আমাদের আর দেখা হয়নি (সর্বশেষ পর্ব)
“তারপর সাঁয়ায় জড়ালো পা, শাড়িতে জড়ানো আমি, আমি খেলাম হোঁচট, হোঁচট ছিল দ্রুত আমি সোজ মুট্রোরেল লাইনে।
দু-সেকেণড আর আছে হাতে বোধহয়,
কতকিছু বলার ছিল বাকি—
ভালবাসি, খুব ভালবাসি, খুব-খুব ভালবাসি
তবে আমাদের আর দেখা হলো না…”
স্টেশনে ট্রেন থামার আওয়াজটা এই মুহূর্তে অন্যরকম,
আশেপাশের মহিলা দের চিৎকার আর পুরুষদের ‘ধর-ধর’ শোরগোলেও রক্ত ছিটকানোর আওয়াজ শুনলাম আমি।
শরীরটা তখন লেপে আছে মাংস-চামড়া সমেত মেট্রোর রেল- লাইনের সাথে,
পড়নে তোমার প্রিয় আকাশী শাড়ি এখন কোথাও কোথাও অনল-লাল, গাঢ় খয়েরী আর পিছনের দিকে শ্যাওলাতে।
সবাই লাশ দেখতে এগিয়ে এসেছে। একটা নারী লাশ।
নারী লাশও লাশের মতোই দেখতে হয়— ক্ষতবিক্ষত অথচ শান্ত।
আমি তখনও তোমাকে দেখার চেষ্টা করছি, অত অচেনা তবু আমার-মৃত্যু নিয়ে ব্যতিব্যস্ত মানুষের ভিড়ে;
মন আর আত্মা থেকে রক্ত ঝরে না, তাই তাদের কদর কেউ করে না।
তোমাকে দেখলাম।
তুমি একটু থমকে পিছিয়ে গেলে,
রবীন্দ্র সদন প্ল্যাটফর্মের এক চেয়ারে গিয়ে বসলে।
তোমার গায়ে আমারই দেওয়া আকাশী পাঞ্জাবি, তোমার বই প্রকাশের উপহার।
তুমি ফোনটা বের করলে।
তুমি কি এরপরও আমাকেই ফোন করবে?
তুমি কি এখনও ভাবছো আমি ফোনটা ধরব? ধরতে পারব? এতটা ভালবাসো?
কাউকে একটা ফোন করে তুমি জানালে, “ও সুইসাইড করেছে”
আমি কতবার চিৎকার করলাম, “বাবি এটা অ্যাক্সিডেন্ট, আমি আত্মহত্যা করি নি”
তারপর দেখলাম ট্রেনের চাকাটা গলায় উঠে গেছিল।
তুমি তাকে বললে, “আচ্ছা এখনই করছি। তুই রাখ”
আমাদের সব মেসেজ, সব কথা, সব জমানো প্রেম তুমি একবারে ডিলিট করলে।
তুমি আগাগোড়াই খুব বাস্তববাদী।
ফোনে থাকা সমস্ত ছবি, কাজে-অকাজে পাঠানো সব সেল্ফী, তোমায় নিয়ে করা সব আবৃত্তি— নিমেষে মুছে দিলে,
ফোনের ওয়ালপেপারের ছবিটাও কি সরিয়ে দেবে?
তুমি ফোনটা লক করতে বুঝলাম ওয়াল পেপারে আমি ছিলামই না কখনও।
উল্টোদিকের মেট্রো তে উঠতে যাবে এমন সময় অ্যানাউন্সমেন্ট—
“মেট্রো পরিসেবা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করা হলো”
গোটা শহর কেমন উত্তেজিত হয়ে উঠল সেই মুহূর্তে, শুধু তুমি শান্তভাবে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলে।
পকেট থেকে বের করে, ছুড়ে ফেললে একটা কাগজ
আমি কুড়িয়ে নিতে পারলাম না তা। একটা বাচ্চা তা তুলে নিল সেটা, এরোপ্লেন বানাবে।
আমি পড়লাম,
“সারাজীবন তোমার কাছে অপরাধী হয়ে থাকবো জানি, তবে সম্পর্কটা রাখতে পারছি না। তোমার সাথে থাকতে গেলে পাল্টাতে হচ্ছে অনেকটা। নিজেকে পাল্টাতে চাই না।”
কষ্ট হলো তবে বুকে ব্যথা হলো না। দেখলাম ওরা বেলচা দিয়ে আঁচিয়ে নিচ্ছে লাশ।
ছুট্টে গিয়ে তোমার হাত দুটো ধরতে চাইলাম। বলতে চাইলাম, “খুব ভালবাসি। তোমাকে পাল্টাতে হবে না। তুমি এমনই থেকো”
পারলাম না ছুঁতে। কালো ধুঁয়ো উড়িয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলো তোমার বাস।
তুমি এখনও কাঁদো নি। রাত্রে কাঁদবে বোধহয়!
পরের ভোরে নিজেই ঘুম থেকে উঠলে। আমার মেসেজ আসতে পারেনি আজ।
মনমরা, তবু তুমি কলেজ গেলে। একটু চুপচাপ, তবু বন্ধুদের সাথে হাসলে, ফেরার পথে স্টেশনে ঘুগনি কিনে খেলে…
আমার মা এদিকে জল আর মিষ্টি খেয়েছে শুধু।
দু-দিন পরে তোমরা সিনেমা গেলে, পরের দিন সরবর লেক,
বন্ধুরা তোমায় সামলে নিচ্ছে।
বাড়ি ফিরে তুমি গান শুনে ঘুমিয়ে পড়ছো রোজই,
আমি কি তাহলে আর নেই?
তোমার ডায়েরীর শেষ লেখাটা দেখলাম,
“ভালবাসি মানেই অধীনে থাকবো, তা আমি পারব না
প্রেম আমার কাছে ঘেন্না, যেখানে প্রেমিক স্বাধীন না”
আমার কষ্ট হলো, তবে গাল তো ভিজল না! ওরা পুড়িয়ে দিয়েছে লাশ।
তুমি নতুন ফোন কিনেছো। আমার নম্বরটা আর সেভ করো নি, দেখলাম।
আস্তে-আস্তে এবার ফুরিয়ে যাচ্ছে সব, যতটুকুতেই ছিলাম।
জানি না এখনও, মৃত্যুর পর কোথায় যেতে হয়। শুধু বুঝলাম আত্মাদের মৃত্যু হয় শোকসভা ছাড়াই;
ভাগ্গিসঃ আমাদের দেখা হয়নি!
তোমার প্রেমিকা হয়ে মরলাম তবে,
প্রাক্তন হয়ে বেঁচে থেকে রোজ মনটাকে মরতে হলো না
কারণ আমাদের আর কখনোই দেখা হলো না।।