গল্পকথায় দিলীপ কুমার মিস্ত্রি
by
TechTouchTalk Admin
·
Published February 24, 2020
· Updated February 24, 2020
একটি জাতি একটি ধর্ম
শ্রীরাধা আর ফতেমা দুই বান্ধবী । দু’জনের মধ্যে একেবারে গলায় গলায় ভাব । ওরা শহরের একটি নামকরা স্কুলে পড়ে । সবে ক্লাস থ্রিতে প্রমোশন পেয়েছে । ওদের এই বন্ধুত্বের বিষয়ে, বাড়ির লোকজন অবশ্য কেউ কিচ্ছু জানেনা । কারণ ওদের দু’জনের মেলামেশা যা হয় সেটা শুধু স্কুলেই । দু’জনের বাড়ি তো ঢের দূরত্বে । আসা-যাওয়াও হয় স্কুলবাসে । তাও আবার দুজনের বাস এক নয় ।
তবে শ্রীরাধা আর ফতেমার বন্ধুত্বের কথা সারা স্কুল জেনে গেছে । ওরা দুজন রোজদিন একবেঞ্চে পাশাপাশি বসে । টিফিনের সময় , একসাথে বসে টিফিন খায় । তাও আবার বাড়ি থেকে আনা টিফিন দু ’ জন নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে খায় । স্যার – ম্যাডাম ওদের একজনকে কোন কারণে শাস্তি দিলে অপরজনের চোখেও জল টল্ – টল্ করে ওঠে । ওদের এসব দেখে , স্কুলের ছেলেমেয়েরা নানারকম ব্যঙ্গ করে । কেউ কেউ নাক – চোখ কুঁচকে বলে ,“ আহা , দুই ন্যাকাপিসির কাণ্ডকারখানা দেখে অঙ্গ একেবারে জ্বলে যায় !”
কিন্তু স্কুলের স্যার-ম্যাডামরা ওদের দু’জনকে খুবই ভালোবাসে । প্রিন্সিপালস্যারতো ওদের দু’জনকে একদিন না দেখে থাকতেই পারেন না । তাই নানা অছিলায়, প্রতিদিন ওদের অন্তত একবার দু’জনের ডাক পড়বেই তাঁর ঘরে । অন্য ছাত্রছাত্রীরা প্রিন্সিপালস্যারের ডাক পেলে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে । না জানি কী বিপদে পড়তে হবে । অথচ শ্রীরাধা ফতেমা খবর পাওয়া মাত্র খুশিতে নাচতে নাচতে দে-ছুট্ । তাই স্কুলে ওদের হিংসে করার লোকেরও অভাব নেই ।
একদিন স্কুলে টিফিনবেলায় , দুই – বন্ধু দু ’ জনের দুইমধ্যে বন্ধুত্বটা তাহলে আরও আঁটোসাঁটো হবে । শীতটা একটু কমলে হবে বিয়ের অনুষ্ঠান । খুব ঘটা করে দেবে পুতুলের বিয়েটা । স্কুলের প্রিন্সিপাল , স্যার – ম্যাডাম এবং ক্লাসের সব বন্ধুদেরও নেমন্তন্ন করা হবে । হবে প্যান্ডেল । আলো , ফুল দিয়ে খুব করে সাজানো হবে বিয়ের আসর । সানাই , বাজনাও আনা হবে । একবার শুধু দুই – বন্ধু তাদের বাবা – মাকে রাজী করাতে পারলেই হল – ব্যাস , সবকিছু ঠিকঠাক , সময়মতো হয়ে যাবে ।
শ্রীরাধা পরদিনই বাড়িতে মায়ের কাছে কথাটা পাড়ল । মা সব শুনে, হ্যাঁ না কিছুই বলল না । শুধু গম্ভীরভাবে বলল, “ফেব্রুয়ারি শেষে তোমার অ্যানুয়াল এগজাম । হাতে আর মাত্র আড়াইটা মাস । এখন একটু লেখাপড়ার দিকে মন দাও । মিডটার্মে নেচার-স্টাডিজে তুমি এইট্টি পারসেন্টও পাওনি । সেটা মনে আছে তো ? ইংলিশে নাইন্টির ঘরে থাকলেও বাংলায়, কম্পিউটারে এইট্টির উপরে উঠতে পারনি । বাঙালির মেয়ে, বাংলায় কেন ফুলমার্কস পাবে না ? ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেমেয়েরা একটু চেষ্টা করলে তো এটা সবাই পাচ্ছে দেখছি ! তুমি কেন পাবেনা শুনি ?”
