সেই যে বেলাটা ভোলা যায় না, মাঝে মাঝে মনের ঘরে উঁকি দেয় ফুলের মিষ্টি গন্ধের মত! সেইবেলায় পড়া শেষে মা আমাদের কবিতা পড়ে শুনাতো। কখনও বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় হ্যারিকেনের আলোতে বইপত্র চটপট তুলে ছুটি নিয়ে নিতাম। কার না ভালো লাগে এমন অসময়ের ছুটি? আর সেই যে গল্প ! রবিঠাকুর ছোটবেলায় নাকি ইস্কুল যেতে চাইতেন না, নিয়ম করে পড়াশুনা করতেও চাইতেন না !! আহা, কি ভালো! কেন যে আমাদের জোর করে ইস্কুলে পাঠান বাবা মা!! হায় রে শিশুমন! সবাই কি আর রবি? তা বোঝে কে? যাই হোক্, সেই ছোট্ট বেলাতেই মা’য়ের মুখে শোনা কিছু কিছু কবিতা কিভাবে যেন বেশ নাড়া দিত! ‘দেবতার গ্রাস’ শুনতে শুনতে কি ভীষণ মন খারাপ যে লাগত! আর ‘পুজোর ছুটি’, ‘বীরপুরুষ’, ‘ছুটি’,’লুকোচুরি’…. শুনে মনে হত কি করে এমন লেখেন কে’জানে! কখনও আনন্দে কখনও দুঃখে মনের জানালাগুলোয় কে যেন নাড়া দিয়ে যেত!
কিন্তু প্রশ্ন হল তিনি কে! সেই….যে বয়সে প্রথম স্কুলে যাওয়া, সেই সময় থেকেই তো “জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ” গানের সাথে পরিচয়… বলো তো কে লিখেছেন? বাড়িতে বড়রা কি স্কুলের দিদিমনিরা শিখিয়েছেন… রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর…. কচি মুখে তখন রবীন্দ্রনাথ হয়ে গেলেন রবীন্দনাথ! একটু একটু করে আমাদের বড় হওয়া, একটু একটু করে ছড়া, কবিতা, গান, সহজ পাঠ… আমরা বড় হই, ধীরে ধীরে তিনি আমাদের নিত্য পাঠের রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন। তবুও প্রাণের হয়ে উঠতে সময় লাগে! সেই শৈশব-কৈশোরে যত সহজে মনের অলিগলি ঘুরে ফিরে বেড়ায় দাশু, লালু, তোপসে,ঋভু, গোগোল…. শরৎচন্দ্রের ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘পন্ডিতমশাই’, ‘মেজদিদি’, ‘রামের সুমতি’ কি সুকুমার পায়ের ‘দাশুর কীর্তি’, ‘গোঁফচুরি’….তেমন ভাবে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অতিথি’র তারাপদ, সমাপ্তি’র মৃন্ময়ী কি পোস্টমাস্টার’এর রতন মনের দরজায় কড়া নাড়ে না! হয়ত আমরা তাদের সরিয়ে রাখি নিজেদেরই অজ্ঞতায়!
একটু একটু করে বড় হই আমরা!তখন শুধু দু’একটা গল্প, ছড়া,কবিতাই নয়! প্রবেশ ঘটে তাঁর উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, পত্রাবলী, চিত্রকলা’র এক আশ্চর্য জগতে! মন বলে মানুষটি কি না করে গেছেন!
