• Uncategorized
  • 0

অণুগল্প ১ বৈশাখের বিশেষ সংখ্যায় সৌমিত্র চক্রবর্তী

ছোঁয়াচে

হতভম্ব হয়ে একদৃষ্টে মেসেজটার দিকে তাকিয়েছিল রণিত। সে কি পড়ছিল ওটা! কিন্তু আজ সকালে মেসেজটা আসার পরে অন্ততঃ শ খানেক বার সে এটা পড়েছে। আসলে মেসেজের অক্ষরগুলো সে দেখছিল কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছিল না। প্রত্যেক অক্ষর যেন আঙুল উঁচিয়ে তাকে বিদ্রুপ করছে।
আজ তেরদিন হয়ে গেল সে এই আইসোলেশন সেন্টারে আছে। প্রথম প্রথম বেশ অস্বস্তি হতো তার। এরকম একটা বিশাল হল ঘরের মধ্যে পরপর বেড, মাথার বালিশ চাদরের নীচে গোঁজা, চারদিকে কেমন আতঙ্কের গন্ধ। সে কখনো অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় নি। কখনো সখনো আত্মীয় বা পরিচিতদের দেখতে গেছে। কিন্তু সে সব নেহাতই সামাজিকতার খাতিরে। রণিত কোনদিন কল্পনাও করে নি তাকে এরকম পরিবেশে থাকতে হবে। প্রথম যখন এখানে তাকে নিয়ে এল সে অর্ধেক কাহিল মারা যাওয়ার ভয়ে, বাকি অর্ধেক অসুস্থতায়।
অথচ রণিতের এরকম হওয়ার কথা ছিল না। সে অসম্ভব সাবধানী। যেদিন থেকে লকডাউন হলো নেহাত প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যায় নি। গেলেও মাস্ক পরে বেরিয়েছে। বাড়িতে ফিরে সব দরকারি নির্দেশ পালন করে তবেই ঘরে ঢুকেছে। তাহলে সংক্রমণ হলো কিভাবে? ভাবতে ভাবতে এক সময়ে তার মাথায় চিড়িক মেরে ওঠে, এটিএম! টাকা তুলতে গিয়েই মারণ রোগ তার হাতে এসেছিল মনে হয়। তারপর বাজারে ঘুরেছে, জিনিস কিনে যখন বাড়ি ফিরেছে তখন তার শরীরের ভেতরে বাসা গড়তে শুরু করেছে সেই মাহামারক।
একটু সর্দির মত, মাঝেমধ্যে হাঁচি, খুকখুকে শুকনো কাশি থেকে হঠাৎ যখন তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হলো তখন রুনি ফোন করল হাসপাতালে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাড়া পুলিশে, অ্যাম্বুলেন্সে ছয়লাপ। একটা অ্যাম্বুলেন্সে তাকে চাপিয়ে হাসপাতালে আসার পরে পরপর সিনেমার স্লটের মত সবকিছু সরতে সরতে শেষে এখানে। তাও তেরদিন হয়ে গেল। ভিজিটে আসা ডাক্তারের কাছে শুনেছে সে ভালো হয়ে গেছে। আসলে তার সংক্রমণ খুবই কম মাত্রায় হয়েছিল বলে বেঁচে গেছে এ যাত্রায়। বাড়ির অন্যদেরও নাকি সরকারি কোয়ারান্টাইন হোমে রাখা হয়েছিল। তবে তাদের কিছু হয় নি। ওদের টেস্ট রিপোর্ট নেগেটিভ।
ভয়। আদিগন্ত বিস্তৃত ভয় চেপে বসেছে। এক দল ভয় তাড়াতে হাত পা ছুঁড়ে চিৎকার করে যাচ্ছে। ডাকছে অন্যদের। বলছে, “এস, দেখ, আমি ভয় পাই নি। তোমরাও এস। এস সবাই মিলে ভয় তাড়াই!” আরেক দল সব দেখছে, কিন্তু খুব সাবধানে। চুপিসারে অন্যদের কথা শুনছে, কিন্তু স্পিকটি নট। চোখ দুটো তাদের আধবোজা। যেন, “কই আমি তো কিছুই দেখিনি!” ওদের মাথার মধ্যে ভয় হুমকি দিচ্ছে অহরহ, “মাষ্টারমশাই আপনি কিছুই দেখেন নি!” তারা দেখছে কিন্তু দেখছে না। শুনছে কিন্তু শুনছে না। আর শেষের দল সত্যিই কিছু দেখছে না। তাদের দুটো চোখই প্লাস্টার অব প্যারিস দিয়ে আটকানো, পাছে কিছু দেখে ফেলে! আসলে কিন্তু এরা সবাই ভয় পাচ্ছে। এরা সবাই ভয় পেয়েছে। ভয়ের বীভৎস দাঁত থেকে কাচকাটা রক্ত ঝরছে এটা স্পষ্ট বুঝতে পেরে শামুকের খোলকে নিরাপদ আশ্রয় ভেবে সেখানে লুকানোর চেষ্টা করে চলেছে বিরাম হীন।
