Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

T3 || সমবেত চিৎকার || 26য় রাজশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

maro news
T3 || সমবেত চিৎকার || 26য় রাজশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

দেবীত্বের আড়ালে

আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেঁজে উঠেছে আলোক মঞ্জিল, ধরনীর বর্হিআকাশে-অন্তরিত মেঘমালা, প্রকৃতির অন্তর আকাশে জাগরিত জোর্তিময়ী জগত্‍মাতার আগমন বার্তা, আনন্দময়ী মহামায়ার পদ্ধধ্বনি অসিম ছন্দে বেজে উঠে রূপলোক ও রসলোকে আনে নবভাব মাধুরীর সঞ্জিবন, তাই আনন্দিতা শামলী মাতৃকার চিন্ময়ীকে-মৃন্ময়ীতে আবাহন ......... ছোট থেকে মহালয়ার দিন ভোর হত শ্রী বিরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের এই উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে ৷ টিভিতে মহালয়া শুরু হওয়ার পরও মা ভোররাতে রেডিওটাই চালাত ৷ আমিও তাতে কোনদিন আপত্তি করিনি ৷ এই মন্ত্র উচ্চারণের সাথে সাথে চারিদিক থেকে কেমন চন্দন , ধূপ , আতপচালের গন্ধ ভেসে আসত ৷ পেঁজা তুলোর মত মেঘ আকাশে উড়ত ৷ কাশ ফুল দুলে উঠত ৷ ঢাকের শব্দ শুনতে পেতাম ৷ মায়ের কাছে শুনেছি এরপরই দেবীপক্ষ শুরু হয় ৷ শাস্ত্রমতে মহালয়া হচ্ছে একটি অমাবস্যা তিথি,এ তিথিতে সাধারনত পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ তর্পণ করা হয়। এ দিন তর্পণ করলে পিতৃপুরুষরা নরক যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেয়ে আমাদের আশীর্বাদ প্রদান করেন। এছাড়া মহালয়ার দিনে দেবী দুর্গার বোধন করা হয়,বোধন অর্থ জাগরণ। তাই মহালয়ার পর দেবীপক্ষের/শুক্লপক্ষের প্রতিপদে ঘট বসিয়ে শারদীয় দুর্গাপূজার সুচনা করা হয়। শ্রাবন থেকে পৌষ ছয় মাস দক্ষিনায়ণ,দক্ষিণায়ণ দেবতাদের ঘুমের কাল। তাই বোধন করে দেবতাদের জাগ্রত করা হয়। মহালয়ার পর প্রতিপদে যে বোধন হয় সে সময় সংকল্প করে দুর্গাপূজার আয়োজন চলে। একে বলে কল্পরম্ভা, যদিও ষষ্ঠি থেকে পূজার প্রধান কার্যক্রম শুরু হয় তাই বলা হয় ষষ্ঠাদিকল্পরম্ভা। এবং সপ্তমী থেকে বিগ্রহতে। প্রতিপদ থেকে শুধু ঘটে পূজো ও চন্ডী পাঠ চলে।

দেবী দুর্গা যেন নারী শক্তির দ্যোতনা ৷ দশ হাতে দশ প্রহরণ ,সমস্ত কু - কে পরাস্ত করে সু- এর বিজয় ৷ এই কথা শুনতে শনতে কেটে গেল অনেকগুলো বছর ৷ কথাগুলো একই রয়ে গেল বদলে গেল চারপাশটা ৷ মানুষের জীবন যাপন , পোষাক , আদব কায়দা , যোগাযোগ , সংস্কৃতি , ভাষা , খাদ্য , বদলে গেছে আমূল ৷ শুধু বদলায়নি নারীকে ভোগ্য পণ্য হিসাবে মূল্যায়ন করার ইতর মানসিকতা ৷ দেবী দশভুজা নাকি নারী শক্তির প্রতীক ৷ মহালয়ার দিন প্রাতে আমরা দেবী দশভুজার মহিষাসুরমর্দিনী হয়ে ওঠার কাহিনী শুনি ভক্তি নিমীলিত চক্ষে ৷ এই যে নারী ভুলেও নিজেকে দেবী হিসাবে কল্পনা করো না ! যখন দেবীর আরাধনায় গদগদ তখন মনে পড়ে না তোমার ,প্রতিদিন ট্রেনে , বাসে , রাস্তায় , মলে নারী লাঞ্ছিত হচ্ছে , ধর্ষিত হচ্ছে অহরহ ! দেবী টেবী কিচ্ছু নয় , দাসী নারীর পরিচয় ৷ নির্ভয়া , আসিফা , সুডেন জর্ডন আরও কত নাম , ভুলে গেলে নাকি এত তাড়াতাড়ি ! অফিসে বা কর্মস্থলে মেয়েদের যৌন হেনস্থার সুরাহা করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট আদেশ দিয়েছে, সর্বত্র গ্রিভান্স সেল রাখতে হবে। সুখের কথা, এই চল্লিশ বছরে আমাদের মেয়েরা মহাকাশে গেছে, অলিম্পিকে পদক জয় করেছে, শিল্পপতি হিসেবে সফল হয়েছে, রাজনীতির অঙ্গনে পুরুষ অভিভাবকের পরিচয় ছাড়াই নিজেদের দৃঢ পা রেখেছে। শিল্পে-সঙ্গীতে-অভিনয়ে-সিনেমা পরিচালনায়-ভাস্কর্য-চিত্রকলায়-নাটকে-চিকিৎসা বিজ্ঞানে-গবেষণায় সর্বত্র সাফল্যের সঙ্গে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে। যে সব বৃত্তি বা কাজের ক্ষেত্র ছিল সম্পূর্ণ ভাবে পুরুষের ময়দান, সেখানেও দক্ষতার সঙ্গে মেয়েরা দাপট রেখেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সমাজের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাল কোথায় ?

