এই মুহূর্তে বাংলা ভাষায় কবিতা লিখছেন এমন কবির সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যাবেই। শক্তি চট্টোপাধ্যায় বেঁচে থাকলে সেবারের মতো আবার কী বলে ফেলতেন কে জানে! জীবনানন্দের আমলকির কষ ভরা পরিপাচ্য উক্তি টাকেও পাশে রাখা যাক – সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি। এ সময়ে যারা লিখে চলেছেন তাঁদের কেউ আধুনিক, কেউ উত্তর আধুনিক, কেউ হয়তো উত্তরোত্তর আধুনিক কবিতা লিখে চলেছেন। সেসব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শ্রেণীকরণে না গিয়ে এখন যে সব কবিতা লেখা হচ্ছে তাদের কিছু কিছু বিভিন্ন পত্র পত্রিকা থেকে নিয়ে দেখা যাক এই সময়ের কবিতার নির্মাণের রূপ ও দর্শণ ঠিক কিরকম। অনেক দিন ধরেই একটা কথা উঠে এসেছে – আধুনিক কবিতা দুর্বোধ্য। শুধু সাধারণ পাঠক নয় অনেক দীক্ষিত কবিরাও এ কথা বলেন। জয় গোস্বামীর মতো একজন সাংকেতিকতার চূড়ান্ত ব্যবহারকারী কবিও কি বলেন নি তিনি জীবনানন্দের কিছু কিছু জায়গা আজও বুঝে উঠতে পারেন নি! আমি নিজেও সামান্য যা কিছু কবিতা লিখেছি তার সম্পর্কেও আমার কিছু কবি বন্ধুরা বলেছেন লেখাগুলো বুঝতে পারি না। এটাকে সত্যি মেনে নিয়েই কিছু কবিতায় ঢুকে পড়া যাক।
‘সুডৌল রোদের গায়ে গড়িয়ে পড়ছে খিদের কষ/ঘুমের ভেতর মগ্ন শুশ্রূষাটুকু নিয়ে অনিমেষ,/উড়ে গেল দীন/আশ্চর্য কুয়োর ভেতর সমস্ত প্রতিধ্বনি ঘাতক/হয়ে ফিরে আসছে’ । কবি শৈলেন চৌনীর কবিতা ঘাতক। প্রচলিত শব্দের পরম্পরা ক্ষয়ে যায় জেনেই কবিকে নতুন আঙ্গিকে শব্দ যোজনা করতে হয়। তাই তিনি রোদের আগে সুডৌল বসাতে পারেন। ফলে পংক্তিটি শুরুতেই ঝিকিয়ে উঠল। সুডৌল শব্দটা যৌবনবতী নারীদেহের সৌষ্ঠব বোঝাতে বহু ব্যবহৃত হয়ে শেষে জীবনানন্দের কথায় নিন্দনীয় মাংসে পরিণত হয়েছে। সেজন্য কবি এক অভাবনীয় পারম্পর্যে লিখেছেন সুডৌল রোদ। রোদ সবসময় কড়া হয় না তো। শীতের সকালের যে হালকা রোদ গায়ে পরে নেওয়া যায় তা অবশ্যই সুডৌল। শব্দটির ভেতর কেমন একটা গোলাকার কোমলতা আছে যা ছুঁয়ে দেয় আমাদের। কিন্তু এমন পেলবতা পরে আর থাকে না। জলের উল্টোদিকে আগুনের মতোই একটা সুতীব্র বিরোধাভাষ তৈরী হয় যখন বলা হয় সেই রোদের গায়ে গড়িয়ে পড়ছে খিদের কষ। খিদে তো অনুভবের বিষয় তাকে দৃশ্যমান করে তোলা হচ্ছে যখন বলা হল খিদের কষ। রসভরা ফল খেতে গিয়ে গালের কষ বেয়ে সেই ফলের রস গড়িয়ে পড়ে দেখেছি। কিন্তু খিদেও পেটের ভেতর থেকে উঠে এসে গালের কষ বেয়ে কষের মতো গড়াচ্ছে। আর কষ কিন্তু প্রায়শই ত্বকে ক্ষত সৃষ্টি করে। খিদেও তাই ক্ষতসৃষ্টিকারীর মতো। এভাবেই কবিতায় এখন