Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

ভ্রমণে রোমাঞ্চ ধারাবাহিকে সমীরণ সরকার (পর্ব - ১৮)

maro news
ভ্রমণে রোমাঞ্চ ধারাবাহিকে সমীরণ সরকার (পর্ব - ১৮)

তীর্থভূমি বীরভূম, ভ্রমণ তীর্থ বীরভূম

নব পর্যায়ে মন্দির নির্মাণের ক্ষেত্রে টেরাকোটা শিল্পের উদ্ভাবন ও বিকাশের কাল হিসাবে ষোড়শ শতক এবং সপ্তদশ শতককে চিহ্নিত করা হয় । সপ্তদশ শতকে শিল্পীরা মুষ্টিমেয় কয়েকটি দেবদেবীর রূপকল্পনাকে সম্বল করে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে অপূর্ব টেরাকোটার ভাস্কর্য সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিল। ওই সমস্ত পোড়ামাটির ভাস্কর্য প্রস্তর ভাস্কর্য অপেক্ষা কোন অংশে কম ছিল না। অনেকেই মনে করেন যে, মৃৎশিল্পীরা অধিকাংশ টেরাকোটা ভাস্কর্য গুলি হাতে তৈরি করেছেন। কিন্তু চন্দ্রকেতুগড় ও তমলুকে প্রাপ্ত টেরাকোটা ফলক গুলির কিছু হাতে তৈরি হলেও অধিকাংশ ছাঁচে তৈরি। পার্সি ব্রাউন' ইন্ডিয়ান আর্কিটেকচার' গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, টেরাকোটা মূর্তি গুলি ভাস্কর্য পদ্ধতিতে কুঁদে তৈরি করার রীতি ছিল। কিন্তু মন্দির স্থাপত্য ও ভাস্কর্য বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী এই ধারণা ভ্রান্ত। কারণ বাংলায় ছাঁচে ফেলে খেলনা পুতুল ইত্যাদি তৈরি করার প্রথা অতি প্রাচীন। বাংলার কুম্ভকার বা মৃৎশিল্পীরা যে অতি প্রাচীন আমল থেকে সেই পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বহু যুগ ধরে চলে আসা এই পদ্ধতিকে পরিহার করে তারা কেন অহেতুক মৃৎশিল্পকে ভাস্কর্য পদ্ধতিতে কুঁদে তৈরি করতে যাবেন, এর উত্তর মেলেনা। তাছাড়া বাংলার অনেক মন্দিরেই দেখা যায় যে, হুবহু একই ধরনের দেখতে বা একই নকশা সম্বলিত অনেকগুলি টেরাকোটার ফলক আছে। কেবলমাত্র ছাঁচের সাহায্যেই এরকম এক ধরনের অনেকগুলি টেরাকোটা টালি সহজে তৈরি করা সম্ভব। কারণ তক্ষণ পদ্ধতির সাহায্য নিলে এতগুলি একই ধরনের টেরাকোটার টালি নির্মাণ করা দুরূহ। তবে কয়েকটি সীমিত সংখ্যক বিশেষ চিত্র তীক্ষ্ণ নরুন বা বাটালির সাহায্যে বা রিলিফ পদ্ধতিতে তৈরি হলেও কাঠের ছাঁচে নির্মিত টেরাকোটা ফলক ব্যবহারের সংখ্যাই অধিক। মন্দির স্থাপত্য বিশেষজ্ঞ প্রয়াত তারাপদ সাঁতরা মহাশয় একই মত পোষণ করেন। তাঁর মতে বিশেষ ক্ষেত্র ব্যতীত অধিকাংশ ফলক ছাঁচেই নির্মিত হয়েছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি প্রত্নতত্ত্ববিদগণ এমনও মনে করেন যে হরপ্পা সংস্কৃতিতে টেরাকোটা অলঙ্করণে ছাঁচের ব্যবহার ছিল। টেরাকোটা ফলকগুলি দীর্ঘস্থায়ী সংরক্ষণের জন্য শিল্পীরা দেশীয় প্রথায় গাছের ডালে প্রতিপালিত লাক্ষা কীটের নিঃসৃত লালা থেকে প্রাপ্ত অশোধিত লাক্ষিক মামড়ি গরম জলে সেদ্ধ করে লাল বর্ণের যে দ্রবণ পাওয়া যেত, তার প্রলেপ দিত পোড়ামাটির ফলকে। আর সেই কারণেই বোধ হয় ফলক গুলির গায়ে লাল বর্ণের আভাস আজও লক্ষ্য করা যায়। বীরভূম জেলার রামপুরহাটের পশ্চিমে লালপাহাড়ি নামে একটি নাতি উচ্চ পাহাড় ফুল পাথর বা গিরিপাথর নামে লালচে রঙের নরম পাথর সহজে পাওয়া যায় বলে, মন্দির স্থপতিরা সেই পাথরের উপরে ভাস্কর্য খোদাই করে বীরভূম জেলার বহু মন্দির অলঙ্কৃত করেছেন। এই পাথরের নির্মিত ভাস্কর্য গুলি পোড়ামাটির ফলকের অনুরূপ। টেরাকোটার টালি বা ভাস্কর্য ফলক তৈরি হতো কাঁচা ইটের উপরে খোদাই করে এবং পরে সেটাকে পুড়িয়ে। অন্যদিকে ফুল পাথরের ক্ষেত্রে সরাসরি পরিমাপমতো নরম পাথরের ফলক গুলিকে জলে ভিজিয়ে তার উপরে খোদাই করা হত। দুটি ক্ষেত্রে মাধ্যম আলাদা হলেও নির্মাণ শৈলী সমগোত্রীয়। দুটি পদ্ধতিতে টেরাকোটা ভাস্কর্য খোদাই করা হত,যথা, অগভীর পদ্ধতি ও গভীর খোদাই পদ্ধতি। মূর্তি বা পুতুল তৈরির ক্ষেত্রে গভীর খোদাই পদ্ধতি অনুসরণ করা হত। কিন্তু মন্দিরে নিবদ্ধ টালিগুলির অধিকাংশই ঈষদুন্নত পদ্ধতিতে খোদাই করে তৈরি হত। ত্রয়োদশ ,চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে মন্দির প্রতিষ্ঠা বন্ধ হয়ে গেলেও শিল্পীদের কলা কৌশলের গোষ্ঠীগত ঐতিহ্য বিনষ্ট হয়নি। এমনকি সুলতানি আমলেও প্রাচীন ধারাকে অনুসরণ করে ইসলামী নকশা কলা বিশেষভাবে সাফল্য লাভ করেছিল। নবপর্যায়ে মন্দির নির্মাণের প্রাথমিক পর্বে টেরাকোটা শিল্পের বৈশিষ্ট্য ছিল নকশা অলংকরণ। নানা ধরনের ফুল ,লতাপাতা, প্রস্ফুটিত পদ্ম বিচিত্র ধরনের একক বা জারণ সংখ্যা মকর ও নানা প্রকার বৈচিত্র পুরো জ্যামিতিক নকশা ইত্যাদি বিন্যাস করে টেরাকোটা শিল্পীরা মন্দির গাত্রকে আকর্ষণীয় গড়ে তুলতে সাহায্য করেছেন। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে পাল- সেন আমল পর্যন্ত রাঢ়ে মৃৎপাত্র, পোড়ামাটির অলংকরণ, মন্দির অলংকরণ ইত্যাদি যে অব্যাহত ছিল তা পরবর্তীকালে আবিষ্কৃত প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে বোঝা যায়।

ফুল পাথরের মত হুবহু টেরাকোটা ভাস্কর্যের অনুকরণে মুগনী( ক্লোরাইট) পাথরের উপর খোদাই ফলকও কিছু কিছু মন্দিরে দেখতে পাওয়া যায়। এগুলি হুগলি এবং বাঁকুড়া জেলায় দেখতে পাওয়া গেলেও বীরভূমে চোখে পড়েনি। টেরাকোটা, পাথরের অলংকরণ ছাড়া বিভিন্ন মন্দিরে পঙ্খ- ভাস্কর্যের কাজও চোখে পড়ে। জোংড়া বা বাখারি চুনের সঙ্গে বালির এবং অন্যান্য দ্রব্য মিশ্রিত একটি পলেস্তারা মন্দিরের দেয়ালে দিয়ে যেভাবে নকশা কেটে অলংকরণ করা হতো,তাও অপূর্ব দৃষ্টিনন্দন। বহু মন্দিরে পোড়ামাটির শৈল্পিক নিদর্শন এর পাশাপাশি পঙ্খের কাজ করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষত রাঢ় অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা উনিশ শতকের অজস্র মন্দিরে টেরাকোটা সজ্জা এবং পঙ্খের কাজ উপস্থিত।

চলবে

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register