Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব - ৪৯)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব - ৪৯)

সোনা ধানের সিঁড়ি

৮৪
গানের ভেতরে যে মানুষটা গান গায়, শিল্পীর ভেতরে বাস করা যে মানুষটা ছবি আঁকে তাকে কি দেখা যায়? না, তাকে দেখা যায় না। গায়কের ভেতরে গানের মানুষ গান হয়ে থাকে। সে গান ভোরবেলা, সে গান দুপুরবেলা, আবার কখনও সে গান সন্ধ্যের অন্ধকারের মধ্যে সম্পৃক্ত থাকে। কখনও আবার তাকে দেখা যায় পূর্ণিমার চাঁদঘরে। শিল্পীর ভেতরের শিল্পী মানুষ গ্রীষ্মের দুপুরে মেঠোপথ ধরে হেঁটে যায়। আবার কখনও আশ্বিনের সকালে সাদা মেঘ নিয়ে আকাশ জুড়ে মনভাসানো গান গেয়ে যায়। গানের ভেতরে গান, শিল্পের ভেতরে শিল্প অবয়বহীন এক অস্তিত্ব। তাকে দেখা যায় না। কিন্তু তাকে কি দেখতে আছে? গানের ভেতরে যে গান তার সম্পূর্ণতা নিয়ে সম্পৃক্ত তা তো পবিত্র। সারা গাছ জুড়ে ফুল হয়ে ফুটে আছে। ফুলের ভেতরে যে ফুল, যা ফুলকে সর্বক্ষণ ফুটিয়ে রেখেছে তা তো পবিত্রতার আধার। নৈঃশব্দ্যের ভেতরের নৈঃশব্দ্য যা সবসময়ের আলোকথা, গানকথা। সে তো চিরকালের আলো, নদীর অনন্ত প্রবাহের মতো বয়ে যাওয়া গান। গানের ভেতরে গানকে দেখতে নেই। চোখ মেলে তাকাতে নেই শিল্পের ভেতরের শিল্পের দিকে। অনন্ত নৈঃশব্দ্যের প্রবাহমালায় সামান্য দৃষ্টিও কোলাহলের সৃষ্টি করতে পারে। ছিন্ন হতে পারে অনন্ত মগ্নতা। তাই চোখ বন্ধ করে তাকে দেখতে হয়। অদ্ভুত এক গন্ধ-বাতাস যেন আমাকে ছুঁয়ে যায়। অনেক দূরের ফুলের গাছ থেকে ভেসে আসা গন্ধের মতো। আমাকে ভরিয়ে দেয়। এ যেন পরিপূর্ণতার রসস্রোতে অবগাহন। বিমূর্ততার মধ্যেই নিহিত থাকে মূর্ততার আভাস। এলার্দের কবিতায় পাই এই বক্তব্যেরই প্রশ্রয় ------ " তার দিকে তাকাতে নেই / চোখ বন্ধ করে দেখতে হয়। " আমাদের ভেতরে যে মানুষটা পার্থিব বিষয়ের নেশায় অষ্টপ্রহর আপ্লুত, সামান্য প্রাণটুকু নিয়ে যে মানুষটা পৃথিবী ভাগের চেষ্টায় ব্যস্ত ----- এই গান থেকে সে বহুদুরে। গ্রীষ্মের দুপুর দেখার আনন্দে যে মাতোয়ারা, সন্ধ্যার অন্ধকারের মধ্যে সম্পৃক্ত নৈঃশব্দ্য নিয়ে যে গর্বিত ----- গান তাকে এসে ছুঁঁয়ে যায়। দীর্ঘসময় গানের ঘরে যে নিবিষ্ট, পৃথিবীর রঙের মধ্যেই যে শিল্পী খুঁজে পেয়েছে তার মর্মরহস্য, সে চোখ বুজে গানকে ছুঁতে ছুঁতে তার ভেতরের দস্যি মানুষটা ঘুমিয়ে পড়ে। তার মধ্যে নেই কোনো "আমি"-র প্রকাশ। সে তখন মৃত। আসলে প্রকৃত জাগরণ তখন থেকেই শুরু হয়। এই জাগরণের ভেতর থাকে সর্বক্ষণের গান, শিল্পীর শিল্পসত্ত্বার এক প্রবাহ। শিল্পীর শিল্পচর্চা সর্বক্ষণ চললেও সে আসে মাত্র কিছুক্ষণের জন্য। আর তখনই শিল্পীর হাত দিয়ে বেরিয়ে আসে ধ্রুপদী রেখামালা। পৃথিবীর মৌলিক সৃজন। একমাত্র জাগরণপর্বেই এই সৃষ্টি সম্ভব। বাকি আমরা যারা ভীষণভাবেই দাবি করি যে, জাগার মতো জেগে আছি তারা আসলে ঘুমিয়ে। এ যেন পৃথিবীর দ্রুততম যানে চেপে নিজেকে গতিশীল বলার প্রচারে নেমে পড়া। আসলে আমরা যারা বাহ্যিক জাগরণের সমর্থক তারা চিরনিদ্রায় নিদ্রিত। ঘুমের মধ্যে এক স্বপ্নিল আবেশে আমরা নিমজ্জমান। কোনো একদিন প্রকৃত জাগরণে জেগে উঠব ----- এই ভাবনায় সম্পৃক্ত থেকে তারা শেষ ঘুমের দিকেই এগিয়ে যায়। বাহ্যিক গতিশীলতায় আপ্লুত আত্মশ্লাঘার চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছে গিয়ে আমাদের প্রচলিত মৃত্যুতেই গন্তব্য স্থির হয়ে যায়। এখানেও স্মরণে আসে এলার্দে ----- " মৃতরাই জেগে / আমরা ঘুমিয়ে / স্বপ্নের মধ্যে। "
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register