• Uncategorized
  • 0

‘কফি পাহাড়ের রাজা’ সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব – ২ ।। খন্ড – ৫)

কফি পাহাড়ের রাজা

দ্বিতীয় পর্ব:

)

‘১৭৮২ সালে হায়দার আলী মারা গেলেন। আর সেই থেকে আমরা পেরিয়াপাটনায় কড়া সুরক্ষার মধ্যে নজরবন্দি হয়ে রয়ে গেলাম ছ’বছর। ১৭৮৮ সালে এই যে আমি পালিয়ে গেলাম কোরাবায়, বলতে যতটা সহজ, কার্যক্ষেত্রে এ যে কী দুঃসাহসের কাজ ছিল, সে একমাত্র আমিই জানি। উৎকোচ গ্রহণে যে সবাই সম্মত হবে, বা গ্রহণ করলেই যে আমাকে ওই কেল্লা থেকে বেরোতে সাহায্য করবে, এমন তো নয়! সোনা, গয়না হাতিয়ে রক্ষীরা যদি চুপ করে টিপুর পক্ষেই থেকে যেত, আমার অন্তত কাউকে অভিযোগ বা বিচার জানানোর ছিল না। স্বয়ং মহাদেবের কৃপা ছিল নিশ্চই আমার ওপর, নইলে ওই ম্লেচ্ছ মহল থেকে আমি প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারতাম না। রক্ষীরাও আমার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করেছে, বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। আমি ফিরে আসার পরে কোরাবারা নতুন প্রাণ ফিরে পেল যেন। টিপুর সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে নামলাম আমরা। এদিকে টিপু এতদিনে জোর করে আমাদের যোদ্ধাদের ওঁর দলে নাম লিখিয়েছিলেন। ফলে আমাদের লোকবল ওঁর সেনাবাহিনীর থেকে অনেক কম ছিল। তাও আমরা ভয় পাইনি। এরপরে যা হল, তার জন্য আমরা নিজেরাই প্রস্তুত ছিলাম না’।
‘কী হয়েছিল সেই যুদ্ধে?’ রানীর আকুল প্রশ্নে রাজেন্দ্র বললেন, ‘সেদিন আমরা সবাই কোরাগুর নাম নিয়ে চিৎকার করে জয়ধ্বনি দিচ্ছিলাম নিজেদের মনোবল বাড়ানোর জন্য। জয় কোরাগুর জয়! জয় কোরাগুর জয়! দিকে দিকে এই ধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছিল। এই ধ্বনিতে যে কোন কোরাবার বুকের রক্ত উদ্বেল হয়ে ওঠাই ছিল স্বাভাবিক। আর সেই ঘটনাই ঘটেছিল তখন। টিপুর সেনাদলে যত কোরাবারা ছিল, তাদের তখন আর শরীর চলছিল না। হাতের অস্ত্র থেমে গেছিল। কিছুমাত্র দ্বিধা না করে, কোনরকম পরিকল্পনা ছাড়াই তারা সকলে একযোগে আমাদের হয়ে যুদ্ধ করতে শুরু করল। এরপরে টিপুর আর কিছু করার ছিল না। তাঁকে আর তাঁর সেনাদলকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম আমরা শ্রীরঙ্গপত্তনমে। এরপর টিপু আর আমাদের বিরক্ত করতে আসেনি’।
‘আর তোমার দুই ভাই? তাদের কী হল?’
‘এও কী আর বলার! লিঙ্গরাজা আর আপ্পাজিকে আমরাই সদলবলে গিয়ে ওখান থেকে মুক্ত করে নিয়ে এসেছিলাম। এরপর আর দুবছরের মধ্যেই আমরা টিপুর অধীনস্থ আমাদের যত কেল্লা আর ভূমি ছিল, সবই ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলাম’। ‘এই জন্যই তো কোরাবারা এখনও তোমাকে বীরের সম্মান দেয়। তুমি আমার বীর। বীরা রাজারাজেন্দ্র’। ‘আর তুমি আমার রানী নও শুধু, তুমি এই কোরাগুর মহাদেবী, মহাদেবাম্মা। তোমার ছত্রছায়ায় আছি বলেই আমরা সুখে বসবাস করতে পারছি। শুধু আমার দুভাই এই বয়সে এসে এমন লোভীর মতো আচরণ করছে, এটাই আমি মেনে নিতে পারছি না। বড় দুঃখ হয় গো রানী! আপনার জনরা যখন হিংসে করে, যখন বুকের দু’টুকরোকে পর করে দিতে হয়…কী যে কষ্ট!’
