- 24
- 0
যাইহোক, ফিরে আসি শিল্প উৎকর্ষতার বিষয়টিতে; যদিও খুব বিশদে এবিষয়টি আলোচনা করার জায়গা এটি নয়।তবে প্রাসঙ্গিকভাবে কয়েকটি কথা বলাই যায় ~ ইউরোপ / আমেরিকা'য় কবিতা চর্চা ধাপেধাপে যেভাবে বর্তমান সময়ে পৌঁছেছে, ভারতবর্ষের কবিতা চর্চা অতীতের কিছু সময়ের চরম উৎকর্ষতায় পৌঁছেও বর্তমান সময়ে স্বতন্ত্র নয়।অথচো, চীন / জাপান / মধ্যপ্রাচ্য অনেক পরে শুরু করেও, নিজস্ব কিছু সাংষ্কৃতিক স্বতন্ত্রতা : আজও বহাল।লাতিন আমেরিকা য্যামোন সবচেয়ে দেরীতে শুরু করলেও, বর্তমানে সম্পূর্ণ ভিন্নস্তরে নিয়ে গেছে নিজেদের।এর কারণ সম্ভবত ~ নিরীক্ষা প্রবণতাগুলি চর্চার অভাব // প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যরীতি'র মিলনকে অস্বীকার // কুসংস্কার ও জাতিধর্মের অতিরিক্ত কূপমণ্ডূকতা // ইত্যাদি অনেক কিছুই বলা যায়।
বাংলা কবিতাধারাটিও এসবের বাইরে নয়।সময়ের দাবিকে অস্বীকার করে, জোর করে যে অতীত লেখভাষ্য ভঙ্গিমাটিকে বুকে আঁকড়ে ~ যে বদ্ধ জলাটির সৃষ্টি হয়েছে, তা নিশ্চিতভাবেই হলফ করে বলা যায় : নিরীক্ষা প্রবণতাযুক্ত পথটির অনুসন্ধান চর্চা ধাপেধাপে গড়ে না ওঠা।উল্লেখযোগ্য ~ ১৮শতকের প্রায় শেষপর্বে মাইকেল মধূসুদন দত্তের হাত ধরে বাংলা ভাষায় যেভাবে পাশ্চাত্ত্য গঠনরীতি নিয়ে অনুসন্ধানের পথটি যেভাবে ঢুকে পড়ে // বা, রবীন্দ্রপক্ষের ভাবময়তা পেরিয়ে যেভাবে গত শতকের ৩০'র দশকের পরাবাস্তববাদী গঠন // বা ৪০ ও ৫০' রোমান্টিক চিত্রকল্পতা পেরিয়ে, ৬০'র দশক থেকে বাংলা কবিতার নিরীক্ষালব্ধ আবেদন : অনেককিছুই আসতে পারে।আর এখান থেকেই আজকের বইমাত্রিক আলোচনার কেন্দ্রে ঢোকার চেষ্টা করছি।
গত শতকের ৬০'র দশক থেকে যেকটি সাহিত্য সংক্রান্ত আন্দোলন বাংলাভাষায় গড়ে ওঠে, তার একটি অন্যতম ছিলো শ্রুতি আন্দোলন।এই প্রসঙ্গে এর আগে, শ্রুতি আন্দোলন নিয়ে ডকুমেন্টেড্ 'পদ্য' পত্রিকার বিশেষ সংখ্যাটি নিয়ে যা লিখেছিলাম, তা আরেকবার স্মরণ করছি ~ "হাংরি ধারার আন্দোলনের মূল জায়গাটি যেখানে "যেকোনো জাগতিক ঘটনার প্রকাশকে, অস্তিত্বের নেপথ্যে থাকা পঞ্চইন্দ্রিয় দ্বারা চেতনার সংযোগরেখা দিয়ে উপলব্ধি" এভাবে করা হয়েছে (অর্থাৎ, আগে ইন্দ্রিয় তারপর চেতনা বা ইন্দ্রিয় ব্যতীত চেতনার জায়গা নেই); অপরপক্ষে শ্রুতি ছিলো "যেকোনো জাগতিক ঘটনাকে চেতনার কেন্দ্রাতিগো অঞ্চলের মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করা এবং তার প্রকাশ; এখানে ইন্দ্রিয়ের নিজস্ব উপলব্ধি নেই, পঞ্চেন্দ্রিয় স্রেফ একটি মাধ্যম যা চেতনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিতো" (অর্থাৎ, আগে চেতনা পরে ইন্দ্রিয়)।