“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় রাজদীপ ভট্টাচার্য্য
by
·
Published
· Updated
আমি ও রবীন্দ্রনাথ
বিগত শতাব্দীর সত্তর বা আশির দশকের একজন শিশু যখন বর্ণপরিচয় পেরিয়ে সহজপাঠ’এ পৌঁছত, তার কাছে ফুলের পাপড়ি খোলার মতো কিংবা অন্ধকার পেরিয়ে ভোর হওয়ার মতো পৃথিবী ধীরে ধীরে চেনাত নিজেকে। আমরা দেখতে শিখতাম চারপাশ। আর সেই বড় হওয়াকে আদরে আদরে জড়িয়ে থাকতো আমাদের সহজপাঠ।
“বনে থাকে বাঘ”, “আলো হয় গেল ভয়” পেরিয়ে যখন পৌঁছলাম “কালো রাতি গেল ঘুচে” তখন ধীরে ধীরে যেন ভোর হচ্ছে। খুব রহস্যময় লাগত যখন পড়তাম “তারাগুলি নিয়ে বাতি/ জেগেছিল সারারাতি,/ নেমে এল পথ ভুলে /বেলফুলে জুঁইফুলে।” পড়তাম আর কোথাও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হতো খুব। হয়তো করতামও। যখন আমি পড়ছি “ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি /আছে আমাদের পাড়াখানি”, তখন অবশ্যই নিজের পাড়া, খেলার মাঠ, মাঠের পাশে পুকুর- এসব ভেসে উঠতো পড়ার বইয়ের পাতায়।
আমার গ্রীষ্ম আসত ছোটো নদীর হাঁটু জলে। বর্ষা নামতো তার খরতর ধারায়। শরৎ ভেসে আসত শিশিরে, শিউলিতে। আমলকী বনের পথ ধরে ধীর পায়ে এগিয়ে আসত পাতা ঝরার ঋতু। মনে মনে ভাবতাম আমলকী গাছ ঠিক কেমন দেখতে! স্বপ্ন দেখতাম নদীর ঘাটের কাছে বাঁধা নৌকো খুলে নিয়ে আমি চলে যাচ্ছি বহুদূর দেশে।
এভাবেই একদিন প্রথম ভাগ থেকে দ্বিতীয় ভাগে পৌঁছলাম। কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি চলতে শুরু করল গড়গড়িয়ে। সবচেয়ে ভালো লাগত একদম শেষে পৌঁছে। যখন কবি বলছেন, “পাড়ার ছেলে স্নানের ঘাটে / জল ছিটিয়ে সাঁতার কাটে।” নিজেকে অবিকল মেলাতে পারতাম। বেশ কল্পলোকে আপনাকে বনবাসী করে পোষ মানাতাম বনের হরিণ। পড়তে খুব ভালো লাগতো “ফলসা বনে গাছে গাছে / ফল ধ’রে মেঘ ঘনিয়ে আছে”। যেন জলরঙের মেঘাচ্ছন্ন আকাশ আর তার নিচে গাঢ় সবুজ জমে আছে।
এরপরে এল শহরের কথা। তমিজ মিঞার গরুর গাড়ি চড়ে শহরের দিকে যাওয়া, সারাদিন খেয়াল মত দেয়াল গড়ে তোলার ছবি। কবিতার সাথে সাথেই মনে রোদ উঠতো ঝিলমিলিয়ে। তিন শালিখের ঝগড়া। আর সবচেয়ে মন কেড়ে নিত “শীতের বেলা দুই পহরে / দূরে কাদের ছাদের ‘পরে / ছোট্ট মেয়ে রোদ্দুরে দেয় / বেগনি রংয়ের শাড়ি,”। তখন ভালোবাসাকে বোঝার বয়স হয়নি, তবুও একটি অচেনা মেয়ে ছাদের আলসেতে বেগনি রংয়ের শাড়ি মেলে ধরছে আর বাতাস তাকে বারবার উড়িয়ে দিচ্ছে আকাশের দিকে। ছবির মত দেখতাম একা একা।
অক্ষরগুলো জীবন্ত হয়ে উঠত নিমেষে। একমনে পড়তাম “হঠাৎ কিসের মন্ত্র এসে / ভুলিয়ে দিলে এক নিমেষে / বাদল বেলার কথা,/ হারিয়ে পাওয়া আলোটিরে নাচায় ডালে ফিরে ফিরে / ঝুমকো ফুলের লতা।” সারাদিনের বৃষ্টি, মেঘলা আকাশকে সরিয়ে বিকেলবেলা হঠাৎ যেন হলদে কনে দেখা আলো! এইতো সহজ পাঠের ম্যাজিক। সেই ছোট্ট মনে কল্পনাকে জাগিয়ে তোলার মন্ত্র। পড়তে পড়তে চোখের সামনে নড়ে উঠত বিছের মত চলমান হ্যারিসন রোড। শুনতে পেতাম স্টিমারের বাঁশি। এঞ্জিনের ধকধকি। অন্ধ কুঞ্জবিহারীর দুঃখে কেঁদে উঠত মন। মনে হতো আমারও বেশ অমন ল্যাজকাটা ভক্ত কুকুর থাকলে ভারি ভালো হয়। এভাবেই বিনু, গুপী, মৈনীমাসী, সৌরীদিদি, রঙ্গলাল বাবু, আক্রম কিংবা উস্রী নদীর ঝর্ণার শব্দ শুনতে শুনতে আমরা কখন বড় হয়ে গেলাম।
তাইতো আমাদের বেড়ে ওঠা, পৃথিবীকে চিনতে শেখা, জীবনকে জানা – সবকিছুই রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। ওই বেগনি রঙের শাড়ি কিংবা ঝুমকো লতার বুকে আলোর নাচনটুকু দেখার জন্যই যেন এই বেঁচে থাকা। পরবর্তীকালে নানা রঙের রবীন্দ্রনাথকে অল্পবিস্তর চিনেছি, জেনেছি। বিস্ময়ে হতবাক হয়েছি। তবু সেই সহজপাঠের সহজ মানুষটি আজও আমার সবথেকে কাছের, সবচেয়ে আপনার।