• Uncategorized
  • 0

‘কফি পাহাড়ের রাজা’ সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব – ১ ।। খন্ড – ৬)

কফি পাহাড়ের রাজা

প্রথম পর্ব:

৬)

অবশেষে বৃষ্টিও এলো। মৌসম ভবনের পূর্বাভাষ অনুযায়ী সঠিক দিনক্ষণ মেপেই এলো। এরকম আসার যেন কোন বিস্ময় থাকতে নেই। আগে থেকে ফোন করে অতিথি আসার মতো। যে অতিথি আবার অনেকদিন থাকবে বলে এসেছে। ফলে তার জন্য খুব একটা সাজো সাজো রব ওঠেনি। প্রস্তুতি হিসেবে যত কাঠ ছিল চেরাই করার সবই আস্তানার নিচে ঠাঁই পেয়েছে। ভিজে গেলেই সর্বনাশ! তাছাড়া পুরনো বড় ছায়া গাছগুলোকে কেটে ফেলা হয়েছে নিয়ম মতো। নইলে এতটাই জঙ্গল হয়ে যাবে এই কদিনে যে কফি বীজ পুঁততে গেলে প্রচুর সমস্যায় পড়তে হবে। সবদিকে খেয়াল না রাখলে একটা বড় প্রোডাকশন হাউজ কিছুতেই চালানো যায় না, এ শিক্ষা মুরুগানের অনেক দিন আগেই হয়ে গেছে। এখন এইসব কাজের জন্য আলাদা করে ওকে মাথা ঘামাতে হয় না। একটা সিস্টেমে চলে সবটা। বিভিন্ন কাজ বা প্ল্যান দেখাশোনার জন্য আলাদা আলাদা লোকজন নিযুক্ত করা হয়েছে। টেনশনের কিছু নেই, যদি না বড় রকম কিছু ন্যাচারাল ডিসাস্টার অথবা প্রোডাকশন লস্‌ জনিত কিছু হয়। মুরুগান ভাবছিল আপন মনে। যেমন ওর স্বভাব। বিদ্যা কাজে ব্যস্ত। ওর হাঁটাচলা, হাত-পা নেড়ে কাজকর্ম করার মধ্যে একটা সুস্পষ্ট নিজস্বতা আছে বরাবরই সেটা দেখে এসেছে ও। আজ কেন জানি বিদ্যার এই রোজকার কাজগুলোকে খুব ছন্দবদ্ধ বলে মনে হল মুরুগানের। স্টিরিওটাইপ হয়েও যেন নিজস্ব স্টাইলে এই সমস্ত প্রাত্যহিকতা একটা শৈলীর রূপ নিয়েছে। আসলে বিদ্যার মধ্যে এত গুণ প্রচ্ছন্ন আছে যে, খুব স্বাভাবিক ভাবে একটা শৈল্পিক ছাপ থেকেই যায় ওর যে কোনো কাজে।
বাইরে বৃষ্টির তোড় বাড়ছে। আজ প্রথম দিনেই বুঝি সব ভাসিয়ে নিতে চায়! বিদ্যা রান্নার তোড়জোড় করছে। একটু গলা খাঁকারি দিল মুরুগান। বিদ্যা প্রশ্ন চোখে নিয়ে তাকাল ওর দিকে। মুরুগান বলল, ‘চল্‌, আজ বৃষ্টির উৎসবে মাতি। লেটস্‌ সেলিব্রেট দ্য ফার্স্ট ডে অব দিস রেনি সিজন!’ বিদ্যা এক লহমায় যেন কিশোরী মেয়েটি হয়ে উঠল। তার মুখ আনন্দ ফেটে পড়ছে, ঠোঁট টিপে হাসছে ছেলেবেলার মতোই। শাড়ির আঁচলটা গুছিয়ে নিল বেশ করে কোমরে। বিদ্যার বুকের দিকে তাকাল মুরুগান। বয়সের ছাপ এখনও সেভাবে ধরা পড়ে না ওর চেহারায়। এই কোরাবাদের চেহারার বাঁধুনি এরকমই শক্তপোক্ত। মুখে অবশ্য হাজারটা বলিরেখা আছে। মুরুগানের দৃষ্টি লক্ষ্য করেছে বিদ্যা। ও কি লজ্জা পেল একটু? সেসব বুঝতে না দিয়ে গুটি গুটি পায়ে মুরুগানের কাছে চলে এলো ও। মুরুগান ডান হাত রাখল বিদ্যার বুকের ওপর আর বাঁ হাত দিয়ে ওর কোমর জড়িয়ে বলল, ‘আজ আর রোজের মতো কুলু বা কাঞ্জি চাপাস না হাঁড়িতে। হয় কুলু দিয়ে ডাল, তরকারি, মাছ বা চিকেন, নয় কাঞ্জির মধ্যে সবজি বা চিকেন সেদ্ধ ফেলে খাওয়া—এই একঘেয়ে খাবার আজ আর খাব না। তুই আজ পান্ডি কারি বানা। তোর হাতে এই রান্নাটা যা খোলে না! আর সঙ্গে অবশ্যই ডিপ ব্রাউন কাড়ুমবুট্টু! ফ্রিজে পর্ক বোঝাই করে রেখেছি। বেশি করে বানাবি, যেন খেয়ে শেষ না করতে পারি। আর তারপর তোতে আমাতে সারাদিন বসে বসে এই দিয়ে স্কচ খাব। যতক্ষণ না দুজনে মাতাল হয়ে উল্টে পড়ে যাই…’। বিদ্যা আর হাসি চাপতে পারল না মুরুগানের উচ্ছাস দেখে। খিলখিল করে হেসে উঠল ও। আর মনে মনে ভাবল, ‘হুঁহ বাবু যেন কত্ত রান্না জানে! কুলু না করলে কাড়ুমবুট্টু হবে কী করে? বড় হাঁড়িতে জল চাপাল ও। অনেকটা চাল ধুয়ে রেখে দিল। চাল সিদ্ধ হলে ফ্যান ঝরিয়ে তৈরি হবে কুলু। আর ফ্যান রেখে দিলে হয়ে যেত কাঞ্জি। তারপর এই কুলু কাচুমপুলি(যাকে মুরুগান গারসিনিয়া কামবোগিয়া ভিনিগার, না কী যেন বলে)দিয়ে চটকে মেখে ছাঁকা তেলে বড়ার মতো ভাজলেই হয়ে গেল কাড়ুমবুট্টু। এইসব কোরাবা রান্না তো বিদ্যাই করে খাইয়েছে মুরুগানকে। এই যে বিখ্যাত পান্ডি আইটেম, সেও কি আগে কোনদিন খেয়েছিল মুরুগান? ওদের রান্নার সঙ্গে আমাদের রান্নার ঢের ঢের তফাৎ। পর্ক বলে আধসিদ্ধ কিছু পদ ওরা খেত আগে। আমিই এখানে এসে এই পান্ডি বানিয়ে খাওয়ালাম একদিন। তুলতুলে নরম এই মাংসের স্বাদ যে খাবে কোনদিন ভুলতে পারবে না। তবে সত্যি বলতে কী, মুরুগানের এখানে রান্না করার সুবাদে আমিও এইসব ভালমন্দ পদ খেতে পারি মাঝেমাঝে। নইলে কখন, কবে উৎসব আসবে, সবাই মিলে একসঙ্গে রান্না করা হবে যৌথ হেঁসেলে, ভাগে মিলবে তাও দু’এক টুকরো আর সঙ্গে কুলু পচাই। অবশ্য সেই পচাই মদ তৈরি করতেও ও পারে। কিন্তু মুরুগানের অবশ্য এসব রোচে না। স্কচ খায় শুধু। ওর ভাইপো কুগানটাও তেমনি। সে ব্যাটার এখনও ঘুম ভাঙেনি অবশ্য। জেগে উঠে পান্ডি আর কাড়ুমবুট্টুর খবর পেলে আর রেহাই নেই বিদ্যার। প্রায় কড়া থেকে তুলে নিয়ে খেয়ে নেবে। ছেলেটার ওপর কেন যেন মায়া পড়ে গেছে বিদ্যার। নিজের তো আর দিল না ওপরওলা। সন্তান কোলে গরবিনী মায়ের রূপ শুধু দেখে এলো আজীবন। একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বিদ্যা কাজে মন দিল আবার।
পান্ডি’র খুশবু ভেসে আসছে। কুলু পেষাই হয়ে রেডি। এবার বড়া ভাজার অপেক্ষা। গন্ধতে মুরুগানের সেই যৌবনকালের কথা মনে এলো। এইরকম মাংস পেলে যৌবনের তাগদ যেন বহুগুণ বৃদ্ধি পেত। এখন শরীরের ভেতর আনচান করে উঠছে বটে, কিন্তু রক্ত মাথায় উঠছে না। প্যান্টের ভেতর কোন চাপ অনুভব করছে না। এই বয়সে এসে মনে হয় এই আনচান করা শরীর থাকার চেয়ে না থাকা অনেক ভাল। কোন উত্থান নেই, ভাঙচুর নেই, কোন শিথিলতা নেই, শরীর যেন একটা জড়ের মতো প্রায়। মাঝেমাঝে এইভাবে আনচান করে উঠে সে জানিয়ে যায়, আমি আছি, ছিলাম একসময়ে প্রবল ভাবে। একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস লুকিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুরুগানের বাপ্পা রেড্ডির কথা মনে এলো। বাপ্পা যখন এসেছিল এখানে, তখন দুজনেই যুবক। বাপ্পা এক কলেজে ইতিহাস পড়াত। ছাত্রদের কোরাবাদের জনজীবন দেখাতে আগ্রহী ছিল। ফলে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বাপ্পা, যাতে সে গ্রামে গিয়ে ওদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতে পারে। মুরুগান সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। গাঁওবুড়োর থেকে ওদের ভাষা, ইতিহাস, লোকসংস্কৃতি সম্বন্ধে বিস্তারিত কথাবার্তা চলাকালীন প্রায় পুরো সময়টাতেই মুরুগান ওদের সঙ্গ দিয়েছিল। সেই সময়ে তো আর টুরিস্টদের আসাযাওয়া ছিল না এখনকার মতো। বাইরের লোকেদের তখনও ওরা ভাল চোখে দেখত না। এখন অবশ্য ওরা নিজেরাই হোমস্টে বানিয়ে টুরিস্টদের থাকতে দেয়, গ্রাম ঘুরিয়ে দেখায়, কফি বাগান দেখায়, জঙ্গল দেখায়। তাতে বেশ উপার্জনও হয় বলে শুনেছি। তা করুক। সত্যি বলতে কী, আগেকার মতো দারিদ্র্য ওদের কাবু করতে পারে না এখন। ভাল থাক, সবাই ভাল থাক। বৃষ্টি দেখতে দেখতে মুরুগান একটু আনমনা হয়ে পড়ে ভাবছিল এইসব আকাশ পাতাল। এই কোরাবা বৃটিশদের উচ্চারণে হয়েছিল কুর্গ। সেই থেকে কুর্গই চালু হয়ে গেল।
সেদিনের পর থেকে বাপ্পার সঙ্গে ওর খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল। মাঝেমাঝে বাপ্পা আসত ওর কাছে। সেরকমই একদিন কথায় কথায় এই কোরাবাদের সম্বন্ধে বেশ কিছু তথ্য জেনেছিল। কোরাবারা কোথা থেকে এসেছিল আদপে, সে নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কোরাবারা নাকি এখানেই, মানে কোরাগুতেই থাকত বরাবর। একসময়ে ওরা ছিল যোদ্ধা। বহুযুগ পার করে পরবর্তী কালে চাষবাসই  হল ওদের মুখ্য জীবিকা। শোনা যায় চওড়া খুলির এই মানুষগুলো নাকি আর্যদেরও আগে, সেই মহেঞ্জোদরো যুগে এদিকে আসে আর কোরাবায় থাকতে শুরু করে। কেউ কেউ বলে এরা নাকি সিথিয়ান্সদের