• Uncategorized
  • 0

আজ আন্তর্জাতিক বাস্তুহারা দিবস – লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী।

জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।

যে হারিয়েছে ঘর – 

ছুটির দিনে যক্ষপুরীতে মদের গেলাস হাতে নিয়ে বসেছে ৪৭ ফ। কোনো একদিন সে নিজের গ্রামে নিজের জন্মভিটায় ছিল। যক্ষপুরীতে সুড়ঙ্গ কাটার মজুর হয়ে সস্ত্রীক চলে এসে সে একটা বিকৃত জীবনের ফাঁদে পড়ে গিয়েছে। সে বুঝতে পারে, গ্রামে সে ছিল মানুষ। আর যক্ষপুরীতে সর্দারদের লোভের দশ পঁচিশের জুয়োখেলায় সে একটা ঘুঁটি মাত্র।
বর্ণহিন্দু জমিদারের নানা রকম অত‍্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে কন‍্যা আমিনার হাত ধরে গফুর গ্রামত‍্যাগ করে চলে যায় চটকলে মজুর খাটতে। পিছনে ফেলে রেখে যায় তার স্বাধীন অস্তিত্ব।  আজ বাস্তুহারা  ছিন্নমূল মানুষের যন্ত্রণা উপলব্ধি করার দিন।
দেশে দেশে যুদ্ধ আর বিতর্কিত দেশভাগের কারণে বহু মানুষ পিতৃপুরুষের বাসভূমি থেকে উচ্ছিন্ন হয়েছে। দেশভাগের ফলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে উচ্ছেদ হয়ে কয়েক লক্ষ মানুষ ভারতে এসেছেন। পঞ্জাবেও এ ঘটনা ঘটেছে। বাস্তুহারা মানুষ শুধু বাসভূমি হারায় নি, লুঠেরার হাতে কপর্দকশূন‍্য হয়েছে। তার পরিবারের মেয়েরা ধর্ষিতা হয়েছে। অনাহারে আর রোগে সন্তানকে মরতে দেখেছে। মৃতদেহ কাঁধে তুলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে গিয়েছে সৎকারের জন‍্য। স্বাধীন দেশে উদ্বাস্তু ক‍্যাম্পেও মেয়েরা রেহাই পায়নি। সম্ভ্রম ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। অনেক মেয়ে অপমানের জ্বালায় আত্মহত্যা করেছে। অনেকেই মুখ বুজে বুকে গভীর কান্না নিয়ে অবাঞ্ছিত সন্তানের জন্ম দিয়েছে। তিব্বতে চৈনিক আগ্রাসনের সূত্রে ভারতের ধরমশালায় আশ্রয় নিয়েছেন দলাই লামা। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা বাসভূমি ফিরে পেতে চেয়ে আন্দোলন করেছেন। কাশ্মীরী পণ্ডিতেরা বিতাড়িত হয়েছেন। মরিচঝাঁপিতে উদ্বাস্তু মানুষের উপর অত‍্যাচার হয়েছে। প‍্যালেস্টাইনের মানুষ নিজেদের দেশ হারিয়েছেন। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের কষ্ট‌ও সভ‍্য মানুষকে ভাবিয়েছে।
দেশভাগ আর বাস্তু থেকে উৎখাত হওয়া মানুষের যন্ত্রণার কথা মনে পড়লে আমার মনের মধ্যে নীতা আর্তনাদ করতে থাকে, দাদা, আমি বাঁচতে চাই। সুপ্রিয়া চৌধুরীকে নীতা হয়ে চিৎকার করতে বলেন ঋত্বিক ঘটক।
রবীন্দ্রনাথ সুর হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছেন, গাইছেন, যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে। ভারতে ১৯৬০ সালে ১৪ এপ্রিল মুক্তি পেয়েছিল মেঘে ঢাকা তারা। শক্তিপদ রাজগুরুর মূল কাহিনী অবলম্বনে চিত্রনাট্য লিখে দিয়েছিলেন মৃণাল সেন। সুপ্রিয়া চৌধুরীর সঙ্গে অভিনয়ে ছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়, গীতা ঘটক, বিজন ভট্টাচার্য, নিরঞ্জন রায়, গীতা দে, জ্ঞানেশ মুখার্জি। সুর করেছিলেন বাহাদুর খান আর জ‍্যোতিরিন্দ্র মৈত্র। ক‍্যামেরায় দীনেন গুপ্ত ধরেছিলেন ১৩৪ মিনিটের ছবিটি। পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা পরিবারের শংকর, নীতা, গীতা, মন্টুর গল্প ফিল্মে কয়ে যেতে থাকেন ঋত্বিক ঘটক। প্রেম, ভালবাসা, বিশ্বাসহীনতা, স্বপ্নভঙ্গের গল্প বলতে বলতে তিনি নীতার জীবনটা দেখাতে থাকেন। নীতার যক্ষ্মা হয়েছিল। একটা অতলান্ত খাদের ধারে দাঁড়িয়ে তার বাঁচতে চাওয়ার হাহাকার শুনি।
