Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাহিত্য হৈচৈ তে সুব্রত সরকার

maro news
সাহিত্য হৈচৈ তে সুব্রত সরকার

সুখিমণির ঘড়ি

আজ সন্ধেবেলার স্কুলে সুখিমণি ঘড়ি পেয়েছে।

গোল একটা দেওয়াল ঘড়ি। সুখিমণি একা পায় নি। ওর মত রাতের বেলায় পড়তে আসে আরও অনেক সাঁওতাল পাড়ার মা- মাসিরা সোব্বাই একটা করে সুন্দর ঘড়ি পেয়েছে। একদোম নতুন ঘড়ি!

সুখিমণির আজ খুব মজা মনে। ঘড়ি দেখা শিখতে পারলেই দাদা বুলেছিল্য, ঘড়ি দিব্বো সোব্বাইকে। দাদা কুথা রেখ্খেছে। দুই দিদি কেমুন সোন্দর কুরে ঘড়ি দিখা শিখাই দিল্য। আর শিখে লিতেই দাদা ঘড়ি দিল্য।

দাদার এক বন্ধু কলকাতার দাদা ইসব ঘড়ি আজ আন্যেছিল্ল। উ দাদাও খুউব ভাল্লো বটে। কেমুন সোন্দর করে ঘড়ি গুল্লা হামাদের হাতে হাতে তুল্লে দিল। হামরা পায়ে হাত দিয়ে পোন্নাম করতে চায়ছিলাম, দাদারা নিল্লো না পোরনাম। বুলল,"আরও ভালো করে অনেক কিছু শিখে নাও। তোমাদের যা যা মন চায় শেখো। আমরা শিখিয়ে দেব।"

আজ রাতের ক্লাস শেষ করে ওরা দলবেঁধে সাঁওতাল পাড়ায় ফিরে আসছে। রাতের বেলার এই স্কুল গাঁয়ের সীমানা পার করে দূরের হুই পুকুরপাড়ে। সবার হাতে ছোট ছোট টর্চ। এই টর্চগুলোও ইস্কুল থেকে ওরা পেয়েছে। পড়ালিখা শিখার জন্য কত্তো কিছু পাওয়া যায় এই রেতের বেলার ইসকুল থেক্কে!..

আজ পথে সবাই খুব কথা বলছে। সবার মনে আনন্দ। নতুন ঘড়ির বাক্সটা সাবধানে নিয়ে চলেছে। বকুল মুর্মু বলল, "হ্যাঁরে পদ্ম তু ঘরের কুথায় লাগাবি ঘড়ি?"

পদ্ম বাসকি হাসতে হাসতে বলল," হামি বারান্দায় লাগাব। ঘরে তো আনধার। আলো নাই।"

খুশি কিসকু বলল," আমার লতুন ঘরটায় টিন লাগানো হল্লে, তাপর ঘড়িটা উ ঘরে রাখব।"

রীণা মাড্ডি বলল, "আমার তো ফুটা ঘর, কুথায় যে রাখি!.."

নতুন ঘড়ি কে কেথায় রাখবে এই নিয়েই গল্প করতে করতে ওরা এগিয়ে চলল সাঁওতাল পাড়ার পথে।

সুখিমণি ঘরে এসে দেখল, ছেলেটা ঘরে লাই। বিটিটা ঘুমোচ্ছে বারান্দায়। বিটির বাপ লছমন খুড়াও ঘরে লাই। নিশচয় হাঁড়িয়া গিলতে গেছে বুধিরামের ঠেকে।

সুখি মেয়েকে ডেকে তুলল, "ওরে বুলি উঠ। কি লিয়ে এসেছি দেখ! "

বুলি চোখ কচলে ঘুম ঘুম ঘোরে বলল," কি বটে?"

"ঘড়ি! দেখ কেমুন লতুন ঘড়ি!". সুখি হেসে হেসে বলল, "আমাদের ইসকুল থেক্যে দাদা দিল্য।"

-ঘড়ি লিয়ে তুমি কি করবে?

-ঘরে রাখব। সুময় দেখে কাজ কাম করব। মাঠে যাব।

-তুমি ঘড়ি দেখতি পারো?

-পারি বুলেই তো দাদা দিল্য!

বাক্স খুলে গোল নতুন ঘড়িটা সুখি বের করল। টক টক করে আওয়াজ হচ্ছে। কাঁটাগুলো গোল হয়ে ঘুরছে। সুখি জানে একটা কাঁটা মিনিটের, একটা ঘন্টার.. কাঁটা ঘোরা দেখেই সময় বোঝা যায়।

বুলি এবার বলল, "মা এখন কটা বাজে?"

সুখি একটু দেখে নিয়ে মনে মনে গুণে বলল, "এখন বাজে আটটা কুড়ি..."

রাত বেশি লয় তো তালে!..

-লয় তো!.. তা তুই ঘুমিয়ে পড়েছিলিস কেনে?