এরপর রাজা আর রানীর মাঝে আচমকা এক ঝলক স্তব্ধতা নেমে এলো। দুজনেই উদাস মুখে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। যদিও তখন তাঁদের বিবাহিত জীবনের প্রথম পর্ব চলছে। সন্তান আসেনি রানীর গর্ভে তখনও। রানীর তখন কতই বা বয়স! সদ্য যৌবন প্রাপ্ত হয়েছেন। সেদিক থেকে দেখতে গেলে রাজারাজেন্দ্র বরং প্রৌঢ়ত্বের সীমা পেরবেন প্রায়। বয়স্ক ও অভিজ্ঞ এক পুরুষ। পোরখাওয়া রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ইদানীং তাঁর গতি কিছুটা শ্লথ হয়েছে। সেই ছোটবেলা থেকে সংগ্রামের মধ্যে থাকতে থাকতে, যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেকে নিংড়ে দিতে দিতে আজকাল তাঁর কিঞ্চিৎ ক্লান্ত লাগে। একটু বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে হয় তাঁর। আর সেই জন্যই এই নালকানডু প্রাসাদে এসে বসবাস করার ইচ্ছে হয়েছিল। প্রকৃতির কোলে একান্তে, নিভৃতে বাকি জীবনটা কাটানোর ইচ্ছে আছে তাঁর। এবার একজন উত্তরাধীকারীর হাতে তাঁর কোরাগুকে সমর্পন করলেই তাঁর ছুটি। যদিও রানীর এখনও গর্ভাধান হয়নি। এই রকম ভাবনা নিয়ে রাজেন্দ্র রানীকে নিয়ে নিজেদের শয়নকক্ষে গেলেন।
মিলনের পরে রাজেন্দ্র ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। রানীকে অবশ্য তেমন ক্লান্ত দেখাচ্ছে না। মাঝেমাঝে তাঁর নিজের সংশয় হয়। তিনি কি পারেন রানীকে তৃপ্ত করতে? রানী তো কখনও মুখ ফুটে অতৃপ্তির কথা জানাবেন না, ফলে তাঁকেই বুঝে নিতে হবে। অল্প বয়সের প্রাবল্য আছে তাঁর শরীরে, তিনি যেন সবসময়ে রানীর সঙ্গে তাল মেলাতে পারেন না বলে মনে হয়। যদিও এসব ভাবার কথা নয় রাজাদের। রাজাদের রানীর সংখ্যা অনেক হওয়াই স্বাভাবিক। ফলে প্রত্যেক রানীকে তৃপ্ত করার দায় কোন রাজারই থাকে না, থাকে না এই প্রসঙ্গ মনে আনারও। নিজের তৃপ্তিটুকুই রাজার অধিকার। রানীদের ক্ষোভ জানানোর প্রশ্নই আসে না বা আসেনি এখনও। কিন্তু মহাদেবাম্মা তাঁর কাছে শুধু এক নারী শরীর মাত্র না, একজন রানী মাত্র না, বা পুরুষ সন্তান জন্ম দেবার উপায় মাত্রও নন তিনি। মহাদেবাম্মা রাজেন্দ্রর অর্ধেক আকাশ, অর্ধেক হৃদয়। তাঁর প্রতিটি মুহূর্ত সুখে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে রাজার। এইসব অকারণ ভাবনা মাথায় আসে। এই তো, রানী নিশ্চিন্তে তৃপ্ত মুখে ঘুমিয়ে পড়লেন পাশ ফিরে। মহাদেবাম্মার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে স্নেহে ভরে গেল রাজেন্দ্রর হৃদয়। বয়সে অনেকখানি ছোট হওয়ার জন্যই রানীকে তিনি এক বাচ্চা শিশুর মতো দেখভাল করেন। যতক্ষণ এখানে থাকেন, রানীর সঙ্গ ছাড়েন না। ধীরে ধীরে ঘুম এসে নামল রাজার চোখের পাতায়। একটা হাত পরম আশ্রয় খুঁজে নিল রাজার কণ্ঠ বেষ্টন করে।
