• Uncategorized
  • 0

গল্পকথায় দিলীপ কুমার মিস্ত্রি

একটি  জাতি একটি  ধর্ম

শ্রীরাধা আর ফতেমা দুই বান্ধবী দু’জনের মধ্যে একেবারে গলায় গলায় ভাব ওরা শহরের একটি নামকরা স্কুলে পড়ে সবে ক্লাস থ্রিতে প্রমোশন পেয়েছে ওদের এই বন্ধুত্বের বিষয়ে, বাড়ির লোকজন অবশ্য কেউ কিচ্ছু জানেনা কারণ ওদের দু’জনের মেলামেশা যা হয় সেটা শুধু স্কুলেই দু’জনের বাড়ি তো ঢের দূরত্বে আসা-যাওয়াও  হয় স্কুলবাসে তাও আবার দুজনের বাস এক নয় 
 তবে শ্রীরাধা আর ফতেমার বন্ধুত্বের কথা সারা স্কুল জেনে গেছেওরা দুজন রোজদিন একবেঞ্চে পাশাপাশি বসেটিফিনের সময়,একসাথে বসে টিফিন খায়তাও আবার বাড়ি থেকে আনা টিফিন দুজন নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে খায়স‍্যারম‍্যাডাম ওদের একজনকে কোন কারণে শাস্তি দিলে অপরজনের চোখেও জল টল্টল্ করে ওঠেওদের এসব  দেখে,স্কুলের ছেলেমেয়েরা নানারকম ব‍্যঙ্গ করেকেউ কেউ নাকচোখ কুঁচকে বলে,“আহা,দুই ন‍্যাকাপিসির কাণ্ডকারখানা দেখে অঙ্গ একেবারে জ্বলে যায়!”
কিন্তু স্কুলের স‍্যার-ম‍্যাডামরা ওদের দু’জনকে খুবই ভালোবাসে প্রিন্সিপালস‍্যারতো ওদের দু’জনকে একদিন  না দেখে থাকতেই পারেন না তাই নানা অছিলায়, প্রতিদিন ওদের অন্তত একবার  দু’জনের ডাক পড়বেই তাঁর ঘরে অন্য ছাত্রছাত্রীরা প্রিন্সিপালস‍্যারের  ডাক পেলে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে  না জানি কী বিপদে পড়তে হবে  অথচ শ্রীরাধা ফতেমা খবর পাওয়া মাত্র খুশিতে নাচতে নাচতে দে-ছুট্  তাই স্কুলে ওদের হিংসে করার লোকেরও অভাব নেই 
একদিন স্কুলে টিফিনবেলায়,দুইবন্ধু দুজনের দুইমধ্যে  বন্ধুত্বটা তাহলে আরও আঁটোসাঁটো হবেশীতটা একটু কমলে হবে বিয়ের অনুষ্ঠানখুব ঘটা করে দেবে পুতুলের বিয়েটাস্কুলের প্রিন্সিপাল, স‍্যারম‍্যাডাম এবং ক্লাসের সব বন্ধুদেরও নেমন্তন্ন করা হবেহবে প‍্যান্ডেলআলো,ফুল দিয়ে খুব করে সাজানো হবে বিয়ের আসরসানাই, বাজনাও আনা হবে।  একবার শুধু দুইবন্ধু তাদের বাবামাকে রাজী করাতে পারলেই হলব‍্যাস, সবকিছু ঠিকঠাক, সময়মতো হয়ে যাবে। 
শ্রীরাধা পরদিনই বাড়িতে মায়ের কাছে কথাটা পাড়ল মা সব শুনে, হ‍্যাঁ না কিছুই বলল না শুধু  গম্ভীরভাবে বলল, “ফেব্রুয়ারি শেষে তোমার  অ্যানুয়াল এগজাম হাতে আর মাত্র আড়াইটা মাস এখন একটু লেখাপড়ার দিকে মন দাও মিডটার্মে নেচার-স্টাডিজে তুমি এইট্টি পারসেন্টও পাওনি সেটা মনে আছে তো ? ইংলিশে নাইন্টির ঘরে থাকলেও  বাংলায়, কম্পিউটারে এইট্টির উপরে উঠতে পারনি বাঙালির মেয়ে, বাংলায় কেন ফুলমার্কস পাবে না? ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেমেয়েরা একটু চেষ্টা করলে তো এটা সবাই পাচ্ছে দেখছি ! তুমি কেন পাবেনা শুনি?”
