• Uncategorized
  • 0

আজ এভারেস্ট বিজয়ের দিন – লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

বিকজ় ইটস দেয়ার : এভারেস্ট বিজয়ের কথা

এভারেস্ট। চেয়ে দেখলেই বোঝা যায় যে সে সবার উপরে। নেপালী ভাষায় তার নাম সাগর মাথা, তিব্বতী ভাষায় তার নাম চো মো লাংমা।
নাম তার এভারেস্ট। সমুদ্রতল থেকে তার শিখরের উচ্চতা ৮৮৪৮ মিটার বা ২৯০২৯ ফুট। পাথুরে উচ্চতা ৮৮৪৪ মিটার।
আজ এভারেস্ট জয়ের দিন। আজ এভারেস্ট জয়ীদের দিন।
সমুদ্রতল থেকে হিসাব করলে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট। আর সমুদ্রের গভীর থেকে নিজের পাদদেশ থেকে হিসাব করলে সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হল হাওয়াই দ্বীপের মৌনা কিয়া। পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল থেকে মহাশূন্যের দিকে এগিয়ে যাবার প্রশ্নে সর্বোচ্চ মাউন্ট চিম্বোরাজো। আর সৌরজগতের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ অলিম্পাস মনস। ওটি পৃথিবীর বাইরে। মঙ্গলে। কুড়ি কিলোমিটার উঁচু।
“বিকজ ইট’স দেয়ার।”
অসাধারণ একটি কথা।
১৯২৩ সালে অতি বিশিষ্ট পর্বতারোহী জর্জ ম্যালোরী ( ১৮৮৬ – ১৯২৪) এই অসামান্য উক্তিটি করেছিলেন।
এভারেস্ট জয় করার কথা উঠলে আমার জর্জ ম‍্যালোরির কথাই সবার আগে মনে পড়ে।
কেন ওঠেন পাহাড়ের চূড়ায়? সাংবাদিকদের কঠিন প্রশ্নের উত্তরে ম‍্যালোরি বলেছিলেন… বিকজ ইটস দেয়ার।
চিরকালের বিশ্ববিজয়ী হয়েছেন যাঁরা, তাঁরাই এভাবে বলতে পারেন।
আজ মানুষের এভারেস্ট জয়ের দিন।
নিউ ইয়র্কের এক সাংবাদিক ১৯২৩ সালে জর্জ ম্যালোরীকে প্রশ্ন করেন, আপনি এত তীব্র ভাবে এভারেস্ট জয়ে আগ্রহী কেন। তখন পর্বতারোহী বলেন  “বিকজ ইটস দেয়ার।”
এ যেন চিরকালের মানুষী স্পর্ধার কথা।
ম্যালোরী এভারেস্ট জয় করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন। তারিখটা হল  ১৯২৪ সালের ৮ জুন। তাঁর সাথে একত্রে প্রাণ দিয়েছিলেন অ্যাণ্ড্রু আরভিন। সে তখন মাত্র বাইশ বছরের তরুণ।
এভারেস্ট অভিযান খুব কঠিন। ২০১৮ পর্যন্ত পাওয়া একটি হিসেবে এভারেস্ট জয় করতে গিয়ে প্রায় তিনশো জন মানুষ প্রাণ দিয়েছেন।
এভারেস্ট জয় করেন তেনজিং নোরগে আর এডমণ্ড হিলারি একসাথে।  ১৯৫৩ সালে। তারিখটা ছিল ২৯ মে।
ওই ২৯ মে তারিখটাকেই তেনজিং নোরগের জন্মদিন বলে বিবেচনা করা হয়, সালটা ছিল ১৯১৪ । ৭১ বছর বয়সে ৯ মে, ১৯৮৬ তারিখে নোরগে মারা যান।
২০ জুলাই স্যার এডমণ্ড হিলারির জন্মদিন। ১৯১৯ সালে জন্মান, আর ১১ জানুয়ারি, ২০০৮ সালে প্রয়াত হন।
এভারেস্ট শিখরের কথা বললে রাধানাথ শিকদারের কথা আসে। এই বৎসরটি তাঁর প্রয়াণ  সার্ধশত  বৎসর।
