• Uncategorized
  • 0

অণুগল্প ১ বৈশাখের বিশেষ সংখ্যায় দিবাকর মণ্ডল

বিশ্বাস ভঙ্গ

আজ রাখাইনের আকাশে নিকষ কালো রাত নেমে এসেছে। চারিদিক শুনশান–শ্মশানের নিরবতা। কারা যেন এই অন্ধকার সময়ে বিদ্যুতের তার কেটে নিয়ে চলে গেছে। আকাশে ঘন মেঘের আনাগোনা। থেকে থেকে বিদ্যুতের বিজলানীতে রহমত পরিস্কার ঠাওর করল একটা কালো রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে। মনে তার একটা উৎসুক‍্যের শিহরণ খেলে গেল। তার পিঠে একটা বোঁচকা।
দূরে মহল্লার ছবিটা আরও অন্ধকার–নিকষ কালো। কারা যেন মহল্লা লুঠ করে চলে গেছে রাতের আঁধারে। মুখ তাদের কালো কাপড়ে ঢাকা, হাতে শানিত কৃপান।কারা যেন হিংস্র শ্বাপদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে মহল্লায়–ধরা‌লো আগুন, রাতের বিভীষিকাকে ছাড়িয়ে গেল তার স্ত্রী-পুত্র-পরিবার,—তার মা বাবার আর্তনাদে। সেই রাতের আঁধারে কে কোথায় যে চলে গেল, আর চিন্তা করতে পারে না রহমত। রাত্রির বিভৎসতা আর নৃশংসতা তার মগজে কিলবিল করতে থাকে। মানুষ যে এত হিংস্র আর ভয়ংকর হয়, তা কল্পনার অতীত ছিল রহমতের এতদিন।
রহমত ভাবে, এই দেশ তার মাতৃভূমি, তার পিতৃপুরুষের ভিটে। এই দেশের মাটিতে কবরে শায়িত আছে তার পিতৃপুরুষেরা। এই যে নাফনদী , তার পানিতে সে ওজু করে। এখানকার পাহাড়-পর্বত-নদ-নদী-মাঠ-ঘাটের সাথে তার এতদিনের মায়ার বাঁধন। অথচ আল্লার কি খোয়াব যে তাকে, এই দেশ এই গেরস্থালি ছেড়ে চলে যেতে হবে বিদেশ বিভূঁই-এ।
দিনকয়েক আগে থেকেই গতিক যে ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে তা মালুম করে রহমত। নিত্য নতুন সংবাদ আসে। কোথায় যেন মসজিদকে ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেদিন নদীর ঘাটে গোসলের সময় রহমত উপলব্ধি করে যে অবস্থা বেগতিক। নদীতে গোসল করছিল কতকগুলো সংখ্যাগুরু মানুষ। জনান্তিকের কথাগুলো তার কানে গেল। লোকগুলোর বক্তব্য ছিল এইরকম: মসজিদ তো ভাঙা হোল। বেশ হয়েছে। এরপর রহিমা বিবিকে কে আটকায় দেখতে চাই। শালীকে টেনে রাস্তায় নামাব। তোবা, তোবা বলে বসে পড়েছিল রহমত। বাড়িতে এসে সে আল্লার কসম খেয়ে জবান দেয় যে, খোদার রাজ‍্য প্রতিষ্ঠা না করলে সে আর ফিরবে না। রহিমা কত বুঝিয়ে ছিল, রহমত কানে তোলে নি সে কথা। বলেছিল: যদি খোদা মেহেরবানী করে তবে সে ফিরবে। দেশ আজাদী পেলে আবার তাদের মোলাকাত হবে—নয়তো বেহেশতে।
এইভাবে কতক্ষণ যে পার হয়ে গেল ঝোপটার কাছে অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে। তারপর তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল কান্ডকারখানা দেখে। দেখলো একটা কালো রঙের জিপসি এসে দাঁড়ালো সেই কালো গাড়িটার এক্কেবারে মুখোমুখি। ও তো খাদেম মৌলনার গাড়ি!রহমতের মনে বিস্ময়। খাদেম মৌলনাই তো তাদের মহল্লায় জিগির তুলে বলেছে, দার উল ইসলাম—খেলাফতের দুনিয়া চাই। রহমত চোখ দুটো কচলালো। ভুল দেখছে না তো সে। আরে, ঐ ঐতো স্বামী খটখটানন্দ। গেরুয়া পরা যে লোকটা তাদের বিরুদ্ধে উস্কানি দাতা। রহমত পরিষ্কার দেখতে পেল, কালো জোব্বা পরা খাদেম মৌলনা খটখটানন্দের সাথে হাত মেলালো। খটখটানন্দ জিজ্ঞেস করলো: কেল্লা ফতে।
মৌলনা ঘাড় নেড়ে বললো: জি হাঁ।
তারপর ঘুটঘুটানন্দ মৌলনাকে একটা সুটকেস এগিয়ে দিল। রহমতের ভুল ভাঙতে দেরি হলো না। এক ভয়ংকর আক্রোশে তার গা রি-রি করতে লাগলো। “তবে রে ” বলে রহমত চিৎকার করে উঠতেই এক অদৃশ্য আগুনপাখি রহমতের বক্ষ বিদীর্ণ করে চলে গেল। শুধু “আল্লাহ” বলে একটি অস্ফুট ধ্বনিতে নাফ নদীর তীরে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এলো।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।