 ঠিক এই সময়ে লিঙ্গরাজার ঘরে মৃদু আলো জ্বলছে। আপ্পাজি ও আরও কয়েকজন পুরুষমানুষ গভীর মনোযোগ দিয়ে একটি মানচিত্রের ওপর ঝুঁকে পড়ে কিছু শলাপরামর্শ করছেন। সেই ঘরের বন্ধ জানলার ফাঁক দিয়ে এক ছটাক আলো গিয়ে বাইরে পড়েছে ত্যারছা হয়ে। সেই মৃদু আলোয় কেউ যদি ঠাওর করে দেখতেন—দেখতে পেতেন একজন ছায়ামানুষ অন্ধকারে মিশে কান পেতে সেই ঘরের আলোচনা শোনার চেষ্টা করছে। যদিও তখন সেখানে কেউ ছিল না। চারিদিকের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছিল হিংস্র শ্বাপদের চিৎকার। যে চিৎকার ওই বন্ধ ঘরের মৃদু গুঞ্জনের থেকে কম ভয়াবহ।
যেখানে তীরন্দাজির ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেখানে তখন সবাই জড়ো হয়েছে। এই খেলাই ওদের সবথেকে বড় আকর্ষণ। কুপিল্লা ভিড় থেকে বাঁচতে সরে গেল ওখান থেকে। মেয়েটা কই? আর তো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না ওকে। হয়ত আজ আর দেখা হবে না ওর সঙ্গে। মাথা নিচু করে দূরে, রাস্তার দিকে চলে যাচ্ছিল কুপিল্লা। সামনে একটা টাঁড় জমি। চড়া রোদে গা জ্বালা করছিল ওর। তাড়াতাড়ি পা চালালো ও। হঠাতই যেন ধূমকেতুর মতো জমি ফুঁড়ে উঠে এলো মেয়েটা। ভূত দেখার মতো চমকে উঠল ও। থমকে দাঁড়াল মেয়েটার মুখোমুখি। সরাসরি চোখে চোখ রাখল মেয়েটার চোখে। আর পরক্ষণেই কেঁপে উঠল ও। আবার, আবারও খিলখিল করে হাসিতে ভেঙে পড়ল মেয়ে। অনেকখানি সাহস সঞ্চয় করে কুপিল্লা জিজ্ঞেস করল, ‘এত হাসির কী আছে? বিনা কারণে এত হাসি মোটেই ভাল নয়’। অনেক কষ্টে হাসি চেপে সে বলল, ‘তাই বুঝি? তা, কী ভালো শুনি?’ এবার আবার হাঁটার জন্য এক পা বাড়াতে চাইল কুপিল্লা। অথচ যাওয়ার মন নেই ওর। নিছক গাম্ভীর্য আনার জন্যই এই ছল। আর এই চাতুরীতে বেশ কাজ হল। মেয়েটা আলতো করে ঠ্যালা দিল ওর বুকে। পিছিয়ে গেল কুপিল্লা। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে ছুঁয়ে দিলি যে বড়? চেনা নেই, জানা নেই, একটা পুরুষমানুষকে ছুঁয়ে দিলি? কী নাম তোর—সেটাই জানি না এখনও!’ আরও এক পা এগিয়ে এল সেই মেয়ে। রোদে আর সুরার নেশায় কিঞ্চিৎ উচ্ছল হয়ে আছে সে। কুপিল্লার বুকের কাছে ঘেঁষে এলো ও। আর ফিসফিস করে বলল, ‘আমার নাম বিদ্যাবতী। তুমি বিদ্যা নামে ডাকতে পার আমাকে। আর ছোঁবার কথা বলছিলে! এই নাও…আরও বেশি করে ছুঁয়ে দিলাম তোমাকে। জাত গেলে তোমারই যাবে বামুনের পো। আমার কিছুই হবে না’। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল কুপিল্লার। ওর শরীরের খুব কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে বিদ্যা। ওর নিঃশ্বাসের উষ্ণতা টের পাচ্ছে। আর নিজেকে সামলাতে পারল না ও। বিদ্যাকে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটে ঠোঁট রাখল। বিদ্যাও যেন এই অপেক্ষাতেই ছিল। আশ্লেষে জড়িয়ে ধরল কুপিল্লাকে। তারপর কুপিল্লার হুঁশ ফিরল। এই দিনদুপুরে, খোলা জমির মাঝখানে ওদের যে কেউ দেখে ফেলতে পারে। আচমকা হনহন করে হাঁটা দিল ও বিদ্যাকে কিছু না বলেই। চলে যেতে যেতে বিদ্যার হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছিল ও পিছন থেকে। ‘ভীতু কোথাকার! পালাচ্ছে দ্যাখ বামুনের পো!’ আবার ঠাঠা করে বিদ্রুপের হাসিতে ফেটে পড়ল বিদ্যা।