যদিও ষাটের দশকে এই দুই আন্দোলন ছিলো পরস্পর বিরোধী, মূলতঃ যার কারন ছিলো হাংরিধারার যৌনতাকেন্দ্রিক শিল্প। তবুও আজ ২০২০তে দাঁড়িয়ে (যখোন যৌনতাভিত্তিক্ বিভিন্ন ট্যাবু বা সংষ্কার ধীরেধীরে ভেঙে যাচ্ছে), এই দুই ধারার বিরোধীতায় না গিয়ে : মনে হয় ~ ভিন্ন একটি তৃতীয় ধারার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে প্রকৃত চর্চায়।হাংরি'রা যেখানে যাপনপ্রসূতো শব্দ এবং যাপন তীব্রতা; এই দুই বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছিলেন || সেখানে শ্রুতি'র কবিরা অনেকটাই ছিলেন প্রশান্ত মহাসাগরের মতো শান্ত ও গভীর।শ্রুতি'র কবিরা চেয়েছিলেন শব্দের আবহমান কাঠামোকে ভাঙচুর করে, তার অভ্যন্তরীণ গতিশক্তি দ্বারা ধ্বনি এবং ধ্বনিকল্পনার ইমেজ্ বা দৃশ্য মাধ্যমে নতুনধারা গড়তে (চিত্রকল্প শুধু শব্দার্থ দিয়ে নয় ~ শব্দার্থ ভেঙে তার অভ্যন্তরীণ ধ্বনি ও অবয়ব : উভয়ের যৌথ মিথোষ্ক্রিয়া)।এই দুই ধারার কবিদের কাছেই, 'সময়' বিষয়টির যাপনলব্ধ আত্তীকরণ ছিলো ভিন্ন।কবিতা এবং সে কবিতায় চেতনাকেন্দ্রিক নতুন চিন্তাধারার কীভাবে প্রণয়ন ~ এ সম্পর্কিতো বিষয়টি নিয়েও উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ শ্রুতির কয়েকটি ভিন্নধারার কাজ; য্যামোন ~ যতিচিহ্ন সম্পূর্ণ রূপে বর্জন / টাইপোগ্রাফি এফেক্ট / শূন্যস্থান বা স্পেস ব্যবহার, এমনকি চিত্রশিল্প ও কবিতার আভ্যন্তরীণ বিষয়গুলিকে একত্রিকরণ, বা কবিতায় শব্দার্থ বিন্যাসটিকে জ্যামিতিক আকার প্রয়োগে নতুন দৃশ্যের সার্থক রূপান্তর প্রদান, ইত্যাদি এসেছে।যাঁরা ইউরোপীয় ঘরানার পাশাপাশি লাতিন আমেরিকার কংক্রিট পোয়েট্রি বা সাবয়ব / স্বাকৃত কবিতা নিয়ে খোঁজখবর রাখেন; বাংলা-কবিতায় সেইরকম একটা প্রবণতা অভিমুখী যাত্রার শুরু দেখে অতি অবশ্যই বিস্মিতো হবেন বলেই বিশ্বাস।" যদিও গত শতাব্দীর ৩০/৪০দশকে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত রচিত 'গ্রীষ্মের সুর' বা কবি অমিয়ভূষন চক্রবর্তী রচিত 'পিঁপড়ে' কবিতাটির, ইত্যাদির সাথে এই শ্রুতি আন্দোলনে যুক্ত কবিদের রচিত কবিতাগুলির অল্প কিছু প্রাথমিক সাদৃশ্য পাওয়া যায়, তা সত্ত্বেও শ্রুতি আন্দোলন ছিলো বাংলাভাষার এক ভিন্নমুখী স্বতন্ত্র স্বর; যা প্রভাবিত করেছিলো পরবর্তী সময়ের বেশ কিছু কবির চিন্তাধারা তথা কবিতারূপটিকে।
0 Comments.