১৫ এপ্রিল ১৯৪৫ সালে বারগেন বেলসেন কনসেনট্রেশন ক‍্যাম্প থেকে মুক্তি পেয়েছিল নেদারল্যান্ডসের কিছু মানুষ। পায় নি একটা মেয়ে। কেননা টাইফয়েডে মারা গিয়েছিল সে। বারোই জুন, ১৯৪২, আনা ফ্রাঙ্কের তেরোতম জন্মদিন ছিল। সে একটা অটোগ্রাফের খাতা উপহার পেয়েছিল সেই জন্মদিনে। বাবা অটো ফ্রাঙ্ক, মা এডিথ, দিদি মার্গটকে নিয়ে সুখের সংসার। বাবার ব‍্যবসা পেকটিন নিয়ে। ওই যে জিনিসটা জ‍্যাম জেলি বানাতে লাগে।
অ্যাডলফ হিটলার আর তাঁর নাৎসি বাহিনী যে সমস্ত দেশের মানুষের জীবন ধ্বংস করে দিয়েছিল, নেদারল্যান্ডস তার একটি। আনা ফ্রাঙ্কের দিদি একটা নোটিশ পেয়েছিল। তারপরই আত্মগোপন করতে বাধ‍্য হয় পরিবারটি। অটোগ্রাফের খাতায় সেই জীবনকে এঁকে চলেছিল সদ‍্যোকিশোরী আনা ফ্রাঙ্ক। মৃত্যুর পর সেই বছর ষোলোর কিশোরীর ডায়েরি উদ্ধার হয়। তার বাবার হাতে পৌঁছায়। ডাচ ভাষায় হেট আখটারহুইশ হয়ে ১৯৪৭এর জুনে প্রকাশ পায় আনা ফ্রাঙ্কের সেই ডায়েরি। ১৯৫২তে ইংরেজি ভাষায় দ‍্য ডায়েরি অফ আ ইয়াং গার্ল।
কিটি কে লিখে লিখে মনের কথা বলেছেন আনা। কিটি কে? কবি বলবেন, কে গো অন্তরতর সে?
সাদাত হাসান মান্টো গল্প বলেন তোবা টেক সিং। সাতচল্লিশ এর দেশবিভাগের দুই কি তিনবছর পর, যখন জেলে আটকে থাকা পাগলদের মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনার কথা ওঠে তখন কি কি হয়, তাই নিয়ে তোবা টেক সিং।
দেশে বিদেশে আমায় ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ান সৈয়দ মুজতবা আলী। কতো না ভাষা জানতেন তিনি। বাংলা তাঁর মাতৃভাষা। তার উপরে তিনি জানতেন ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, ইতালিয়ান, আরবী, ফারসি, উর্দূ, হিন্দি, সংস্কৃত, মরাঠি, গুজরাটি, পুশতু আর গ্রীক। ১৯৪৯ এ প্রকাশিত দেশে বিদেশে তে তিনি গল্প করেন আফগানিস্তানের  জলালাবাদ জেলের এক অদ্ভুত অভাবনীয় ঘটনার। সেখানে নিমলার বাগানে প্রহরীদের গাফিলতির সুযোগ নিয়ে এক বন্দী পালিয়ে যায়। তখন রাস্তার ধারে প্রাতঃকৃত‍্য করছিল এমন একটা সাধারণ লোককে ধরে নিয়ে গিয়ে সংখ্যা গুনতির হিসেব মিলিয়ে দেয় প্রহরীরা। নিরপরাধ লোকটা কিচ্ছুটি জানল না, কেন তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হল। তাকে প্রচণ্ড ভয় দেখিয়ে বলা হল ওপরওয়ালা যদি তার পরিচয় জানতে চায়, তখন সে যেন বলে “মা খু চিহল ও পঞ্জম হস্তম”। সোজা কথায়, আমি তো পঁয়তাল্লিশ নম্বরের। ভীষণ ভয়ে নিরপরাধ লোকটি নিজের পরিচয় ভুলে গেল। ষোল বছর পরে সে যখনো মনে করতে পারে, সূর্য পুব দিকে ওঠে, দুয়ে দুয়ে চার হয়, তখনো সে নিজের নামটুকু কিছুতেই মনে করতে পারে না। কেবল বলে, মা খু চিহল ও পঞ্জম হস্তম। আমি তো পঁয়তাল্লিশ নম্বরের। কী ভয়ঙ্কর আত্মবিলোপ!