উত্তরসূরি, কেউ আবার বলে ইন্দো-সিথিয়ান্স, যেমন শক, পশ্চিম ক্ষত্রপা, থায়ারদের। কন্নড় শিলালিপিতে কারুগু নার(কোরাগু, পশ্চিম মাইসোর ও কেরালা অঞ্চল)-এর উল্লেখ আছে। বাসিন্দা আর বাসস্থানের নামগুলি এইরকম—কোরাবা, কোরাবু; কোরাগা, কোরাগু; কুর্গস, কুর্গ। ‘নামে কী আসে যায় রে মুরুগান? এরা আসলে সবাই একই জাত। একই এলাকার মানুষ। যেভাবে গোলাপকে তুই রোজ্‌ বলিস, সেরকমই…’ ঠিক এভাবেই বাপ্পা বুঝিয়েছিল ওকে। আজ কেন জানি খুব স্পষ্ট ভাবে মনে পড়ছে ওকে। সে এখন কোথায় কে জানে। ধীরে ধীরে কবে থেকে যেন মুরুগান নির্বান্ধব হয়ে পড়ল এই কাজের চাপে, নিজেও খেয়াল করেনি। তবে যে যাই বলুক এই কোরাবারা এখানের সবথেকে পুরনো জাতি, যারা হাজার হাজার বছর ধরে রয়েছে কোরাগুতে। আর এই যোদ্ধার জাতই এই অঞ্চলে প্রথমবারের মতো চাষবাসের প্রথা চালু করেছিল।
বিদ্যার হাতে দুই থালা ভর্তি পান্ডি আর কাড়ুমবুট্টু দেখে মুরুগান তড়িঘড়ি বোতল বের করল। খিদেটাও জমিয়ে পেয়েছে। কুগানকে ওর খাবার ঘরে দিয়ে এলো আজ বিদ্যা। ওকে দেখে মনে হল রান্নার পরে একটা পাটভাঙা রঙিন শাড়ি পরেছে। সাধারণত ও বা ওদের জাতের মেয়েরা সাদা শাড়িই পরে। মুরুগানই বরং বেশ কিছু রঙিন শাড়ি কিনে দিয়েছিল ওকে। আজ তেমনি এক মর্চে রঙা শাড়িতে বিদ্যা এসেছে কিঞ্চিৎ প্রসাধনের পরে। শাড়িটা পরেছে ওদের উৎসবের সাজের মতো করে। পিঠের দিকটা প্লিট করা আর সামনের আঁচল ডান কাঁধে পিন দিয়ে আটকানো। একলাফে বয়সটা আরেকটু কমে গেছে ওর। মাথার বাঁধভাঙা কালো কুচকুচে চুলটাও গুছিয়ে দুটি খোঁপা বেঁধেছে পাশাপাশি। সামনের দিকে সিঁথি কেটে দুপাশে বেশ কয়েকটি ওদের নিজস্ব ঢঙের কাঠের ক্লিপ লাগিয়েছে। সত্যি! চুল বটে মেয়েটার! এখনও যেন আকাশ থেকে সমস্ত মেঘ পেরে এনে আটকে রেখেছে চুলের রাশিতে। গুছিয়ে বসল বিদ্যা হাসিহাসি মুখে। ওর সাজ দেখে মুরুগানেরও ওদের পুরুষদের মতো কুপ্যা পরতে ইচ্ছে করছিল। সাদা ফুল হাতা জামার ওপর রোব-এর মতো একটা কোট জড়িয়ে নেয় ওদের পুরুষরা এসময়ে। পায়ে সাদা পাজামা। নিজের ওই ড্রেসে সজ্জিত চেহারাটা ভাবতেই মুরুগানের আবার হাসি পেল। তার মিলিটারি ড্রেসই ভাল বাবা! হাসি নিয়েই গ্লাস এগিয়ে দিল মুরুগান বিদ্যার দিকে। ধীরে ধীরে দুজনের আড্ডা জমতে শুরু করেছে। বেশিরভাগই যৌবনের কথা। আঁচ নিচ্ছে যেন দুজনে সেই সময়ের। ওদের নিভন্ত শরীর থেকে এক পরম আভা উঠে আসছে, যা টের পাচ্ছে এই বৃষ্টি, এই মেঘগর্জন। আর কিছুটা বুঝছে কুগান।

ক্রমশ….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।