ফতেমাও যথারীতি বাড়িতে আম্মুর কাছে কথাটা পাড়লআম্মু তাকে দুহাতে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরলখুব করে আদরও করল খানিকক্ষণতারপর তার মুখের দিকে চেয়ে উদাসচোখে বলল, “পুতুলের সাদি নিয়ে এতো চিন্তা করে কি হবে শুনিআর বছর পর আব্বুজান তোমারই সাদির তোড়জোড় শুরু করে দেবেতখন যত খুশি আনন্দ করে নিওপুতুলের সাদি নিয়ে অতো মাথাব্যথা করে লাভ নেই ফতু।  বরং মন দিয়ে লেখাপড়াটা করে যাওভালো রেজাল্ট না করলে, আব্বুজান তোমার সাদিটাই জলদি দিয়ে দেবেতাই সেটা আটকাতে হলে, প্রতিবছর তোমাকে ভালো নাম্বার নিয়ে পাশ করতেই হবেএখন সেই চেষ্টাটাই কর।“
দুই বন্ধু স্কুলে গিয়ে দুজনের মায়ের কথা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করলদুজনেরই মনটা একটু খারাপ হলকিন্তু তারা ঠিক করল, সামনের এগজামে দুজনেই খুব ভালো রেজাল্ট করবেইআর সেটা করতে পারলে,তখন তাদের আব্দার বাড়িতে ঠিক টিকে যাবেতখন আর কেউ এই নিয়ে আপত্তি করবেনাদুই বন্ধু জোরকদমে নেমে পড়ল ভাল রেজাল্ট করতেশেষমেশ তারা সেটা করেও ফেললশ্রীরাধা এবং ফতেমা এবার ক্লাস থ্রির ফাইনাল পরীক্ষায় জয়েন্টফার্স্ট
দুজনের বাড়িতে এখন উৎসবের মেজাজরোজ কত লোকজন ছুটে আসছেদুজনকে কাছে টেনে কতোভাবে আদর করছেঅভিনন্দন, শুভেচ্ছা জানাচ্ছেএসেছেন স্কুলের স‍্যারম‍্যাডাম, প্রিন্সিপালস‍্যারওওদের বাবামা,পরিবারের সকলেই তাই ভীষণ ভীষণ খুশিশ্রীরাধা এবং ফতেমা, দুজনের বাবামা  খুশিতে একেবারে টইটুম্বুরতারা মুক্তকন্ঠে ঘোষণা করে দিল,মেয়েকে খুশি করতে তারাও কার্পণ‍্য করবে নাতারা জানিয়ে দিল, বাচ্চার যে কোনো আব্দার পূরণ করতে তারা এখন রাজীঠিক সেই সুযোগেই দুইবন্ধু জানিয়ে দিল তাদের একমাত্র আব্দারটি– ‘ধুমধাম করে তাদের পুতুলের বিয়েটা দিয়ে দিতে হবে শিগগির।‘
সবই ঠিক ছিলসমস্যা হয়ে দাঁড়াল দুই পরিবারের ভিন্ন ধর্ম নিয়েশ্রীরাধারা হিন্দুতাই ওদের পরিবারের সদস্যরা চাইছে, পুতুলের বিয়েটা হোক হিন্দু ধর্মমতেআবার ফতেমার বাড়ির লোকজন বলছে,সেটা কি করে হয়! পুতুলের বিয়েটা হোক তাদের  মুসলিম ধর্মমতেদুই পক্ষই অনড়অর্থাৎ সামান্য পুতুলের বিয়ে নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড বেঁধে যাবার উপক্রমখবর পেয়ে,একদিন দুই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আলোচনায় বসলেন, স্কুলের প্রিন্সিপালস‍্যারসঙ্গে রইল কয়েকজন স‍্যারম‍্যাডাম এবং দুইপাড়ার কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষআলোচনা সভাটা ডাকা হল স্কুলে
দুই পরিবারের অনেক কথা শোনা হলশোনা হল প্রতিবেশীবিশিষ্টজনদের কথাওসব শুনে প্রিন্সিপালস‍্যার হাসতে হাসতে বললেন, ”আপনারা দুটি পরিবারই যথেষ্ট শিক্ষিত, অবস্থাপন্ন এবং সংস্কৃতিসচেতনসামান্য  পুতুলের বিয়ে নিয়ে আপনাদের এই গোঁড়ামি তাই আমার কাছে ঠিক মনে হচ্ছে নাতাছাড়া, আপনারা প্রতিবছর লক্ষাধিক টাকা খরচ করে,মেয়েদের শহরের সেরা ইংরেজি মাধ‍্যম স্কুলে পড়াচ্ছেনতাতে কী ওদের সত্যিই কিছু লাভ হচ্ছে কী? ভবিষ্যতে,আমাদের এই সমাজইবা  ওদের কাছ থেকে কী পাবে, আপনারই বলুনতো?”
