• Uncategorized
  • 0

গল্পকথায় শাঁওলি দে

মা পক্ষ

(১)

‘ নব আনন্দে জাগো ,আজি নব রবি কিরণে ‘ খোলা জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসছে রবি ঠাকুরের গান। দেবীপক্ষ শুরু হয়েছে। বিছানা থেকে উঠে জানালাটা বন্ধ করে দিল রূপায়ন। এই গান তার বহুবার শোনা। একসময় ভালোলাগাও ছিল। কিন্তু এখন এসব কেন যে কোনো গানই অসহ্য লাগে ওর।
বিছানা ও টেবিল জুড়ে বইপত্র ,ফাইল ,ল্যাপটপ ,চার্জার কী নেই ! তারই মাঝে একটুকরো জায়গায় নিজের শোওয়ার ব্যবস্থা। পাশে এক চিলতে রান্নাঘর , বাথরুম।  এভাবেই জীবন চলে পেশায় ইঞ্জিনিয়ার রূপায়ন রায়চৌধুরির। অভাব নেই কিছুর ওথচ ওর মতো অভাবী আদৌ কি এই দুনিয়ায় আছে ?
বাবা যখন চলে যায় আদরের রূপায়নের বয়স তখন পাঁচ। মা’কে কতদিন জিজ্ঞেস করেছে ,’বাবা কি তারা হয়ে গেছে মা ?’
মা নিরুত্তর থেকেছে দিনের পর দিন। রূপায়ন নিজের মতো করে বুঝে নিয়েছে যে তার বাবা আকাশের তারা হয়ে যায়নি ,বরং হারিয়ে গেছে যেখন করে ওই আকাশের থেকে হারিয়ে যায় খন্ড খন্ড মেঘ ,হারিয়ে যায় রামধনু ঠিক তেমন ! ছোট্ট  রূপায়ন অপেক্ষায় থেকেছে আবার মেঘ ওঠার ,আবার রামধনু দেখার।  যদিও সেই  অপেক্ষা ওর আজ অবধি শেষ হয়নি।
 মা’এর গানের গলা ছিল অসাধারণ। রূপায়ন যখন বড় হচ্ছে একটু একটু করে , ওর মা তখন বেশ বড় গাইয়ে। রাতবিরেতে বেরিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন গানের জলসায়। ছোট্ট রূপায়ন প্রথম প্রথম বাধা দিয়েছে ,তারপর একদিন আর সবকিছুর মতো এটাও বুঝে নিয়েছে যে মা ওর ডাকে সাড়া দেবে না। একমাত্র নিজের ইচ্ছেতেই মা ফিরে আসবে ওর কাছে।
মা জলসায় চলে গেলে বালিশে মুখ গুঁজে কান্না আটকেছে ছোট্ট ছেলেটি । পাশে শুয়ে থাকা ঠাকুমা’র কান অবধি পৌঁছায়নি সে কান্নার আওয়াজ। এভাবেই একদিন রূপায়ন টের পেয়েছিল কান্না আটকাতে আটকাতে কখন যেন ও কাঁদতেই ভুলে গেছে।
এখন আর চোখে জল আসে না রূপায়নের। শুধু হঠাত হঠাত অবসরে যখন পেছনের দিকে তাকায় সে আর কিচ্ছু না চোখ দুটো অকারণ জ্বলতে থাকে ,খুব তীব্র সেই জ্বলন। রূপায়ন তার হাত থেকে বাঁচতে আজকাল নিজেকে সবসময় কাজে ব্যস্ত রাখে , প্রচুর প্রচুর সেসব কাজ আর কাজে ডুবে যেতে যেতে, যেতে যেতে রুপায়ন সব ভুলতে থাকে একটু একটু করে।

(২)

-ভেতরে আসব ?
মিষ্টি একটা গলার স্বরে চোখ তুলে তাকায় রূপায়ন। ফাইলে মুখ গুঁজে থাকতে থাকতে ও আজকাল এক যন্ত্রে পরিণত হয়েছে।আবেগ ,মায়া কিছুই আর অবশিষ্ট নেই ওর মনে। কাজের সময় এই অকারণ ডাকাডাকিতে বেশ বিরক্তই হয় ও। তবু গলাটা যথাসম্ভব নিচু রেখে  বলে ,’কাকে চাই ?’
-আপনাকেই। মেয়েটি স্মার্ট জবাবে একটু যেন হকচকিয়ে যায় রূপায়ন। গাম্ভীর্য বজায় রেখেই সে বলে , ভেতরে আসুন।
মেয়েটি হাসি মুখে কাঁচের দরজাটা ঠেলে এই বিরাট শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরটায় ঢুকে পড়ে। রূপায়নের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলে ওঠে ,থ্যাংকস ,আমি তো ভাবছিলাম বাইরে থেকেই বিদায় হতে হবে।
মেয়েটির সাবলীলতায় একটু যেন সহজ হয় রূপায়নও। হেসে বলে , তাহলে তো দেখছি আমার সম্পর্কে সব খারাপ খারাপ কথা শুনে এসেছেন।
-‘বরং ঠিক তার উল্টোটা’ বলেই মেয়েটিও হেসে ওঠে। রূপায়ন অবাক হয় , কারো কারো হাসিটা এত নির্মল হয় ,যে সম্পূর্ণ পৃথিবীটাকেই পবিত্র লাগে সেই মুহূর্তে। রূপায়নেরও ঠিক তাই মনে হয়। ডেনিম জিন্স আর সাদা টি শার্ট পড়া মেয়েটিকে হঠাতই খুব আপন লাগে ওর।
-‘বসুন ,কিন্তু আমি কিন্তু এখনো বুঝতে পারছি না …’ কথাটা শেষ করে না রূপায়ন।
-‘বোঝার কথাও নয় ,আমরা তো একে অপরকে চিনিই না, আমি অবশ্য শুনে শুনে আপনার কথা অনেকটাই জানি।’ মেয়েটি বলতে থাকে।
-‘তাই !’ রূপায়নের গলায় বিষ্ময় , ‘আমি কিন্তু এখনও বুঝতে পারছি না আপনি কে ?’
-‘আমিরাত্রি ,রাত্রি চ্যাটার্জী ,বিশ্বভারতী থেকে এ’বছরই বি.মিউজ পাস করলাম।
-‘বি. মিউজ ? ও !’ রূপায়ন এবার একটু শক্ত হল যেন।
 তরল গলায় রাত্রি বলে উঠল ,’ম্যাম আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।’
চোয়াল শক্ত হল রূপায়নের। টেবিলের ওপর খুলে রাখা ফাইলটার দিকে চোখ বোলাতে লাগল অকারণ। একটু হকচকিয়ে গেল রাত্রিও। এতটা জড়তাও হয়ত আশা করেনি সে। তবে মুহূর্ত সময় দিল সে রূপায়ন’কে। তারপর ধীরে ধীরে বলল ,’আমি সঙ্ঘমিত্রা ম্যামের ছাত্রী ,ম্যাম আসলে…’
রাত্রির কথাটা শেষ না হতেই রূপায়ন চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। গম্ভীর গলায় বলে , এই নামে আমি কাউকে চিনি না ,আর চেনার ইচ্ছেও নেই।‘
রাত্রি হাসে ,উঠে দাঁড়ায় সেও ,তারপর বলে ,’আমি জানি সেকথা। তবু একটা কথা আপনাকে আজ জানাতেই আমার এখানে আসা।‘
-‘আমি শুনবই আপনি ভেবে নিলেন কীভাবে ?’ রূপায়ন এবার বেশ রুক্ষ্ম।
-‘ভাবিনি ।তবে আমি চেষ্টার ত্রুটি রাখব না। মেয়েটির এমন সপাট জবাবে বেশ থতমত খেয়ে যায় রূপায়ন ।হঠাতই কোনো কথা খুঁজে পায় না সে। মা চলে যাওয়ার পর থেকে তেমন ভাবে কোনো মেয়ের সংস্পর্শে আসেনি সে বরং এড়িয়েই গিয়েছে বরাবর। এক ঠাকুমা ছিলেন ,তাও মারা গিয়েছেন পাঁচ বছর হল।  তাই মেয়েটির প্রগলভতায় একটু যেন নার্ভাস হয় সে। মেয়েটি বলতে থাকে , এতক্ষণে আপনি নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছেন যে আমি আমার জন্য এখানে আসিনি। আমি সঙ্ঘমিত্রা ম্যাম আমাদের ক্লাস নিতেন। বরাবর আমি ওঁর গুণমুগ্ধ।কিন্তু বাড়িতে যাইনি কোনোদিন। সেকেন্ড ইয়ারের শেষ দিকে হঠাত শুনতে পেলাম ম্যাম আর ক্লাস নেবেন না ,ভলান্টারি রিট্যারমেন্ট নিয়েছেন। স্বভাবতই ভেঙে পড়ি আমি।‘ একনাগাড়ে কথাগুলো বলে একটু শ্বাস নেয় রাত্রি।
রূপায়ন রাত্রির চোখের দিকে সরাসরি তাকায় এবার ,বলে ,’ওঁর কথা শোনার আগ্রহ আমার বিন্দুমাত্র নেই। আমি সত্যি শুনতে চাই না।’
রূপায়নের গলার স্বরটা কেমন পালটে যায় হঠাত ।কোনো পুরুষ মানুষের গলায় এত আকুলতা আগে অনুভব করেনি ও। কিছুক্ষণ কোনো কথা খুঁজে পায়না ও , তারপর ধীরে ধীরে বলে ওঠে , ম্যাম’এর থ্রোট ক্যান্সার। লাস্ট স্টেজ। আপনাকে একবার দেখতে চান।‘
চমকে ওঠে রূপায়ন। ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে ওর। একি শুনছে ও ! যে মানুষটার গলাটাই ছিল একমাত্র সম্পদ ,একমাত্র অহংকার  ,তার গলাতেই এই মারণ রোগ বাসা বাঁধল ! ভগবানের একি হাস্যকর পরিহাস ।
কোনো কথা খুঁজে পায় না রূপায়নও । রাত্রির দিকে তাকিয়ে মিথ্যে হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করে একবার, পারে না। রাত্রি কী যে একটা বলে ওঠে , রূপায়নের কান অবধি তা পৌঁছায় না ,সব কথা ছাপিয়ে ওর কানের কাছে একটা মিষ্টি ,অসম্ভব সুরেলা গলা গেয়ে ওঠে , তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী ,আমি অবাক হয়ে শুনি !
 অদ্ভুত অচেনা আমেজে বুঁদ হতে থাকে রূপায়ন ,এক হাত দূরে দাঁড়িয়েও রাত্রি কিছুই টের পায় না।

(৩)

কলকাতা থেকে বোলপুর যাওয়াটা মোটেও কঠিন কাজ নয়। অথচ এইটুকু রাস্তাই যেন শেষ হচ্ছে না রূপায়নের। মনের মধ্যে যে দোলাচল চলছে তা কাউকে বোঝানো যাবে না মাত্র দু’দিনের পরিচিত রাত্রি’কে তো নয়ই।গাড়িটা বেশ জোরেই চালাচ্ছে ও ,একটু একটু করে উঁচু উঁচু দালান ছাড়িয়ে ওরা পেরিয়ে যাচ্ছে কলকাতা । রুক্ষ্ম শহুরে ভিড়ভাট্টাকে পেছনে ফেলে সবুজ সতেজ শান্তিনিকেতন যেন হাত বাড়িয়ে ডাকছে রূপায়ন’কে। রাত্রি টুকটাক কথা বলছে কিন্তু রূপায়নের মন বারবার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে । একটু একটু করে চোখের সামনে স্পষ্ট করে ফুটে উঠছে মা’এর প্রায় আবছা হয়ে যাওয়া মুখটা।
ঠাকুমা মা’এর সব ছবি বাড়ি থেকে সরিয়ে দিয়েছিল রূপায়নের তখন  বারো বছর। জলসা থেকে মাথা ভর্তি সিঁদুর নিয়ে ফিরেছিল মা ,সঙ্গে প্রশান্ত কাকু , বাবার বন্ধু। ঠাকুমা মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন , আজও সেই দৃশ্যটা মনে পড়ে ওর। কিছুদিন পর মা এসেছিল ছোট্ট রূপায়ন’কে নিতে ,কিন্তু ততদিনে ঠাকুমা ,ঠাকুর’দার কাছে মা’এর নামে খারাপ কথা শুনে কিছুতেই মা’এর কাছে যেতে রাজি হয়নি রূপায়ন। আচ্ছা সেদিন কি মা’এর চোখে জল ছিল ? রাত্রি জানে ?
জিজ্ঞেস করতে গিয়েও কিছুই বলতে পারে না ও।বরং রাত্রির নানা গল্প শুনতে শুনতে যখন ওরা বোলপুর পৌঁছায় তখন বিকেল হয়ে এসেছে। ক্লাস শেষে দলে দলে ছেলেমেয়েরা ফিরছে ঘরে কিম্বা হোস্টেলে। মা শান্তিনিকেতনে চাকরি নিয়ে চলে আসার পর আর এখানে আসা হয়নি রূপায়নের। তবু অদ্ভুত এক টান অনুভব করে ও এই মাটিটার প্রতি। গাড়ি দাঁড় করিয়ে বাইরে আসে ও। ঘাসের ওপর খালি পায়ে খানিকটা পথ হাঁটে ও ,রাত্রি দেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। ভাবে ,ম্যাম ঠিকই বলেছিলেন ,কঠিন খোলসের আড়ালে কোমল মন লুকিয়ে রেখেছে ছেলেটা ! সদ্য পরিচিত ছেলেটার জন্য ওর মায়া হয় খুব। আলতো গলায় ডাক দেয় ও ,যাবেন এখন ম্যাম’এর বাড়িতে ?
হঠাতই যেন ছোটবেলা থেকে ফিরে আসে রূপায়ন , সামান্য লজ্জাও পায়। তারপর রাত্রির দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ে ও , হালকা স্বরে বলে , পায়ে হেঁটে যাওয়া যাবে ?
-হ্যাঁ ,হ্যাঁ ।এই তো কাছেই। মিনিট দশেক। রাত্রি তাড়াতাড়ি বলে ওঠে।

(৪)

শ্লথ পা’য়ে হেঁটে চলেছে ওরা। রাত্রির ভালো লাগছে খুব। ম্যাম বিশ্বাস করে ওকে যে কাজটা দিয়েছে সেটা সম্পূর্ণ হতে চলেছে। ম্যাম’এর শেষ একটা ইচ্ছে আজ ওর হাত ধরেই পূরণ হবে এটা ভাবতেই মনটা অসম্ভব শান্তিতে ভরে উঠছে। এইরকম আমেজের মধ্যেই রূপায়নের গলা পায় ও ,’জানেন তো আগে কতবার ভেবেছি এখানে আসব ,ঝগড়া করব আপনার ম্যাম’এর সঙ্গে ,কিন্তু পারিনি অথচ আজ ওঁর অসুখের কথা শুনে কিছুতেই থাকতে পারলাম না, এলাম তবে ঝগড়া কী আর করতে পারব ?’ রূপায়নের মুখটা কেমন বিষাদে ভরে যায়।
রূপায়ন বলতেই থাকে ,’মা’এর গলায় আকাশ ভরা সূর্য তারা গানটা শুনেছেন ?’ উত্তরের অপেক্ষা না করে ও আবারো বলে ওঠে ,’একটা ইয়া বড় টিপ আর মাথা ভর্তি চুল ,চোখ বুঝলেই এটাই দেখতে পাই জানেন, যত বেশি ঘৃণা করি ,তত বেশি করেই উনি আমার মধ্যে বেঁচে থাকেন। আজ এখানে আসতে আসতে ভাবছিলাম ভদ্রমহিলাকে একফোঁটাও ভুলতে পারিনি আমি ,ছিটেফোঁটাও নয়।‘
রাত্রি কী বলবে ভেবে পায় না ,ছেলের মুখে হারিয়ে ফেলা মা’এর কথা শুনতে শুনতে কেমন গা কাঁটা দিয়ে ওঠে ওর।
-‘আচ্ছা উনি কথা বলতে পারবেন ? ডাকতে পারবেন আমাকে রূপ বলে ?’ রূপায়নের চোখ দুটো আশায় জ্বলে ওঠে যেন , পড়ন্ত বিকেলের আলোতেও তা দেখতে পায় রাত্রি।
রাত্রি দু’দিকে ঘাড় নাড়ে ,একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে ,’নাহ! লাস্ট যেদিন এসেছিলাম ,মানে আপনার ওখানে যাওয়ার আগের দিন ,সেদিন তো কিছুই প্রায় বলতে পারেননি ,শুধু আমি চলে আসার আগে আমার হাতদুটো চেপে ধরেছিলেন জোর করে।
রূপায়ন রাত্রির দিকে তাকায় ,রাত্রিও। ও বোঝে মাত্র কয়েকটা ঘন্টায় এই আপাত কঠিন মানুষটা আমূল বদলে গেছে। কিন্তু এই বদলটাতে কি আদৌ ভালো হবে রূপায়নের ? কী পাবে ও এই আচমকা পেয়ে যাওয়া ক্ষণিকের আনন্দ থেকে ? রাত্রির ভালোলাগাটা হঠাত যেন কেমন এক বিষাদে পরিণত হয়। ও রূপায়নকে কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না সেই মুহূর্তে।
ধীরে ধীরে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামে। দুটো প্রায় অপরিচিত নর নারী একই গন্তব্যের দিকে চলতে থাকে ,  যদিওদু’জনেরউদ্দেশ্য সম্পূর্ন আলাদা।
রূপায়ন রাত্রির দিকে তাকিয়ে বলে , মা’এর কি কেমো চলছে ?
-‘হ্যাঁ ,এই নিয়ে চার নম্বর।’ রাত্রি কৈফিয়ত  দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে ওঠে ,তবে আর হয়ত !
-সব চুল উঠে গিয়েছে তবে ,তাই না ? রূপায়নের শিশুসুল্ভ এই প্রশ্নে দু’চোখ জলে ভরে যায় রাত্রির।
পাশাপাশি হাঁটতে থাকা মানুষটার হাত ধরে ফেলে রাত্রি , ভেজা গলায় বলে ,কষ্ট পাবেন না ,হয়ত আপনাকে দেখে …
কথাটা শেষ করে না ও। রূপায়ন হেসে ওঠে ,সন্ধের আবছা আলোয় রাত্রি দেখতে পায় সেই হাসিতে শুধু কান্নাই ঝরে পড়ছে।
রূপায়ন বলে , আচ্ছা কী দেখব গিয়ে বলুন তো ? সব চুল উঠে যাওয়া ,বিছানায় লেগে থাকা একটা কঙ্কাল ? যার গলা দিয়ে আওয়াজও বের হবে না একটাও ?
হাঁটতে হাঁটতে রাত্রি দাঁড়িয়ে পড়ে আচমকা। ঘুরে দাঁড়িয়ে রূপায়নের দিকে তাকিয়ে বলে , আমি ভুল করেছি। আমার কোনো অধিকার নেই আপনার চোখ থেকে মা’এর ছবি মুছে দেওয়ার। আপনি চলে যান ,এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যান আপনি ।
রাত্রির দৃঢ় স্বরে রূপায়ন অবাক হয়। পরম মমতায় রাত্রির হাতটা ধরে বলে ওঠে , এটাই ভাবছিলাম জানেন তো ! যে মা আমায় ছেড়ে গিয়েছিল সেই কত বছর আগে ,সে মা’কেই মনে রাখতে চাই। আপনার কথা শুনে চলে এলাম ঠিকই ,কিন্তু আসতে আসতে বারবার মনে হচ্ছিল গিয়ে কাকে দেখব আমি ? যাকে দেখতে এসেছি সে তো কবেই …
রাত্রি কাঁদে। অন্ধকারে দেখতে পায় না রূপায়ন ,ও বলে চলে ,কিন্তু আপনার কথা রাখা হবে না যে !
রাত্রি কাঁদো কাঁদো গলায় বলে , কথা আমি রেখেছি ,শুধু উনি জানতে পারবেন না। আপনি তো জানলেনই  সব। আর কিচ্ছু চাই না।
-মা চলে যাওয়ার পর আপনি ওঁর কানে কানে বলবেন ,আমি এসেছিলাম।আমিও আর কিছু চাই না।
রাত্রি হাসে ,মনের ভেতর থেকে একটা ভার নেমে যায় ওর। উলটো দিকে হাঁটতে থাকা রূপায়নের দিকে তাকায় ও, কেমন বাচ্চা ছেলে বলে মনে হয় ওকে। ও এক পা এক পা করে ওর ম্যামের বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
রাত বাড়ছে ,প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে পুজোর আয়োজন জোরকদমে শুরু হয়েছে। রূপায়ন হাঁটতে হাঁটতে গাড়ির কাছে পৌঁছায়। দূর থেকে ভেসে আসছে ডাকের আওয়াজ। রূপায়নের মনে হয় দেবীপক্ষ নয় আর থেকে ওর মা পক্ষ শুরু হল।  (১৮৬৮ শব্দ)
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।