-আমার খিদে পেয়েছিল, ভাত খেয়ে লিয়ে শুয়েই পড়েছিলাম।

- কাল থেকে এত তাড়াতাড়ি আর শুবি না। পড়ালিখা করবি। এবার তো তুকে হাই ইসকুলে যেতি হবে।

বাইরের ঘন অন্ধকার থেকে একটা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়াল উঠোনে।

সুখি ঘড়িটাকে বারান্দার দেওয়ালে ঝুলিয়ে দিয়েছে। দূর থেকে বেশ দেখা যাচ্ছে। ছায়ামূর্তিটা সুখির ছেলে সনাতন। সুখি ওকে দেখেই কেমন ধমকের সুরে বলল, "তুই কুথায় গিয়েছিলিস?"

- কুথায় আবার। ঠাকুরথানে বসে ছিলাম।

- পড়ালিখা না করে তুই ঠাকুর থানে বসে কি করছিলিস?

- পড়া করেই তো গেছি।

- এখন কটা বাজে বলতো?

সনাতন ঘড়ি দেখতে জানে। ও ছাড়া এবাড়ির আর কেউ এতদিন জানত না ঘড়ি দেখতে। আজ সুখির হঠাৎ এমন প্রশ্নে একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলে, "এখন অনেক রাত। দশটা তো হবেই।"

- তুই চোখ তুলে দেখ ঐ খানে লতুন ঘড়ি আছে। বল কটা বাজে?

সনাতন অবাক হয়ে দেখে বারান্দার অন্ধকারে একটা ঘড়ি জ্বল জ্বল করছে। কাঁটাগুলো ঘুরছে। ও অবাক হয়ে বলল, "এ ঘড়ি কুথায় পেলি?"

সুখি কেমন যেন গর্ব করে বলল, "হামার ইসকুল থিক্যে দিল্য।"

-"তুই ঘড়ি দেখতে জানিস?" সনাতন মায়ের কাছে জানতে চায়।

"এখন তো শিখেছি। আগে তো জানতাম না।"

সনাতন মাকে হঠাৎই বলে বসে, "বল তো এখন কটা বাজে?"

সুখি ঘড়ির দিকে তাকাল। সুখির মুখের দিকে তখন তাকিয়ে আছে ওর ছেলে সনাতন ও মেয়ে বুলি।

সুখি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মনে মনে গুণে নিয়ে বলল, "এখন আটটা চল্লিশ।"

সনাতন অবাক হয়ে বলে, "তুই একদোম ঠিক বুলেছিস।"

বুলি খুব খুশি। মাকে জড়িয়ে ধরল।

সুখি এবার ছেলেকে বলল, "তুই পড়ালিখা না করে কেন ঘুরে বেড়াচ্ছিলি। রাত দশটার আগে ভাত পাবি না। এখন পড়তে বস।"

সনাতন আর কথা বলতে পারে না। মায়ের এই শাসন মেনে নেয়। সুখি আবার বলে, "কাল থেকে ঘড়ি দেখে সব করবি। সময় লষ্ট করবি না। বুনকেও ঘড়ি দেখা শিখাই দিবি।"

সনাতন ও বুলি সত্যিই বই নিয়ে পড়তে বসে গেল।

সুখি রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে বলল, "তোদের বাপ এখনো এলো না। ওকে এবার বুঝাইন দিতি হবে, রোজ রোজ রাত করে হাঁড়িয়া গিলে আসলি হবে না। আজ আমি পুথুমে বুলব। তাপর সনাতন তুইও বুলবি বাপকে। তবে খুড়া ডরাবে। "

ঘড়িতে এখন দশটা পাঁচ। সনাতন, বুলি খেতে বসেছে। সুখি মায়ের তৃপ্তি নিয়ে দুই সন্তানকে খেতে দিয়েছে। ভাত, ডাল ও বেগুন পোড়া।

ওরা ভাই বোন আনন্দ করে খাচ্ছে।

সুখির বর এখনো বাড়ি ফেরে নি। ওর বর লক্ষ্মণ মুর্মু। মজুর খাটে হাটে মাঠে। সংসারে মন নাই। সারাদিন হাঁড়িয়া গিলে হেসে গেয়ে দিন কাটায়। সুখি ঘড়ির দিকে তাকাল, গুনে গুনে দেখল, এখন রাত দশটা চল্লিশ। ও একা একা বসে আছে বারান্দায় বুড়া বরের জন্য। বুড়াকে আজ সুখি উচিৎ শিক্ষা দেবেই দেবে।

নতুন ঘড়ি একটা নতুন জীবনের স্বাদ এনে দিয়েছে সুখিকে। এই জীবনটার জন্য কত কত বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে সুখিদের। আজ সাঁওতাল পাড়ায় ঘরে ঘরে ঘড়ির কাঁটাদুটো ঘুরছে। সময় তার নিজের খেয়ালে চলছে। আর সুখিরা এবার থেকে সব খেয়াল রাখবে ঐ ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে!..

সমাপ্ত

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register