প্রিন্সিপালস‍্যার একটু থামলেন‌তারপর, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন লোককে ভেতরে ডাকলেনতাদেরকে সকলের সামনে দাঁড় করিয়েও দিলেনতারপর,তাদের দেখিয়ে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন।         
 “শ্রীরাধা যার কাছ থেকে পুতুলটি কিনেছে, সেই লোকটি এদের একজনসে ধর্মে মুসলমানআর ফতেমা যার কাছ থেকে  পুতুলটি কিনেছে,সেও এদের মধ্যে একজনসে আবার ধর্মে হিন্দুআর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়,ওই পুতুলদুটি যার কারখানায় তৈরি হয়েছে, সেই লোকটিও এদের মধ্যে রয়েছেসে আবার ধর্মে খ্রিষ্টানতাহলে এবার আপনারা বিচার করে বলুন,ওই পুতুলদের ধর্মটা আসলে কী?”
সবাই চুপটি করে বসে রয়েছেকারও মুখে কোনও কথা নেইহঠাৎ শ্রীরাধাফতেমা দুজনে একসাথে লাফিয়ে উঠল।  নাচতে নাচতে তারা দুজন সমস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগল, ”পেয়েছি, পেয়েছি গো, আমরা খুঁজে পেয়েছিআমাদের পুতুলের জাতধর্ম হচ্ছে পুতুল।“
এরপরই তারা দুজন আবার তাদের মায়ের কাছে গিয়ে, চুপটি করে বসে পড়ল
এখনও কারও মুখে টুশব্দটি নেইপ্রিন্সিপালস‍্যার আবার সকলের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন, “পৃথিবীতে মানুষ যখন প্রথম সৃষ্টি হয়েছিল তখন সে কোনও জাতধর্ম নিয়ে জন্মায়নিএগুলো অনেক অনেক বছর পর আমারাই সৃষ্টি করেছিঅর্থাৎ, আমরা সবাই আসলে জাতিতে একটিইমানুষ‌জাতিআর আমাদের সকলের ধর্ম, সংস্কৃতিও একটিই হওয়ার উচিৎ; সেটি হলোমনুষ্যত্বআমরা সবাই যদি নিজেদের এমন করে ভাবতে পারি, তাহলে পৃথিবীতে কোনদিন জাতধর্ম নিয়ে কোথাও কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধবে নাআমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মেকে নিশ্চিতরূপে একটি ভয়ংকর বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে যেতে পারব,চিরকালের জন্যপ্লিজ, আপনারা একটু ভাবুনএই ছোট্টছোট্ট শিশুদের মুখের দিকে তাকিয়ে অন্তত–!” 
প্রিন্সিপালস‍্যারের কথা শেষ হওয়ার আগেই শ্রীরাধা এবং ফতেমার বাবা উঠে দাঁড়ালদুজনেই হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে প্রিন্সিপালস‍্যারের সঙ্গে হ‍্যান্ডশেক করলএখন তাদের দুজনের চোখের পাতায় জল থৈ থৈ করছেঅন‍্যদের চোখও ছল্ ছল্।  কিন্তু কেউ আর কোনও কথা বলতে পারছে নাপ্রিন্সিপালস‍্যার, শ্রীরাধা ফতেমার বাবার কাঁধে তাঁর দুহাত রেখে একগাল হেসে বললেন,
তাহলে,এবার সমস্যাটা তো মিটেই গেলআপনারা শীঘ্রই  পুতুলের বিয়ের আয়োজনটা সেরে ফেলুনসেদিন আমরা সবাই গিয়ে,মিলেমিশে আনন্দ উপভোগ করে আসব! খেয়েও আসব খুব জমিয়ে।“
 শ্রীরাধা ফতেমার মায়ের মুখেও এখন লাফিয়ে লাফিয়ে খেলে বেড়াচ্ছে মিষ্টি মিষ্টি হাসিতারাও তাদের দুই মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে খুব আদর করলতারপর, হাসিমুখে সবাইকে পুতুলের বিয়ের নিমন্ত্রণ করে বাড়ি ফিরে গেল অপার আনন্দ সঙ্গে করে      
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।