Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

ভ্রমণে রোমাঞ্চ ধারাবাহিকে সমীরণ সরকার (পর্ব - ১৯)

maro news
ভ্রমণে রোমাঞ্চ ধারাবাহিকে সমীরণ সরকার (পর্ব - ১৯)

তীর্থভূমি বীরভূম, ভ্রমণ তীর্থ বীরভূম

ড. হিতেশ রঞ্জন সান্যাল এক সময় মন্তব্য করেছিলেন, " আঞ্চলিক বঙ্গীয় স্থাপত্যালংকারের মূল নকশা এসেছিল পশ্চিম এশিয়া থেকে। তবে বাংলার শিল্পীদের হাতে তার আঙ্গিক অনেকটা বদলে যায়। পশ্চিম এশীয় উপাদানের সঙ্গে বাংলায় প্রচলিত ফুল, লতা, পাতা, ছত্রাবলী, কল্পতরু প্রভৃতি ধর্মীয় প্রতীক মিলিয়ে নতুন নকশা তৈরি হয়েছিল। মৃৎভাস্কর্যে এই নবোদ্ভূত আঙ্গিক ও রূপের বিশেষ সমৃদ্ধি হয় পঞ্চদশ ষোড়শ শতকের আঞ্চলিক বঙ্গীয় মুসলিম স্থাপত্যালঙ্কারে। এই মিশ্র স্থাপত্যালংকারের সতেজ স্বচ্ছন্দ্য ভাব ও প্রযুজ্যমানভঙ্গি চোখে পড়ে।' কিন্তু ডঃ সান্যালের এই মতের সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই। মন্দির স্থাপত্য রীতি যেমন মুসলিম স্থাপত্য শিল্পকে অনুসরণ করেনি, ঠিক তেমনি বলা যায় যে, মন্দির অলংকরণেও প্রাচীন ঐতিহ্যকে অনুসরণ করা হয়েছিল। মন্দির অলংকরণের আলোচনার সুবিধার্থে যে সকল মন্দিরের গায়ে প্রতিষ্ঠালিপি লেখা আছে, সেগুলোকে ইতিহাসের কালক্রমানুসারে সাজালে মৃৎভাস্কর্যের পর্যালোচনা করা যায়। মধ্যযুগের রাঢ় জনপদে প্রথম নির্মাণের কথা জানা যায় বর্ধমান জেলার বরাকরে প্রস্তর নির্মিত মন্দির দুটির নিদর্শন থেকে। উক্ত মন্দির দুটির গায়ে খোদিত প্রতিষ্ঠা লিপি থেকে জানা যায় যে ১৪৬১ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল। পঞ্চদশ শতকের প্রায় অন্তিম পর্বে ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দে ঘাটালের সিংহবাহিনীর মন্দির এবং 14 98 খ্রিস্টাব্দে কুলিনগ্রামের শিব মন্দির তৈরি হয়েছিল‌। অতঃপর ষোড়শ শতক থেকে বাংলারীতি মন্দির তৈরির জয়যাত্রা শুরু, শুরু হয়েছিল টেরাকোটা ভাস্কর্যের বিবর্তন। বাংলাদেশের দেব বংশীয় রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ময়নামতীতে টেরাকোটা শিল্পের কিছু নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছিল। এছাড়া সাত দেউলিয়ার জৈন মন্দিরে, তেলকূপী, ডিহর,বোরাম প্রভৃতি মন্দিরে টেরাকোটার অলংকরণ দেখা যায়। বাংলার প্রাণবন্ত টেরাকোটা শিল্পের সম্ভাবনা তুর্কি পাঠান শাসনকালে বিনষ্ট হয়েছিল। একাদশ দ্বাদশ শতকে রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় নবদ্বীপের নিকটে ধ্বংসপ্রাপ্ত বল্লালঢিবির শিখরদেউল, সুন্দরবনের জটার দেউল, বীরভূমের জয়দেব-কেন্দুলির সন্নিকটে বর্ধমানের সীমান্তে অবস্থিত ইছাই ঘোষের দেউল নির্মাণের পরে মন্দির নির্মাণের কোন নিদর্শন পাওয়া যায়নি। উপরন্তু ত্রয়োদশ চতুর্দশ শতকে বহু মন্দির ধ্বংস করে সেই উপাদানে মসজিদ মাজার ইত্যাদি নির্মিত হয়েছিল। নতুনহাটের হোসেন শাহী মসজিদ ,সিয়ান গ্রামের খানকাহ, ত্রিবেণীর জাফর