এভারেস্ট শিখরকে স্থানীয় মানুষ স্মরণাতীত কাল থেকে চিনতেন। তাকে নেপালের অধিবাসীরা বলতেন সাগরমাথা। তিব্বতের মানুষ বলতেন চোমোলাংমা। স্থানীয় লোকজন জানত দেওডাঙা বলে। কেউ বলত গৌরীশংকর। আর খুবই যে উঁচু, সেটাও মানুষের জানা ছিল। কিন্তু উচ্চতার গাণিতিক বৈজ্ঞানিক হিসেবটা কারো কাছে ছিল না। ১৮০২ সালে ভারতে গ্রেট ত্রিকোণমিতিক সার্ভে শুরু হল। কাজ শুরু হয় দক্ষিণ ভারত থেকে। ১৮৩০ নাগাদ উত্তর ভারত জুড়ে কাজ আরম্ভ হল। ১৮৪৭ এর নভেম্বরে  ব্রিটিশ ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল অ্যাণ্ড্রু ওয়া নিজে গেছেন কাঞ্চনজঙ্ঘার পিছনে আরো উঁচু শিখরটি পরিমাপ করতে। সাথে ভারি ভারি থিওডোলাইট যন্ত্র। পাঁচশো কিলো ওজনের জিনিসটা ব‍ইতে বারোটা কুলি লাগে। ১৮৪৯ সালে কর্তৃপক্ষ পাঠালেন জেমস নিকলসনকে। সাথে পাঠানো হল সবচেয়ে ভালো থিওডোলাইট যন্ত্র। পিক বি, ওটাই তখন নাম ভাবী সর্বোচ্চ শৃঙ্গের। তো পিক বি মাপতে গিয়ে ম‍্যালেরিয়া বাধালেন নিকলসন সাহেব। মারা পড়লেন। এরপর বাঙালি গণিতবিদ রাধানাথ শিকদারের উপর ভার পড়ল। ততদিনে পিক বি হয়েছে পিক XV, পনেরো নম্বর শৃঙ্গ। রাধানাথ দরদী মন নিয়ে নিকলসন সাহেবের খাতাপত্র খু্ঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন। হিসেবের কিছু ভুলচুক সংশোধন করতে গিয়ে নিশ্চিত হলেন সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গের সন্ধান মিলেছে। সেটা ১৮৫২ সাল। ছুটলেন বড়কর্তা অ্যাণ্ড্রু ওয়ার কাছে। মাপজোকের কাগজ খুঁটিয়ে দেখে রায় দেবেন তিনিই। রাধানাথ শিকদারের কাজ দেখে বড়কর্তা আহ্লাদিত। পিক XV এর নাম তিনি দিলেন মঁ এভারেস্ট। ইউরোপের মঁ ব্লাঁ এর অনুকরণে। আর রাধানাথকে দায়িত্ব দিয়ে রাখলেন বাকি শৃঙ্গগুলির নামকরণের। পিক পনেরোর প্রস্তাবিত নাম এভারেস্ট জেনে সার্ভেয়ার সমাজের আনন্দ আর ধরে না। জর্জ এভারেস্ট যে সার্ভেয়ার জেনারেল হিসাবে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু বেঁকে বসলেন এভারেস্ট সাহেব নিজে। তিনি স্থানীয় নাম ব‍্যবহার করার পক্ষপাতী ছিলেন। কর্মরত সার্ভেয়ার জেনারেল অ্যাণ্ড্রু ওয়া  তাঁর পূর্বসূরী এভারেস্ট সাহেবকে বোঝালেন যে পিক পনেরোর স্থানীয় নাম নানাবিধ। একটি সর্বজনস্বীকৃত নাম দরকার। শেষে ১৮৬৫ থেকে পিক পনেরো শিখরটি এভারেস্ট হিসেবে পরিচিত হতে থাকল। পরের বছর ১৮৬৬ তে এভারেস্ট সাহেব প্রয়াত হলেন। ১৮৭০ এ প্রয়াত হলেন রাধানাথ শিকদার। আর ১৮৭৮ এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন অ্যাণ্ড্রু ওয়া।
১৯৫৩ সালে, ২৯ মে, তেনজিং নোরগে ও এডমণ্ড হিলারি এভারেস্ট জয় করেন।
ফিরে আসি গণিতবিদ রাধানাথের কথায়। তিনি ছিলেন ডিরোজিওর ছাত্র। গণিতে বিশেষ প্রতিভাবান।
