• Uncategorized
  • 0

গল্পগাথায় বন্দনা পাল রায়

মনিরা বানু

সময়টা ১৯৭৩ সাল। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী তেঁতুলতলা গ্রামটি হিন্দু অধ্যুষিত , তবে গ্রামের সীমায় বেশ কয়েকঘর মুসলিম পরিবার বাস করে। সেখানেই মনিরা বানুর বাপের ঘর। দেড় বছর আগে তার সাদী হয়েছে পাশের গ্রামের আলতাফ মিয়ার সাথে।
হঠাৎ এক নির্জন দুপুরে মনিরার আম্মা চীৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। কৌতুহলী পড়শী রা ছুটে আসে কারো কিছু হল নাকি ভেবে।
জানা গেল আলতাফ নাকি মনিরাকে তালাক দিয়েছে।
সন্ধ্যে নাগাদ মনিরা গরুর গাড়ি করে বাপের ঘরে এসে ঢোকে।
গ্রামদেশ বলে কথা! পাড়ার মহিলাকুল শশব্যস্ত হয়ে ফারুক আলির বাড়িতে এসে ভিড় জমায়।
” আহারে, মনিকে ওর বর ছেড়ে দিয়েছে”…. তাদের হাহুতাশ দেখে জমিলা বিবি কিছুক্ষণের জন্য কান্না ভুলে হাঁ করে চেয়ে থাকে। তারপর বাইরের দাওয়ায় তাদের বসতে দেয়।
” তুমি কি গো মনির মা? মেয়েটার এতবড় সব্বোনাশ হল, আর তুমি অতিথি সৎকার করতে লেগেছো”?
ব্যাপার দেখে মনিরা হতভম্ব। আম্মাকে জড়িয়ে ধরে যে একটু কাঁদবে, খসমের গুষ্টি উদ্ধার করবে, তা আর হল না।
সে গুম হয়ে থাকে।
” আহারে, এই তো কচি বয়স! এর মধ্যেই সব সাধ আহ্লাদ শেষ”!
“বরটার কি অন্য মেয়েছেলের সাথে নটঘট ছিল নাকি, ও মনি”?
” হায়রে, এবার এই কচি মেয়েটার কি হবে”!
” সারাজীবন একলা থাকতে হবে আর কি করার আছে”?
সে যুগে ভারতে বসবাস কারী মুসলমানরা অনেকাংশে হিন্দুদের ধারাই অনুসরণ করত। টিভির তখন ওসব দিকে কেউ নাম শোনে নি। পুরুষরা খবরের কাগজ পড়ত, আর মেয়েদের জন্য রেডিওই বাইরের জগতের একমাত্র মাধ্যম ।
দুদিন পর ইদ্দতের জন্য মনিরা শ্বশুর বাড়ি গেল।
প্রায় দিনদশেক বাদে সে ইদ্দতকাল সেরে আবার বাপের বাড়ি ফিরল।
আবার পাড়ার মেয়ে বউরা হুমড়ি খেয়ে পরল।

“কিরে, ওবাড়ি থেকে আবার ফিরে এলি যে, মিটমাট হল না বুঝি”!
” কিজানি বাবা, মেয়েমানুষের এত তেজ ভালো না। কোথায় শ্বশুর শাশুড়ীর পায়ে ধরে পরে থাকবি, তা না তেজ দেখিয়ে ফিরে এলি”।