একজন নারী প্রতিদিন রান্না করা ,ঘর গোছান , বাচ্চার দেখাশোনা , তার হোমটাস্ক করান , পরিবারের সকলের দেখভাল , ইলেকট্রিক বিল জমা দেওয়া , আত্মীয়স্বজনদের সাথে লোকলৌকতা পালন , বাড়ির পূজা অর্চনায় সকলের হয়ে উপবাস করা ,বাজার করা , স্বামীর সেবা করে তাকে সন্তুষ্ট রাখা , এত কাজ সামলে কেউ কেউ আবার চাকরিরতা ৷ তাতেও রক্ষে নেই , পরীক্ষা দিতে হয় সতীত্বের ৷ এই পরখ করে নেওয়ার সিদ্ধান্তও কিন্তু পুরুষের ৷ নারী তোমার কোন মন , মনন , চিন্তন , সম্মান কিচ্ছু থাকতে নেই , পুরুষের কাছে তুমি শুধুমাত্র একটা শরীর বই আর কিছু্ না ! কাম চরিতার্থ করার আধার , প্রজননের যন্ত্র মাত্র ৷ আর তুমি ,ঐ এক দশভুজা নামের প্রতি যে কী লোভ তোমার , তাই তোমার জন্য এই ব্যাবস্হাই বরাদ্দ ৷ আসলে এইসব বড় সুচতুর কৌশলে দশভুজার লেবেল সেঁটে তোমার মাথাটাকে ঘুরিয়ে দেওয়া৷

এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ দেবী দশভুজাকেই বা স্বয়ম্ভূ হতে দিলেন কোথায় ? তাঁর সৃষ্টি ত্বত্তেও যে পুরুষেরাই স্রস্টা ৷ সেই যে ,মহাদেব দিলেন ত্রিশূল , যম দিলেন কালদন্ড , ইন্দ্র দিলেন বজ্র , বিষ্ণু দিলেন চক্র , আরও কতজন কত কিছু দিলেন ৷ ঐ একই ধারণা কপি পেস্ট করেছে পুরুষ তোমাদের ক্ষেত্রেও , বুজলে হে -সংসারের আম দশভুজারা ! বড় রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ে , উনিই যে আমাদের সকলের একমাএ আশ্রয় - " শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী/পুরুষ রচেছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি ! "

মধ্যা কথা নারীকে দেবী টেবী বলে যতই অভিহিত করা হোক না কেন , সমাজের চোখে নারী , শরীর বই আর কিছু নয় ৷ দেবীত্ব হল সেটাই যেটা পুরুষ বা পুরুষতন্ত্রকে খুশী রাখে ৷ প্রাপ্তি এটাই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ এবং সবচেয়ে ন্যাক্কার জনক ঘটনাগুল বা অত্যাচারগুল যেমন এই সময়েই ঘটেছে , তেমনই আবার এর বিরুদ্ধে শক্তিশালী জনমতও গড়ে উঠেছে ইদানিং কালেই ৷ পুরুষতন্ত্র বিরোধী আধুনিক ভাবনা ও দর্শন অবশ্যই এক ইতিবাচক দিক , এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনাও বটে ৷ যাতে বহু সংস্কার মুক্ত , উৎকৃষ্ট মানসিকতার পুরুষও সামিল আজ ৷ এমন পুরুষতন্ত্র বিরোধী আধুনিক ভাবনা এবং দর্শন , নারীর জন্য টাটকা বাতাস বয়ে আনবে , তখনই একমাএ নারী মর্যাদা নিয়ে মাথা তুলে বাঁচতে পারবে অদূর ভবিষ্যতে ৷

সেই দিন কি দেখে যেতে পারব জীবদ্দশায় , যেদিন আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেঁজে উঠলে আলোক মনঞ্জিল ,শুধুমাত্র উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য নয় , সত্যিকারের অন্তরের বিশ্বাস , শ্রদ্ধা , ভক্তি থেকে দেবীর আরাধনা করবে মানুষ ! আগে নারী হিসেবে মর্যাদা আদায় করে নাও - নারী , দেবীত্ব তো একটা তকমা মাত্র ৷

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register