বিদ্যাসাগর মশায়েরও সাত বছর আগে, ১৮১৩ সালের অক্টোবর মাসে রাধানাথ শিকদার  জন্মেছিলেন। পিতার নাম তিতুরাম শিকদার। মায়ের নাম কি ছিল জানতে পারি নি।
১৮৩১ সালে তিনি সার্ভের কাজে যোগ দেন। মাসিক বেতন ছিল ত্রিশ টাকা। ১৮৫২ সালে বৈজ্ঞানিক গণনা করে জানান যে ১৫ নম্বর চূড়াটি সবার উপরে। মেপে দেখা গিয়েছিল তার উচ্চতা ২৯০০০ ফুট। কিন্তু এমন মাপ দেখলে লোকজন সন্দেহ করতে পারে ভেবে, সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ অ্যাণ্ড্রু ওয়া সিদ্ধান্ত নিলেন ওটা ২৯০০২ ফুট উঁচু।
সেই সময়ে সার্ভেয়র জেনারেল অফ ইণ্ডিয়া ছিলেন স্যার জর্জ এভারেস্ট ।  পরবর্তী সার্ভেয়র জেনারেল এর উদ্যোগে ১৮৬৫ সালে রয়্যাল জিওগ্রাফিক  সোসাইটি এই ১৫ নম্বর চূড়াটির নাম রাখেন এভারেস্ট। যদিও স্যার জর্জ এভারেস্ট  তাতে আপত্তি জানিয়েছিলেন।
১৮৭০ সালের ১৭ মে তারিখে হুগলীর চন্দননগরের গোদলপাড়ায় রাধানাথের মৃত্যু হয়।
১৯০২ সালে ১০ এপ্রিল তদানীন্তন ভারত সরকার একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে রাধানাথের অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এই সুযোগে আমি এভারেস্ট চূড়ার উচ্চতার প্রথম গণনাকারী জেমস নিকলসনকেও শ্রদ্ধা জানাতে কার্পণ্য করব না।
এভারেস্ট জয়ীদের তালিকায় জুনকো তাবেই একটি স্মরণীয় নাম। ছোটবেলায় নাম ছিল ইশিবাসি জুনকো। ১৯৭৫ সালে তিনি এভারেস্ট জয় করেন। জুনকো সারা বিশ্বে প্রথম মহিলা, যিনি এভারেস্ট বিজয়ী। তাঁর সাথে ছিলেন শেরপা আং শেরিং। জুনকো জাপানের মেয়ে।
১৯৩৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর তারিখে জন্মেছিলেন জুনকো। সাতাত্তর বৎসর বয়সে মারা যান।
জুনকো এভারেস্ট জয় করার সাথে আরও কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। সারা পৃথিবীর মহাদেশ গুলির প্রতিটির সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ জয়ের দুর্লভ কৃতিত্ব তাঁর।
এভারেস্ট জয়ী প্রথম ভারতীয় মেয়েটির কথা বাদ দিতে পারি না। নাম তাঁর বাচেন্দ্রি পাল। এখন তাঁর ৬৫ বছর বয়স। ১৯৫৪ সালের এই মে মাসেই ২৪ তারিখে জন্মেছিলেন। ২৩ মে ১৯৮৪ তারিখে ত্রিশ বৎসর বয়সে পৌঁছনোর আগের দিনটিতে তিনি এভারেস্ট শিখরে পদার্পণ করেন।
১১ ডিসেম্বর তারিখটি সারা পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস হিসেবে পালন করা হয়। পর্বতারোহণ সবচেয়ে দুরূহ ক্রীড়া গুলির সেরা বলে গণ‍্য হয়। শারীরিক সামর্থ্য তো বটেই, বুদ্ধিমত্তা, তৎপরতা, প্রত‍্যুৎপন্নমতিত্ব, ও পারস্পরিক সহযোগিতা, সর্বোপরি ধৈর্যশীল ও শান্ত মনের সঙ্গে দুর্জয় সাহসের মেলবন্ধন ঘটে এই ক্রীড়ায়। মনুষ্যত্বের তীব্র পরীক্ষায় সফল কি না, বোঝা যায়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।