কবিরা শব্দে শব্দে আশ্চর্য সংঘর্ষ ঘটান। ফলে সেই কবিতা পাঠ হয়ে ওঠে এক আবিষ্কার। দীন শব্দটির ব্যবহারও নতুন যুগের। দীন Adjective হলেও তাকে Adverb করে দেওয়া হয়েছে এখানে। উড়ে গেল দীনভাবে না লিখে লেখা হল উড়ে গেল দীন। এসময়ের কবিতায় বিশেষণ ব্যবহারে অপটিমাম লেভেলের দক্ষতা দরকার হয়। উপমা ব্যবহার, সিনট্যাক্স, ভাবনার বিষয় সবেতেই নতুনত্ব – এক আবিষ্কার। জীবনানন্দ তো কবেই লিখেছেন উটের গ্রীবার মতো নিস্তব্ধতা, পাখীর নীড়ের মতো চোখ তুলে। আজকের কবিতায়ও কবিরা নিজ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী নতুন পথে জার্নিতে নিয়ে যাচ্ছেন পাঠককে। অর্ণব মন্ডলের কবিতার নামকরণটি দেখুন থ্রি সিক্সটি। আমরা সাধারণত তিনশো ষাট বলি না। ৪২০ বলার চেয়ে ফোর টুয়েন্টি বেশী কার্যকরী। অর্ণব লিখছেন – ‘কুমারী ধোঁয়ার দর্শতত্ত্ব ও রেডিমেড অভ্যাসের ভিন্ন স্বাদে/আমি দেখেছিলাম-/ম্যালিসাস্ দাঁড়কাকের মতো/একটা প্রেমের খুবলে খাওয়া হলফনামা/কেমনভাবে ভুলতে বসেছো তুমি’ । কুমারী আর ধোঁয়া শব্দদুটির সহাবস্থান কিরকম এক অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলল। কুমারী বলতে তো যে নারী কৌমার্য হারায় নি। হয়তো বিবাহযোগ্যাও। তার সমস্ত প্রস্তুতি, সতেজতা, আনটাচড ফ্যাক্টর ধোঁয়ায় আরোপিত করা হয়েছে। তারপর ম্যালিসাস দাঁড়কাক। অশুভ দাঁড়কাক নয় ম্যালিসাস। অশুভ বললেই যেন সেই সাবেকী পঞ্জিকা, যাত্রা নাস্তি, শুভ অশুভ যোগ ইত্যাদি চলে আসে। ম্যালিসাস বললে ফ্ল্যাটফাঁপড় নাগরিক জীবনের সমস্ত সেকুলারী যাপন অনুষঙ্গ চলে আসে। সুমন মহান্তির ‘বিকেলের কাছে’ অসম্ভব লিরিক্যাল এক কবিতা। শব্দের ধ্বনির অনুরণনে আলতো কোমল ভাব সমগ্র কবিতার শরীর জুড়ে। ‘ফুরন্ত বিকেল, কথা রাখো, ছুঁয়ে থাকো কিছুক্ষণ/সন্ধের নির্মোহ পারাপারে এখনই নামবে বিষণ্ণ পরাগ’ । এ কবিতার পালকের মতো নির্ভার চলন পাঠককে উষ্ণ করে তোলে। শ্যামশ্রী রায় কর্মকারের ‘গোধূলি ও বেয়াত্রিচে’ থেকে কোট করি – ‘গিনসবার্গ না নেরুদা, তাই নিয়ে মেঘেদের যায় আসে না কিছু/শিমূল পলাশেরও নয়/এই নির্জন স্টেশনে বসে এইসব বৃথা তর্ক শুনে ফাট ধরে যাচ্ছে সিমেন্টের গায়ে/পরিত্যক্ত ট্রেন থেকে নেমে আসছে/সোনালী লোমওয়ালা প্রাচীন ফরাসী কুকুর’। একেবারেই আজকের মানুষের আড্ডার ভাষায় এ কবিতার শুরু। আমরা কথায় কথায় বলে ফেলি- আমার কিছু যায় আসে না। তেমনিই মেঘেদের যায় আসে না কিছু। তারপরেই ছোট্ট সংযোজন -‘শিমূল পলাশেরও নয়।’ লক্ষনীয় : প্রথম লাইনটির পুনরাবৃত্তি না করেও পুরো লাইনটা আরেকবার মাথার ভিতরে বেজে উঠল। কেউ বলল – আমার টানা বৃষ্টি ভালো লাগে না। আরেকজন বলল – আমারও। এসব কিন্তু আমাদের দৈনিক ব্যবহৃত ভাষারই উজ্জ্বল অংশ। কবির কলমে এসব ছোটোখাটো কারুকাজ আলোময় হয়ে ওঠে। এসব কৌশল অনেকেই ব্যবহার করেন জেনেবুঝে বা সহজাতভাবে। তারপর শ্যামশ্রী লিখছেন – ‘ফাট ধরে যাচ্ছে সিমেন্টের গায়ে’ – ফাটল নয় ফাট। এখানেও এক টি বর্ণ ছেটে শব্দের ভার আরো কমিয়ে আনতে চাইছেন যেন। সিমেন্টের গায়ে ফাট ধরা থেকে দর্শনযোগ্য ইমেজারী গড়ে উঠতে লাগল। তারপরেই তো ঐ চমৎকার লাইনটি এল যেখানে পরিত্যক্ত ট্রেন থেকে নেমে আসছে সোনালী লোমওয়ালা প্রাচীন ফরাসী কুকুর। এখানে প্রাচীন এই বিশেষণের ব্যবহার অসাধারণ না হলেও অনিবার্য। এই কবিতায় আরো আরো চমৎকার ব্যবহার রয়েছে ‘এক সদ্যস্নাত যুবক যেন এক ব্যথার দেবতা’। আশ্চর্য নয়! ব্যথার দেবতা? কবির মনোজগতের সফটওয়্যার এসব নিয়েই খেলা করে। সে নির্মাণ করে ব্যথার দেবতাকে। ‘চুল থেকে ঝরে পড়ছে দুঃখের আলো’। দুঃখের আলো একটু চেষ্টা করে কেউ লিখতেই পারেন। কিন্তু চুল থেকে দুঃখের আলো ঝরে পড়ছে – আরেকটি সুস্পষ্ট ছবি। কথা ব্যবহার করে ছবি ফুটিয়ে তোলা সাহিত্যের কাজ। যিনি যত প্রবলভাবে এটা পারেন তিনি তত সফল। রেহান কৌশিকের ‘ভালোবাসবার জন্য’ সরল ও সুন্দর এক নির্মাণ বেয়ে সৃজন। ‘ভালোবাসবার জন্য সিংহাসন নয়/একটা সাঁকোর দরকার/সিংহাসন কী দেয়? কী দিতে পারে? তরবারির আস্ফালন থেকে/ ক্ষমতা জন্মায়, যে ক্ষমতা রক্ত আর ঘৃণা থেকে জাত।/সাঁকো – মুগ্ধতার টুকরো টুকরো কাঠ দিয়ে গড়ে ওঠে’। একেবারে কৌশলহীন টানটান উচ্চারণ রেহান কৌশিকের। অথচ কী মায়াময় হয়ে উঠেছে কবিতাটা। প্রথম কয়েকটি লাইন পড়লেই কিছুটা বুঝতে পারা যায় তার কবিতার পালসটা ঠিক কিভাবে স্পন্দিত হয়ে চলেছে। এইসব কবিতার মাঝখান থেকে দুটো লাইন বা দুটো এক্সপ্রেশন উদ্ধৃত করে কবিতাটাকে ধরা যাবে না । কারণ পুরো কবিতাটাই একটা রাগরূপের মতন আলাপ বিস্তার ইত্যাদি ইত্যাদি দিয়ে প্রথা মাফিক স্ফুটন ক্রিয়াকে সম্পূর্ণ করতে হয়। অবশ্য সব কবিতার ক্ষেত্রেই একথা সমানভাবে প্রযোজ্য।
পরিশেষে বলা দরকার এ সময়ের কবিতার হাঁড়ির একটি চাল হাতে নিয়ে দেখার প্রয়াস মাত্র এই লেখাটি। একটি চাল বলাটাও বাড়াবাড়িই হয়ে যাবে। তবু একটু আলোকক্ষেপনের চেষ্টা করা গেল। বিভিন্ন কবির রচনার কৌশল বিভিন্ন রকমের হলেও এটা মোটা দাগে ভাগ করা যায়। একদল কবি সংকেত প্রতীক এগুলোকে বদলে নিজের মতো করে নির্মাণ করে নিচ্ছেন তাঁদের কাব্যের ভাষা, ডিকশন। আরেকদল সহজ সরল লিখেও কাব্যগুণ নষ্ট হতে দেন না। দুই ধারাতেই উল্লেখযোগ্য কবিতা রচনা করে চলছেন তাঁরা।