“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় প্রজ্ঞাপারমিতা
তিন
সুন্দর করে সাজানো একতলার হলঘর।স্টেজের পিছনে কালো বোর্ডে সাদা হলুদ সবুজ চকে আঁকা আলপনা।তার মাঝখানে নমস্কারের জোড়া হাত। মৃদু রজনীগন্ধার সুবাস।হলঘরের এপাশ থেকে ওপাশ কোনাকুনি কত নিশান।সেগুলোর কোনটায় আঁকা গরুর গাড়ি আরেকটায় আঁকেবাঁকে চলা নদী কোনটায় আবার গানের কলি কবিতার মুখ।
এবার সমাপ্তি।মেয়েরা চনমন করছে।হলঘরের পিছনে সারি দেওয়া চেয়ারে বসে দিদিরা ও উৎসুক।নাইনের মেয়েদের সম্পূর্ণ নিজস্ব ভাবনায় করা এই সমাপ্তি অনুষ্ঠান।প্রতি বছরই এই দায়িত্ব থাকে ক্লাস নাইনের।কিন্তু এবারের ব্যাচ স্কুলেই তো আসে না ঠিকমতো।তাও যখন যাদের পাওয়া গেছে দিদিরা বুঝিয়ে দিয়েছেন অনুষ্ঠানের গাম্ভীর্য।
স্টেজে এলো সুপর্ণা দাস।মাইকের সামনে এসে নমস্কার জানালো।”সমাপ্তি অনুষ্ঠানে আমাদের নিবেদন কন্যাশ্রী।“কোন কোন দিদির ভুরু গেল কুঁচকে।কোন দিদির মুখ হলো গম্ভীর।করছে কী! স্টেজের দুপাশে দাঁড়ানো মেয়েরা গেয়ে উঠলো_এ দিন আজি কোন ঘরে গো খূলে দিল দ্বার/আজি প্রাতে সূর্য ওঠা আ সফল হলো কার/কাহার অভিষেকের তরে সোনার ঘটে আলোক ভরে।গানের সাথে সাথে নেচে গেল হলুদ শাড়ি আর মাথায় বেলকুঁড়ি মালা দেওয়া দু’জন মেয়ে।মাইকের সামনে রীতা পাশোয়ান।চোখে চোখে হাসি খেলে গেল দিদিদের।একদম পড়া করেনা তো।কী বলবে ও? পারবে?বাঃ বেশ মিষ্টি করে কচি গলায় বলছে তো!’নিবিড় গাঢ় অন্ধকার অনুচ্চারের অপার নিঃস্তব্ধতা।জৈব তরলে অনাবিল ভেসে থাকা এক মানব ভ্রূণ।প্রতীক্ষা করছি মাগো দুরু দুরু বুকে।…….. রিনরিনে গলায় বলে চলেছে রীতা।’আলোর প্রতীক্ষায় আমি ছোট্ট এক মানব ভ্রূণ।মাগো তুমি আছো আমার কিসের ভয়’।আবার গেয়ে ওঠে মেয়েরা”আমি ভয় করবো না ভয় করবো না/দুবেলা মরার আগে মরবো না ভাই মরবো না/আমি ভয় করবো না ভয় করবো না…….”।এবার নাচলো একটি মাত্র মেয়ে।ক্লাসে মাথায় ও সবচাইতে ছোট।রীতা পাশোয়ান আগেই স্টেজ থেকে নেমে গেছিলো।আবার এলো মাইকের সামনে।_’এ কী আনন্দ,কী আনন্দ আমার,কী অবাক সময়আলো হয় আমায় স্নান করিয়েছে,বাতাস শুকিয়ে দিয়েছে আমার শরীর,শ্বাসে পেলাম ফুলের সুবাস,আকাশের বাদল মেঘে আমার মাথার কালো চুল,স্বাতী অশ্বিণি দিলো চোখের দ্যুতি।মাগো আদর করে নিচ্ছ তুমি কোলে।মসজিদে আজানের মিষ্টি সুর,মন্দিরে শাঁখে পরলো ফুঁ,দূরে গির্জায় ঘন্টা বেজে যায়।সুরের মায়ায় ছন্দে পৃথিবীর বুকে আমার অভিষেক।’……..প্রায় ছয় থেকে সাতজন নাচতে নাচতে ঢুকলো।গান করছে’আলো আমার আলো আলো ওগো আলো ভুবন ভরা/আলো নয়ন ধোয়া আমার আলো হৃদয় হরা……’।নাচের মেয়েরা নেমে যেতেই আবার শুরু পাঠ।_’বাড়ির সবাই মা তোমাকে ওমনি কেন করছে?ঐ বুঝি পিশি ?বলছে কেন তুমি মেয়ে আনলে?বলছে হঠাৎ অসময়ের সব দায় তোমার? আমাকে আলো দেখিয়েছ এই তোমার দোষ?তুমি তো হাসছো আর কত আদর করছো আমায়।তুমি বলছো দেখছিস না কী আলোড়ন চারিদিকে।পৃথিবীর করতলে ধরা আছে প্রাণ।সে জননী।তোরই উত্তরণ।কন্যা সন্তান দায় না দায়িত্ব।সমস্যা নয় সম্পদ।ভীরু সে নয়,সে নির্ভয়া ,ভারতী সে।পৃথিবীর বুকে এমন প্রাণ হয়ে বাঁচবি যাদের অভয়মূদ্রায় শান্ত হবে অনন্ত চরাচর।প্রেম প্রীতিতে বাঁধবে কোটি প্রাণ।মানব জাতি উপলব্ধি করবে_কন্যা সন্তান আদি থেকে অন্তে ‘শ্রীময়ী’ সে ‘কন্যাশ্রী’।কী চটাপট হাততালি মেয়েদের।দিদিরা হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন।
স্টেজে এবার বাংলার অপরাজিতা দি।সমস্ত অনুষ্ঠানটির থেকে ছেঁকে নিলেন রস।তারপর সবার পক্ষ থেকে নাইনের মেয়েদের অনেক প্রশংসা করলেন।তারপর মুচকি হাসলেন।মনে মনে ভাবলেন কন্যা ভ্রুণের উপর তার রচনার বিষয় আলোচনা কাজে লাগিয়েছে বেশ।ওদিকে কোণের চেয়ারে বসে কৃষ্ঞাদি ভেবে চলেছেন গতবছর অন্য এক অনুষ্ঠানে তিনটে গান তুলিয়ে দিয়েছিলেন এই বছরের যারা নাইন তাদের।ওরা তো গান শিখতেই আসেনা।বেশ গান তিনটেকে যুত করে লাগিয়েছে।মনে মনে দিদিরা ভাবছেন কবিগুরুর নৈবেদ্যে তিনটি গানের ফুলে আর মেয়েদের অন্তর শোভায় কী অপরূপ না হয়েছে।ফোটো ফ্রেমের চতুষ্কোণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মোহন অবস্থান জানিয়ে দিলো _আমি তোমাদের লোক….।