খানের সমাধিগৃহে হিন্দু মন্দিরের ভাস্কর্য ফলকের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রায় ৩০০ বছর ধরে এদেশে মন্দির নির্মাণ ও টেরাকোটা অলংকরণের কোন নিদর্শন পাওয়া যায়নি। বিংশ শতকের ষাটের দশক থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজ্য পুরাতত্ত্ব অধিকার, ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ ও আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অনুসন্ধান উৎখননকার্য শুরু করার ফলে অন্যান্য প্রত্নবস্তুর সঙ্গে পোড়ামাটির শিল্পসমূহ লোকচক্ষুর সামনে এসেছে। মৃৎশিল্প প্রসঙ্গের আলোচনায় জানা গেছে যে, রাঙ্গামাটি,, মঙ্গলকোট, তমলুক, দেউলপোতা ,ফারাক্কা, চন্দ্রকেতুগড় প্রভৃতি স্থানে প্রাপ্ত পোড়ামাটির ফলক ও মূর্তি সমূহের অধিকাংশই হল প্রাক গুপ্ত অথবা গুপ্ত আমলে। পাল -সেন আমল ও তারপরে নির্মিত মৃৎভাস্কর্য ও মন্দির ভাস্কর্যে প্রাচীন শিল্পধারার স্থানীয় রূপ প্রতিফলিত হয়েছে। ডেভিড ম্যাককাচনের মতে,'১৬শ শতকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের মন্দির নির্মাণে এক পুনর্জাগরণ আসে ।যার ফলে স্থাপত্যের আকৃতি ও পোড়ামাটির অলঙ্করণে নতুন উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা যায়, যা ইংরেজ আমলেও অনেকদিন পর্যন্ত হ্রাস পায়নি। এই স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের উদ্ভাবনী রূপ, গুণ, প্রাণপ্রাচুর্য, গার্হস্থ্য রূপ এবং লোকশিল্পের নিকটবর্তী হওয়ার জন্য পূর্বেকার পাল -সেন অভিজাত রীতি থেকে আলাদা করে বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত করতে হয়।' তবে বাংলায় নবপর্যায়ে নির্মিত প্রথম দিকের ভাস্কর্য ফলক গুলিতে দেখা যায়, জ্যামিতিক ও ফুলকারি নকশাই প্রাধান্য পেয়েছে। খ্রিস্টীয় ১৭ শতক থেকে দেখা যায়, মন্দির সজ্জায় ফুল লতাপাতার নকশার সঙ্গে খোদিত হয়েছে পশুপাখি, মানুষ ও বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি ফলক। এই সময়ের খোদিত মূর্তিগুলি উন্নত এবং বেশ গভীর করে কাটা। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলি বর্তুলাকার এবং মুখগুলি সাধারণত পাশ থেকে দেখানো। ১৮ শতকের মন্দির অলঙ্করণ গুলিতে দেখা যায় যে, গ্রামীণ শিল্পীদের হাতে পড়ে টেরাকোটা ভাস্কর্য গুলির নিজস্ব এক শৈলির উদ্ভব হয়েছে। শিল্পীরা ছিলেন গ্রামের মানুষ এবং স্থানীয় জীবনযাত্রার মধ্যে আবদ্ধ। এই সময়ে গ্রাম সমাজে শ্রীকৃষ্ণের লীলা কীর্তন, পুরাণ, রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে কথকতা, শ্রীমদ্ভাগবত পাঠ ইত্যাদি মূল্যবোধের যে আদর্শ সাধারণ মানুষের মনে প্রভাব ফেলত, শিল্পীরা ফলক অলংকরণের মধ্যে সেই নৈতিক ও আধ্যাত্মিক আদর্শ এবং চলমান সমাজ জীবনের পারিপার্শ্বিক ঘটনাসমূহ কে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

চলবে

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register