কিছুদিনের মধ্যেই আরও এক প্রত্যাশিত আনন্দ সংবাদে রাজারাজেন্দ্র ও রানী মহাদেবাম্মা আনন্দে ভেসে গেলেন। রানীর ক্ষুধামান্দ হওয়ায়, রাজবৈদ্য রানীকে পরীক্ষা করে জানালেন, সন্তান সম্ভবা তিনি। সাজো সাজো রব পড়ে গেল প্রাসাদে। রাজেন্দ্র এখন আর প্রাসাদ ছেড়ে বেরোতেই চান না। সবসময়ে রানীকে হাসি, গল্পে মাতিয়ে রাখেন। রানী মহাদেবাম্মা কোনভাবে কাতর হয়ে পড়লে, রাজারও ক্ষুধানিদ্রা উধাও হয়ে যায়। এমনি ভাবে কেটে গেল ছ’টা মাস। চর মারফৎ রাজা তাঁর ভাইদের সবরকম গতিবিধির খবর রাখেন। মুখে কিছু প্রকাশ করেন না। ভাইদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেন। রানীকেও এর বিন্দুবিসর্গ জানাননি তিনি। রাজবৈদ্য বারবার করে রাজাকে বলেছেন, রানীর মন যেন আনন্দে প্রফুল্ল থাকে সর্বদা। তবেই না সন্তান হবে সুস্থ সবল! সেই কর্ত্তব্য রাজা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছেন এতদিন। এরই মধ্যে ব্রিটিশদের সঙ্গে আরও একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছিল। প্রথম চুক্তির প্রলম্বিতকরণ হল এই দ্বিতীয় চুক্তিতে। আজীবন বৃটিশ সমর্থন জানাবেন বীরা রাজেন্দ্র—এই মর্মে তিনি নিজেকে সুরক্ষিত করেন টিপুর হাত থেকে। যে টিপু আবার তাঁর বাবা অর্থাৎ হায়দর আলীর সময় থেকে ফরাসীদের সমর্থন নিয়ে পুষ্ট হয়ে আসছিল। সেই কারণে আত্মমর্যাদা বিসর্জনের প্রশ্নও বীরা রাজেন্দ্রর মনে কখনও আসেনি। তাঁর কোরাগু বরাবর স্বাধীন রাজ্য হয়েই থেকে গেছিল। রানী মহাদেবাম্মা আরও খুশি হয়েছিলেন এই সংবাদে। সমস্ত কোরাগু অপেক্ষায় ছিল তাদের প্রিয় দোদ্দা বীরা রাজারাজেন্দ্রর নতুন বংশধর আসার, তাদের নতুন রাজার মুখ দেখার জন্য কোরাগুর সমস্ত ঘরে ঘরে উৎসব পালনের মহড়া শুরু হয়ে গেছিল।
রাজবৈদ্য একদিন জানিয়ে গেলেন, আর বেশি সময় বাকি নেই। এখন রানীর প্রসব যন্ত্রণা ওঠার অপেক্ষায় থাকতে হবে কেবল। সেও আর দুএকদিনের মধ্যেই… রাজা এখন রানীর পাশে বসে আছেন উদ্বিগ্ন মুখে। রানী ম্লান হেসে রাজাকে সান্ত্বনা দিলেন। ‘তুমি ভয় পাচ্ছ রাজা? তুমি না আমার বীর! আমার বা আমার সন্তানের কিচ্ছু হবে না, দেখে নিও। তবে আজ এক আবদার করব তোমার কাছে। যদি সম্ভব হয়, কথা রেখ আমার’। রাজা বললেন, ‘তোমাকে অদেয় আমার কিছু নেই বল রানী, কী চাও তুমি। আমি এখনই এনে দেব সেই বস্তু’। ‘না, রাজা কোন পার্থিব বস্তুর আমার প্রয়োজন নেই। তুমি আমাকে না চাইতেই অঢেল দিয়েছ। অমূল্য ভালবাসা দিয়েছ, এরপর আমার আর কিছু চাইবার নেই। আমি চাই, আমাদের সন্তান যেন বিলেতে পড়াশুনো করে বড় হয়ে ওঠে। এই সাহেবদের দেখে আমি আপ্লুত। কী তাদের শিক্ষা দীক্ষা, কী তাদের মার্জিত ব্যবহার! আমাদের সন্তান বিলেতে বড় হবে। তারপর কোরাগুর রাজা হয়ে বসবে সিংহাসনে’।