কাল চোদ্দোদিন হয়ে যাবে। কাল ছেড়ে দেবে ওদের। কিন্তু তাকে আরও কয়েকদিন এখানে কাটাতে হবে তারপর ছুটি। হাঁপিয়ে উঠেছে সে। প্রথম দিকে যখন অসুস্থ ছিল তখন চুপচাপ শুয়ে থাকত। সারা গায়ে যন্ত্রণা। অন্য কিছু ভাবতে গেলেই মনে হতো মৃত্যুর কথা। এই অসময়ে মারা গেলে রুনি আর বয়স্ক মা বাবার কি হবে এটা ভাবতে ভাবতে আরও অসুস্থ লাগত। কিন্তু আস্তে আস্তে যত ভালো হতে থাকল ততই এই একঘেয়ে জীবন তাকে অতিষ্ঠ করতে লাগলো। ভাগ্যিস আসার সময়ে মোবাইলটা সঙ্গে আনতে দিয়েছিল এরা। অনেকটা সময় এই মোবাইলই তার সঙ্গী।
যখন সুস্থ ছিল তখন অল্পস্বল্প লেখালেখি করত অবসর সময়ে। গল্প লিখতে ভালো লাগে তার। প্রথম প্রথম ফেসবুকে লিখত, তারপর আস্তে আস্তে পরিচিত হলো কিছু অনলাইন পত্রিকার সম্পাদকদের সঙ্গে। এরপর তারা লেখা চায়। অনেক সময় না চাইলেও পাঠায়। ওদের মেল আইডি তার মুখস্থ হয়ে গেছে।
ভালো হতে থাকার দিনগুলোতে আবার একটু একটু করে লেখা শুরু করেছে রণিত। ছোট ছোট কয়েকটা গল্প লিখে ফেলেছে এই কয়েকদিনে। তার একটা দিন তিনেক আগে পাঠিয়েছিল আমাদের অসময় নামে একটা ছোট ম্যাগাজিনে। অন্য সময় সে লেখা পাঠালেই সঙ্গে সঙ্গে লেখা পাওয়ার প্রত্যুত্তর আসত। কিন্তু এবার কিছুই এল না। দু দিন কেটে যাওয়ার পরে সে বেশ অবাক হয়ে ফোন করেছিল সেই সম্পাদককে। কিন্তু ফোনের অপর প্রান্তে কেবল রিং বেজেই গেছিল। কেউ ফোন তোলেনি।
হঠাৎই মনে পড়েছিল ওই সম্পাদকের পাড়াতেই থাকে সুজিত। কাল তাকে ফোন করে একবার খবর নেবার জন্যে অনুরোধ করেছিল সে। তার উত্তরেই আজ সকালে সেই সম্পাদকের সঙ্গে কথোপকথনের স্ক্রিনশট হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছে সুজিত। থ হয়ে বারবার সেই মেসেজটাই দেখে যাচ্ছে রণিত। এরা সম্পাদনা করে! এরা শিক্ষিত বলে নিজেদের! কিছু বুঝতে পারছে না সে।
সুজিত লেখাটার ব্যাপারে জানতে চাওয়ায় উত্তরে সেই সম্পাদক জানিয়েছে –
“দেখুন এটা একটা নতুন রোগ। কেউই এর সম্পর্কে জানে না। আপনি বলছেন বটে যে রণিতবাবু ভালো হয়ে গেছেন, কিন্তু সেটা যে ঠিক এটা কোনো বিজ্ঞানী সার্টিফাই করেছেন কি? তাছাড়া ওই মারাত্মক রোগের জীবাণু যে ঈথারের মধ্যে দিয়ে এসে মেল কিম্বা আমার মোবাইলের মধ্যে ঢুকবে না তার কি গ্যারান্টি আছে? না না ওনার পাঠানো মেল কিম্বা ফোন রিসিভ করে আমি বিপদে পড়তে রাজি নই। আমি তো বলব রণিতবাবুকে পাড়াতে ঢুকতে দেওয়া উচিৎ নয়। আমাকে ফোন করতে নিষেধ করবেন। আর লেখা পাঠানোর দরকার নেই।”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।