” এবার ঠ্যালা টের পাবি”।
কনিষ্ঠা জা-গণসমব্যবিহারে ঘোষগিন্নী , অবিবাহিতা ননদ সহ সামন্ত বাড়ির বউ, বিবাহিতা বোন সহ মধু বিশ্বাসের বউ, বিধবা নিরু পিসী… সকলে মনিরার অদৃষ্টের দোষ দিতে দিতে যে যার বাড়ির পথ ধরল।
মনিরার ভাসুর আশফাক মিয়া অত্যন্ত স্বার্থপর ও চতুর। এলাকার বড় পাটের ব্যবসায়ী বিলাল হোসেন, তার তালাকসুদা বড় মেয়ে রাজিয়ার জন্য পাত্র খুঁজছিল। লোভী আশফাক নিজের ছোড়ভাইকে এগিয়ে দিয়ে বিয়ে পাকা করে বাড়ি ফিরে ভাইকে হুকুম দিল, “বিবিকে তালাক দে৷ তোর নিকা বিলালের মেয়ে রাজিয়ার সাথে হবে”। শুনে মনিরা ” হায় আল্লা বলে মুর্ছা গেল।
জ্ঞান ফিরলে দেখল ইমাম সাহেব এসেছেন। সে কেঁদে ইমামের পায়ে পড়ল।
তিনি শান্ত স্বরে বললেন, ” উঠ বেটি। তুমি কি হেঁদুর ঘরের জেনানা, যে তালাকের কথা শুনে মুচ্ছো গেলে? তোমার রিস্তা আমি পাকা করে দেবো।
আলতাফ কি করে! জমিজমা সব বড় ভাইজানের নামে। বউ পোষার মুরোদ তার নেই।অতএব তিন তালাক ও হকমেহেরের পাঁচহাজার টাকা দিয়ে সে মনিরাকে বাপের বাড়ি ফেরত পাঠালো।

ইদ্দত সেরে ফেরার পরদিনই জমিলার জ্যাঠার ছেলে এসে হাজির। তার বড় ব্যাটার বউ মরেছে তিন বছর আগে। পোলাটা দিবানা হয়ে গেছে। ছেলেপুলেও নাই। নিকা না করালে চলছে না। মনিরা যদি রাজী থাকে…

রাজী না হবার কারণ ছিল না।

একমাস বাদে ফারুক আলির বাড়ি সাজগোজ করে ব্যান্ডপার্টির বাজনায় গমগম করে উঠল। পাড়ার মহিলারা আবার ছুটে এল।

” মনি তুই আবার বিয়েতে বসছিস”?
“হ্যাঁ রে, তোর মত বিয়েওলা মেয়েকে সত্যিই কেউ ঘরের বউ করে নিয়ে যায়”?

“তোর আগের বর ঝামেলা করবে না”?

“তোর শ্বশুর বাড়ির লোক জানে যে তুই বিয়েওয়ালা মেয়ে”?

” আগের বরটার সাথে একেবারেই ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল “?
“তোর খোঁজ খবরও নেয় নি কোনদিন”?

” যদি কোনদিন তোর বর আসে তো কি করবি”?

” আসবে না গো”– জমিলা মিষ্টির রেকাব হাতে মেয়েমহলের দিকে এগিয়ে আসে। ” আমাদের ঘরে তালাক হলে সব শেষ। তালাকসুদা বিবির মুখ দেখাও বারণ”।

” তাহকে মনি কোনদিন আর বরের ঘর করতে পারবে না”?

” তা কেন, যাতে ঘর করতে পারে তার জন্যই তো নিকা করাচ্ছি”।

জড়িপাড় সবুজ শাড়ি, গা ভরা রূপোর গয়না, লাল কাঁচের চুড়ি পরে মনিরা সেলিম মিয়ার পিছুপিছু গরুর গাড়িতে ওঠে। তার শ্বশুর তার জ্যাঠাতো মামা হন।চেনা ঘর, ভয় কম। হকমেহের এবার সাতহাজার টাকা। মুমানি, থুড়ি, শাশুড়ী সোনার বালা দেবে, নতুন খসমের মুখে শুনেছে।

স্বামী পরিত্যক্তা আশা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবে, বাপ মা যদ্দিন বেঁচে আছে, তদ্দিন সব একরকম।এরপর ভাই দাদারা যদি না দেখে, সে কোথায় যাবে?

বিধবা নিরুর এখন বেশ বয়স হয়েছে, কতরাত শরীরের জ্বালা শরীরেই জীর্ণ হয়েছে তার হিসাব রাখতেও ভুলে গেছে সে।

অথচ হালদার বাড়ীর বড়বউ মরার তিনমাসের মধ্যেই হালদারের পো আবার বে করল।

মনিরার বরাতের অপস্রিয়মাণ শোভাযাত্রার দিকে তাকিয়ে প্রতিবেশিনীরা জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে মনে মনে বলল, ” হে মা দুগগা, এই পোড়া সমাজে আর মেয়েমানুষ করে পাঠিয়ো না”।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।