে হাঁটছিলো। এরমধ্যে ছটা বেলুন বিক্রী হয়েছে মোটে, স্টেশনের দিকে একটি শিশু উদ্যান আছে। কিন্তু রাস্তাটা অন্যন্য দিনের মতো স্বাভাবিক লাগছিল না। সবটা ভীষন গুমরে আছে।ঠিক যেনো ঝড় আসার আগের অবস্থা!! হঠাত যেনো কিছু আছড়ে পড়বে রাজপথে,ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সমস্ত কিছু। সারিবদ্ধ ভাবে কয়েকটা গাড়ি চলে গেল, প্রত্যেকটার সামনে দলীয় পতাকা। পতপত করে নিশান গুলো যেনো অপরিমিত ঔদ্ধত্যের চাঁদোয়া টাঙিয়ে দিচ্ছে শহর ময়। ফুটপাথে,চৌরাস্তায় শক্তির উদযাপন শুরু হবে। দুটো রাজনৈতিক দলের বিজয় মিছিল একই দিনে বেরোবে। এক কোনে সরে এসে বিড়ি ধরায় বেনু। আজ ভালো লাগছেনা ওর। বিকেলের মধ্যেই ফিরবে ঘরে।
বেনু ঘরে ফেরে নি। সেই যে সকালে দু মুঠো সেদ্ধ ভাত খেয়ে বেড়িয়েছিল, তারপর সকাল পেরিয়ে দুপুর,দুপুর পেরিয়ে বিকেল ও ক্রমে রাত ঘনাচ্ছে। বেনু তবু ফেরেনি। স্টেশন মোড়ের শিশু উদ্যানে তিনটে কমলা রঙের বেলুন বিক্রী করেছিল সে। তারপর বাসস্টপের দিকে আসছিল ক্লান্ত পায়ে। বেনু জানতো না যে কয়েক মিনিট পরেই রাস্তাটায় কয়েকশো মানুষ এসে জড়ো হবে, তারপর শুরু হবে গোষ্ঠী দাঙ্গা। বেনু দেখেনি এমন বীভৎসতা, বেনু জানেনা অন্ধ মানুষের হাতে অস্ত্র পড়লে জীঘাংসা সীমারেখা অতিক্রম করতে বাধ্য।  এ এক অন্ধ আবর্ত, এখানে দোষী,নির্দোষ বলে কিছু হয় না। বেনু পালাতে চেয়েছিল, পারেনি। সরে দাঁড়াতে চেয়েছিল,পারেনি। বিপুল এক ধাক্কায় ও ছিটকে পড়েছিল রাস্তায়। বেলুন সহ লাঠিটা কোথায় পড়েছিল কে জানে!। কে কাকে কেন মেরে ফেলতে চাইছে কেউ জানেনা। এ নৃশংসতার মূলে কি রয়েছে কেউ জানেনা। উন্মত্ত শহরের বুকে নৃত্য করছিলো রাজনীতির নগ্ন কঙ্কাল। যৌনাঙ্গে প্রবল জোরে একটা লাথি মেরেছিল কেউ, বেনু ঠিক তখোনি জ্ঞান হারায়৷
রাত এগারোটা দশ। বেনুর বাপ হাকিমের ছেলেকে নিয়ে সাঁকোর দিকে আসছিল। শহরের দাঙ্গায় আজ মৃত ছয় জন,সে খবর রটে গেছে। ধূধূ প্রান্তরে বিদায়ী শীতের শেষ কুয়াশা টুকু জড়িয়ে রেখেছে। বেনুর বাপ কেশেই চলেছে। হঠাতই হাকিমের ছেলে সাঁকোর দিকে হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলো “ওটা কে দাদু???” প্রায় তিরিশ হাত দুরে সাঁকোর ওপর তিন চারটে লোক একটা শরীর বয়ে আনছে। তাদের একজনের হাতে লন্ঠনের আলো জ্বলছে। ওটা কার শরীর???বেনুর??বেনু কি তবে মারা গেছে? বেনুর বাপ কেশেই চলেছে, কাশির সাথে ফিনকি দিয়ে কিছু টা রক্ত উঠে রাতটা কে ভিজিয়ে দিল বোধহয় !
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।