ফেরায়াদুন  দেরাখশানি নিজের পিতৃদত্ত নাম বদলে নিজের পরিচয় রাখেন উদ্বাস্তু গণিতবিদ। কুর্দ ভাষায় কোচার বিরকার। কুর্দদের কোনো দেশ নেই। ইরাক ইরান সিরিয়া তুরস্ক জুড়ে  তারা ভয়াবহ সন্ত্রাস আর নিষ্পেষণের শিকার। ১৯৭৮ সালে জন্মে স্কুলে পড়তে পড়তেই ফেরায়াদুন দেরাখশানি টের পেয়ে গিয়েছিলেন নিজের ভিতরের অসামান্য প্রতিভাবান মানুষটিকে। পালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো পরিত্রাণ ছিল না তাঁর। নিজের গণিত সাধনা বাঁচাতে পালালেন। তারপর নটিংহ‍্যাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি, আর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ‍্যাপনা।
 ২০০০ সালে পালিয়ে ব্রিটেনে আসেন তিনি। ২০১৮ সালে সংখ‍্যাতত্ত্ব নিয়ে কাজ করে গণিতে সর্বোচ্চ পুরস্কার ফিল্ডস মেডেল প্রাপ্তি। ওকে ভালবেসে অনেকেই গণিতের নোবেল পুরস্কার বলেন। তিনি ঘরে ঝুলিয়ে রাখেন নাৎসী সন্ত্রাসের আরেকটি শিকার আলেকজান্ডার গ্রথেনদিয়েক এর ছবি। তিনিও স্মরণীয় গণিতবিদ।
 বাঙালি কবির লেখাতেও উদ্বাস্তু সমস্যা টুকি দিয়ে গিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন দুই বিঘা জমি। সে কবিতা বহুপঠিত, বহুচর্চিত। দেশের আইনকানুন বিদেশী সভ‍্য শাসনে ঠিক কি রকম ছিল দেখান জমিদার রবীন্দ্রনাথ। “এ জগতে হায় সেই বেশি চায়, আছে যার ভূরিভূরি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি”  এ কথাটা যেন প্রবাদ হয়ে গিয়েছে।
 প্রেমেন্দ্র মিত্র কবিতা লেখেন, ফ‍্যান।
 লেখেন,
একদিন এরা বুঝি চষেছিল মাটি
তারপর ভুলে গেছে পরিপাটি
কত-ধানে হয় কত চাল;
ভুলে গেছে লাঙলের হাল
কাঁধে তুলে নেওয়া যায়।
জয় গোস্বামী লেখেন আমরা তো অল্পে খুশি, নুন নামে বিখ‍্যাত কবিতা। লেখেন,
মাঝে মাঝে চলেও না দিন
বাড়ি ফিরি দুপুররাতে ;
খেতে বসে রাগ চড়ে যায়
নুন নেই ঠাণ্ডা ভাতে।
রাগ চড়ে মাথায় আমার
আমি তার মাথায় চড়ি,
বাপব্যাটা দুভায়ে মিলে
সারা পাড়া মাথায় করি।
করি তো কার তাতে কী?
আমরা তো সামান্য লোক।
আমাদের ভাতের পাতে
লবণের ব্যবস্থা হোক।
দেশভাগের কারণে মানুষ উদ্বাস্তু হয়। জাতিদাঙ্গার কারণেও হয়। একটি জাতি অন‍্য আরেকটি জাতির অস্তিত্ব বিলোপ করতে চায়। তথাকথিত উন্নয়নের স্টিম রোলারেও মানুষ ছিন্নমূল হয়ে বাপ পিতামহের জমিতে স্বাধীন নাগরিকের সম্মান থেকে উচ্ছেদ হয়ে পরিণত হয় বাস্তুহারায়। বৃহৎ নদীবাঁধ, তেজস্ক্রিয় রিয়‍্যাকটর, রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্র, বিপজ্জনক রাসায়নিক কারখানা বহু মানুষকে ছিন্নমূল করে। দায়িত্বজ্ঞানহীন অন‍্যায় আচরণে নিজের পায়ের তলায় মাটি, নিজের আজন্মলালিত স্বপ্নের বাসভূমি হারিয়েছেন যাঁরা, অকারণে যেসব নিরপরাধ মানুষ কারাগারে কনডেমনড সেলে আটকে আছেন যেসব মানুষ, এঁরা সবাই উদ্বাস্তু।  সভ‍্য মানুষের দায় এঁদের যন্ত্রণা উপলব্ধি করে মাথা নিচু করে প্রতিজ্ঞা করা, আর একজনকেও উদ্বাস্তু হতে দেব না।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।