মনে পড়ে স্কুলে প্রত্যেক বছর কত যত্নে গুরুত্ব সহকারে আমাদের রবীন্দ্রচর্চা’র ক্ষেত্রটি তৈরির চেষ্টা করতেন দিদিরা!একবছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চার চারটি নাটক অভিনীত হয়েছিল এমনই রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তীতে! সেইদিন, ‘ছুটি’ গল্পটির নাট্যরূপটিও ‘ছুটি’ নামেই অভিনয় করেছিলাম আমরা। সৌভাগ্যক্রমে নাটকে ‘মাখন’ চরিত্রটিতে অভিনয় করলেও ফটিকের সেই জীবনের হাসি-গান থেকে চিরবিদায়ের দৃশ্যটি যে কতখানি নাড়া দিয়েছিল, তা আজও ভুলতে পারি না! ফটিক শেষ শয্যায় বলছে.. “মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা , এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি”…. ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল! বুঝলাম একটু একটু করে ভিতরে ভিতরে তিনি হয়ে উঠছেন কাছের মানুষ! তাঁর গান শুনছি, তাঁর লেখা পড়ছি… এই সময় থেকেই একাত্মতার অলক্ষ্য আলিঙ্গন! হাতে যখন যেমন বই পাচ্ছি পড়ছি! ‘শেষের কবিতা’ স্কুলজীবনেই বার দু’য়েক পড়ে ফেললাম! কিছু বোঝা কিছু না বোঝা রইল অবশ্যই। পাশাপাশি ‘ছেলেবেলা’, ‘শিশু’,কিছু নাটক,ছোটগল্প,উপন্যাস!দিন যত যায়, চেনা জানার পরিসর বাড়ে!একটু একটু করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিশাল অঙ্গনের প্রবেশ-দ্বারটিও উন্মুক্ত হতে থাকে! ভাবের গভীরতায় হৃদয়ে টানের আকুলতা অনুভব করছি তখন ! মনে – আনমনে তাঁরই গান! “হাওয়া যেমন পাতায় পাতায় মর্মরিয়া বনকে কাঁদায়”…. তেমন করেই বুকের মাঝেও যেন তাঁর নিবিড় সঞ্চরণ শুরু হয়ে গেল! এ একান্তই নিজের অনুভূতি! তবু মনে হয় এ আরও অনেকেরই মর্মকথা! কারণ তিনি অনেকের’ই “নিভৃত প্রাণের দেবতা” যে!
আবার এ কথাও খুব সত্য, তাঁর সৃষ্টি যে সবসময়ই আপামর বাঙালির খুব প্রিয় হয়ে উঠেছে তা’ও নয়! কারণ আমরা কম জেনে ভান করি সবথেকে বেশী জানার আর না জেনে সব জানার অহংকার করি! তাই তাঁকে আমরা জানা-অজানায় আর দেখা না দেখায় মেশানো এক অন্য অনুভবে গ্রহণ করে ফেলি!কিছু ভুল জানা দিয়ে বিচার করি তাঁর প্রতিভাকে,সৃষ্টিকে!আজও তাই এ নিয়ে তর্ক চলে,আগামীতেও চলবে!
তবুও তাঁকেই যে বারবার আমন্ত্রণের চিঠি পাঠাই মনের ডাকঘর’এ! প্রেমের কথা মুখ ফুটে বলতে না পারলেও সেই প্রিয়’কে তাঁর কথা দিয়েই মনে মনে বলি, “তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম”… আবার উদাত্ত কন্ঠে প্রেমিক বলে উঠতে পারেন অনায়াসে…”তুমি আমারি, তুমি আমারি, মম জীবনবিজনবিহারী”
গভীর গোপনে তাঁকে আমরা স্মরণ করি, তাঁর শরণে নিজেকে সঁপে দিই নিশ্চিন্তে! দুঃখে-কষ্টে- বিষণ্ণ চিত্তে-প্রার্থনায় তিনি হয়ে ওঠেন পরিত্রাতা! “ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা প্রভু তোমার পানে”…. ধর্ম মানে না! জাতি মানে না! বর্ণ মানে না! কেবল নিবেদনটিই আকাশ বাতাস জুড়ে গভীর আবেগে চিরন্তন হয়ে ধরা দেয়!তিনি তাই সর্বজনের আপনার জন! তাঁর কবিতা, গান, প্রবন্ধ মনে কি যেন এক পবিত্রতা ,শান্তি নিয়ে আসে!বয়সের সাথে সাথে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এই যে তাঁকে ধারণ করি, বরণ করি, স্মরণ করি তা কি শুধুমাত্র একটি দিন!তা তো নিত্যদিনের সঙ্গী, “চিরপথের সঙ্গী “। তাই না এমন নিশ্চিন্ত হয়ে নিত্য চাওয়া, নিত্য চলা! “বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি”… বিশ্ববন্দিত হয়েও কত অনায়াসে তিনি এ’কথা বলেন!তাঁকে জানা তাই ফুরায় না! অতিসামান্য জ্ঞানে, সামান্য বোধে তাই তিনি’ই “চিরসখা”…”পরাণসখা, বন্ধু হে আমার”…