ফতেমাও যথারীতি বাড়িতে আম্মুর কাছে কথাটা পাড়ল । আম্মু তাকে দু ’ হাতে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরল । খুব করে আদরও করল খানিকক্ষণ । তারপর তার মুখের দিকে চেয়ে উদাস – চোখে বলল , “ পুতুলের সাদি নিয়ে এতো চিন্তা করে কি হবে শুনি ? আর ক ’ বছর পর আব্বুজান তোমারই সাদির তোড়জোড় শুরু করে দেবে । তখন যত খুশি আনন্দ করে নিও । পুতুলের সাদি নিয়ে অতো মাথাব্যথা করে লাভ নেই ফতু । বরং মন দিয়ে লেখাপড়াটা করে যাও । ভালো রেজাল্ট না করলে , আব্বুজান তোমার সাদিটাই জলদি দিয়ে দেবে । তাই সেটা আটকাতে হলে , প্রতিবছর তোমাকে ভালো নাম্বার নিয়ে পাশ করতেই হবে । এখন সেই চেষ্টাটাই কর ।“
দুই বন্ধু স্কুলে গিয়ে দু ’ জনের মায়ের কথা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করল । দু ’ জনেরই মনটা একটু খারাপ হল । কিন্তু তারা ঠিক করল , সামনের এগজামে দু ’ জনেই খুব ভালো রেজাল্ট করবেই । আর সেটা করতে পারলে , তখন তাদের আব্দার বাড়িতে ঠিক টিকে যাবে । তখন আর কেউ এই নিয়ে আপত্তি করবেনা । দুই বন্ধু জোরকদমে নেমে পড়ল ভাল রেজাল্ট করতে । শেষমেশ তারা সেটা করেও ফেলল । শ্রীরাধা এবং ফতেমা এবার ক্লাস থ্রির ফাইনাল পরীক্ষায় জয়েন্ট – ফার্স্ট ।
দু ’ জনের বাড়িতে এখন উৎসবের মেজাজ । রোজ কত লোকজন ছুটে আসছে । দু ’ জনকে কাছে টেনে কতোভাবে আদর করছে । অভিনন্দন , শুভেচ্ছা জানাচ্ছে । এসেছেন স্কুলের স্যার – ম্যাডাম , প্রিন্সিপালস্যারও । ওদের বাবা – মা , পরিবারের সকলেই তাই ভীষণ ভীষণ খুশি । শ্রীরাধা এবং ফতেমা , দু ’ জনের বাবা – মা ’ ই খুশিতে একেবারে টইটুম্বুর । তারা মুক্তকন্ঠে ঘোষণা করে দিল , মেয়েকে খুশি করতে তারাও কার্পণ্য করবে না । তারা জানিয়ে দিল , বাচ্চার যে কোনো আব্দার পূরণ করতে তারা এখন রাজী । ঠিক সেই সুযোগেই দুই – বন্ধু জানিয়ে দিল তাদের একমাত্র আব্দারটি – ‘ ধুমধাম করে তাদের পুতুলের বিয়েটা দিয়ে দিতে হবে শিগগির ।‘
সবই ঠিক ছিল । সমস্যা হয়ে দাঁড়াল দুই পরিবারের ভিন্ন ধর্ম নিয়ে । শ্রীরাধারা হিন্দু । তাই ওদের পরিবারের সদস্যরা চাইছে , পুতুলের বিয়েটা হোক হিন্দু ধর্মমতে । আবার ফতেমার বাড়ির লোকজন বলছে , সেটা কি করে হয় ! পুতুলের বিয়েটা হোক তাদের মুসলিম ধর্মমতে । দুই পক্ষই অনড় । অর্থাৎ সামান্য পুতুলের বিয়ে নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড বেঁধে যাবার উপক্রম । খবর পেয়ে , একদিন দুই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আলোচনায় বসলেন , স্কুলের প্রিন্সিপালস্যার । সঙ্গে রইল কয়েকজন স্যার – ম্যাডাম এবং দুইপাড়ার কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষ । আলোচনা সভাটা ডাকা হল স্কুলে ।
দুই পরিবারের অনেক কথা শোনা হল । শোনা হল প্রতিবেশী , বিশিষ্টজনদের কথাও । সব শুনে প্রিন্সিপালস্যার হাসতে হাসতে বললেন , ” আপনারা দুটি পরিবারই যথেষ্ট শিক্ষিত , অবস্থাপন্ন এবং সংস্কৃতি – সচেতন । সামান্য পুতুলের বিয়ে নিয়ে আপনাদের এই গোঁড়ামি তাই আমার কাছে ঠিক মনে হচ্ছে না । তাছাড়া , আপনারা প্রতিবছর লক্ষাধিক টাকা খরচ করে , মেয়েদের শহরের সেরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াচ্ছেন । তাতে কী ওদের সত্যিই কিছু লাভ হচ্ছে কী ? ভবিষ্যতে , আমাদের এই সমাজইবা ওদের কাছ থেকে কী পাবে , আপনারই বলুনতো ?”
প্রিন্সিপালস্যার একটু থামলেন । তারপর , বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন লোককে ভেতরে ডাকলেন । তাদেরকে সকলের সামনে দাঁড় করিয়েও দিলেন । তারপর , তাদের দেখিয়ে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন ।
“ শ্রীরাধা যার কাছ থেকে পুতুলটি কিনেছে , সেই লোকটি এদের একজন । সে ধর্মে মুসলমান । আর ফতেমা যার কাছ থেকে পুতুলটি কিনেছে , সেও এদের মধ্যে একজন । সে আবার ধর্মে হিন্দু । আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় , ওই পুতুলদুটি যার কারখানায় তৈরি হয়েছে , সেই লোকটিও এদের মধ্যে রয়েছে । সে আবার ধর্মে খ্রিষ্টান । তাহলে এবার আপনারা বিচার করে বলুন , ওই পুতুলদের ধর্মটা আসলে কী ?”
সবাই চুপটি করে বসে রয়েছে । কা ’ রও মুখে কোনও কথা নেই । হঠাৎ শ্রীরাধা – ফতেমা দু ’ জনে একসাথে লাফিয়ে উঠল । নাচতে নাচতে তারা দু ’ জন সমস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগল , ” পেয়েছি , পেয়েছি গো , আমরা খুঁজে পেয়েছি । আমাদের পুতুলের জাত – ধর্ম হচ্ছে পুতুল ।“
এরপরই তারা দু ’ জন আবার তাদের মায়ের কাছে গিয়ে , চুপটি করে বসে পড়ল ।
এখনও কা ’ রও মুখে টু – শব্দটি নেই । প্রিন্সিপালস্যার আবার সকলের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন , “ পৃথিবীতে মানুষ যখন প্রথম সৃষ্টি হয়েছিল তখন সে কোনও জাতধর্ম নিয়ে জন্মায়নি । এগুলো অনেক অনেক বছর পর আমারাই সৃষ্টি করেছি । অর্থাৎ , আমরা সবাই আসলে জাতিতে একটিই — মানুষজাতি । আর আমাদের সকলের ধর্ম , সংস্কৃতিও একটিই হওয়ার উচিৎ ; সেটি হলো — মনুষ্যত্ব । আমরা সবাই যদি নিজেদের এমন করে ভাবতে পারি , তাহলে পৃথিবীতে কোনদিন জাত – ধর্ম নিয়ে কোথাও কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধবে না । আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মেকে নিশ্চিতরূপে একটি ভয়ংকর বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে যেতে পারব , চিরকালের জন্য । প্লিজ , আপনারা একটু ভাবুন । এই ছোট্ট – ছোট্ট শিশুদের মুখের দিকে তাকিয়ে অন্তত –!”
প্রিন্সিপালস্যারের কথা শেষ হওয়ার আগেই শ্রীরাধা এবং ফতেমার বাবা উঠে দাঁড়াল । দু ’ জনেই হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে প্রিন্সিপালস্যারের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করল । এখন তাদের দু ’ জনের চোখের পাতায় জল থৈ থৈ করছে । অন্যদের চোখও ছল্ ছল্ । কিন্তু কেউ আর কোনও কথা বলতে পারছে না । প্রিন্সিপালস্যার , শ্রীরাধা ও ফতেমার বাবার কাঁধে তাঁর দু ’ হাত রেখে একগাল হেসে বললেন ,
“ তাহলে , এবার সমস্যাটা তো মিটেই গেল । আপনারা শীঘ্রই পুতুলের বিয়ের আয়োজনটা সেরে ফেলুন । সেদিন আমরা সবাই গিয়ে , মিলেমিশে আনন্দ উপভোগ করে আসব ! খেয়েও আসব খুব জমিয়ে ।“
শ্রীরাধা ও ফতেমার মায়ের মুখেও এখন লাফিয়ে লাফিয়ে খেলে বেড়াচ্ছে মিষ্টি মিষ্টি হাসি । তারাও তাদের দুই মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে খুব আদর করল । তারপর , হাসিমুখে সবাইকে পুতুলের বিয়ের নিমন্ত্রণ করে বাড়ি ফিরে গেল অপার আনন্দ সঙ্গে করে ।