সেদিন বিদ্যাও আবদার করেছিল তার কাছে! বুকের ভেতর থেকে উঠে এসেছিল তার ঘন স্বর। তীরন্দাজীর মাঠে আবার ফিরেছিল কুপিল্লা। কিছুদূর গিয়ে ফেরত চলে এসেছিল ও। ভেবেছিল, এভাবে ফিরে গেলেই বরং অনেকের সন্দেহ হবে। তাছাড়া, ফিরে তো সেই বাড়িতেই থাকতে হবে, তার চেয়ে কিছুক্ষণ খেলা দেখা যাক্‌। কিন্তু সেদিন স্বয়ং বিশ্বনাথের ছিল অন্যরকম মর্জি। সূর্যের আলো মরে এসেছে। সবাই ঘরে ফিরছে একে একে। এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে কুপিল্লাও বাড়ির দিকে পা চালালো। সে পথ দিয়ে এসেছিল সেদিক দিয়ে না গিয়ে অন্য এক ঘুরপথ ধরল ও। মনে ভয় ছিল, যদি আবার বিদ্যার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়! খেতের আল দিয়ে, কারুর বাড়ির মধ্য দিয়ে সরু পায়ে চলা পথ দিয়ে সে যাচ্ছিল আনমনে। সূর্য ডুবে গেছে তখন। আধো অন্ধকারে ছেয়ে আছে এলাকা। চারিদিকে খুশির আবহাওয়া, ফসলের গন্ধ, মানুষের হাসি, কলরব কানে আসছিল। সে যত এই এলাকা ছেড়ে দূরে যাচ্ছিল, ওর মনের ভেতরটা কেমন সূর্যের মতোই নিভে আসছিল। না জানি, আবার কবে আসা হবে এখানে। আর কি বিদ্যার সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের উপায় করে দেবে বাবা বিশ্বনাথ? কী লাভ? তাকে তো আর পাওয়া যাবে না কোনদিন নিজের করে। এইসব ভাবনার মধ্যে আচমকাই কে যেন হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিল ওর। ভূত দেখার মতো চমকে উঠল কুপিল্লা। একটা ভাঙা একচালার মধ্যে ওকে নিয়ে এসেছে বিদ্যা। হাঁফাচ্ছে। ওর দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকাতেই কুপিল্লার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিদ্যা। আর হহু করে কান্নায় ভেঙে পড়ল। তার একমাথা চুলের খোঁপা লুটিয়ে পড়েছে, চোখের জলে বুক ভিজে যাচ্ছে কুপিল্লার। কোনরকমে ওর মুখ তুলে শান্ত করার চেষ্টা করল কুপিল্লা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বিদ্যা বারবার বলতে থাকল, ‘আমাকে কথা দাও! কোনদিনও তোমায় আমি পাব না জানি, কিন্তু ভুলে যাবে না আমায়, কথা দাও! একবার অন্তত মিথ্যে করেও বল, আমায় ভুলবে না!’ কুপিল্লাও আবেগে ভেসে গেল সেই মুহূর্তে। অনেক আদর সোহাগের মধ্যে সে যেন এক পূর্ণ পুরুষ হয়ে উঠল সেদিন। বাবার কথা মনে করে ভয় পেল না। সম্মানহানির কথা ভাবল না একবারও। বাড়ি যেতে যেতে সেদিন স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল—বাবার সঙ্গে মুখোমুখি মোকাবিলা করতে হবে এবার। তাতে বাড়ি ছাড়তে হলে, ছাড়বে। হ্যাঁ, একটু আগে বিদ্যাকে সে কথা দিয়েছিল, ওকে সে কোনদিনও ভুলবে না, সারা জীবন নিজের কাছেই রাখবে।

ক্রমশ….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *