Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় সবর্ণা দে

maro news
।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় সবর্ণা দে

মকর সংক্রান্তি এবং অন্যরকম উৎসব

যা লিখি আমার সাথে ঘটে যাওয়া সত্যি ঘটনা . আজ অব্দি আমি কোনো কিছু কল্পনা করে গল্প লিখতে পারিনি. তাই আমার বেশিরভাগ লেখা ভ্রমণ সংক্রান্ত হয়ে থাকে. এছাড়া ব্যক্তিগত গদ্য এবং তার সাথে জড়িয়ে থাকা কিছু অনুভূতি. আজকের লেখাটা একটু মিশ্র অনুভূতি প্রবণ. প্রতিদিন চারপাশে যা ঘটে চলেছে তার কিছু প্রভাব মনে উপর পরে. আমার মনে হয় সেই মনের কথা গুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার অন্যতম মাধ্যম এই লেখা. ঘটনাটা সত্যি খুবই সাধারণ. কিন্তু আজ আমাদের চারপাশে যা অবস্থা, তাতে এই ঘটনার ভীষণ ভাবে একটা তাৎপর্য আছে. বিশেষ করে যখন শরতের আকাশে সাদা মেঘের খেলা, সাথে কাশফুলের পাল্লা দিয়ে ঘোষণা, যে তার ফুলও আরো বেশি সাদা. আর সারারাত ধরে ফুটে থাকা একমুঠো সাদা শিউলি ফুল জানান দেয়, মা আসছে. কিন্তু আমি উৎসব পালনে সামিল হতে পারছিনা, ভিড়ে মিশে যেতে পারছিনা. ঘরে বসে শুধুই উৎসবের স্মৃতিচারণ. আমার উৎসব পালনে সামিল না হবার কারণ, Covid এর হাত থেকে নিজেকে বাঁচানো. কিন্তু যারা মানুষ রুপী শয়তান গুলোর হাত থেকে বাঁচতে পারলোনা ? তাদের পরিবারের কাছে আজ পুজো বা উৎসব একটা প্রহসন. ওদের দেখে নিজে কষ্ট পাই আর আমাদের মায়েরা ভয় পায় আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে. তবুও সাহস সঞ্চয় করে একা বাইরে বেরুই. সবাই তো আর শয়তান নয়.

ঘটনাটা বলি, Lockdown এর দু তিন মাস আগের ঘটনা.

শ্বশুরমশাই বাংলাদেশে আত্মীয়র বাড়ি ঘুরতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন. আমার বর সেই সূত্রে দেশের বাইরে, মানে বাংলাদেশ গেছিলো. সোম থেকে শুক্র কাজের প্রয়োজনে আমি মার কাছে থাকি. মার বাড়ি থেকে কর্মক্ষেত্রে যাবার প্রচুর সুবিধা . যাতায়াতের সময় বাঁচে এবং সংসারের কথা খুব একটা ভাবতে হয়না, সব কিছু মুখের সামনে তৈরী থাকে. খাবার, কাচা/ ইস্ত্রি করা জামা কাপড়, পরিপাটি করে গোছানো বিছানা, টিফিন বক্সে দুপুরের খাবার, শুনতে স্বার্থপরের মতো লাগে কিন্তু সুবিধা ভোগ করতে কে না ভালোবাসে. শনি রবি কর্মক্ষেত্রে ছুটি থাকার দরুণ আমি মার বাসা থেকে ডানা মেলে উড়ে পালিয়ে যাই, মাও একটু বিশ্রাম পায়. এরকমই মকর সংক্রান্তির আসে পাশে, এক শনিবার আমি ডানা মেলে পালালাম. বাড়িতে বর নেই, মা যেতে বারণ করলো. আমি একা থাকলে আমার থেকে মার বেশি ভয়. দুদিন আগে থেকে মার বকা ঝকা , তা সত্ত্বেও আমি পালালাম. স্বাধীনচেতা মহিলা , অনেক বার ঠোক্কর খেয়েছি, তবুও মার কথা শুনিনা. পালালাম. জায়গাটার একপাশে কিছু হিন্দু পরিবার থাকে , অন্য পাশে কিছু মুসলিম পরিবার. বাড়ি পৌঁছনোর পর মার ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন. 'ঠিক করে পৌঁছেছিস?' 'দরজা বন্ধ করে থাক'. 'কেউ দরজা ধাক্কা দিলে খুলবিনা'. 'কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবি বর ঘরে আছে, একা আছিস কাউকে বলার দরকার নেই ইত্যাদি ইত্যাদি'. প্রথমে মনে হলো ফোন বন্ধ করে দি, কিন্তু পারলামনা. আমার ভালো কজন চায়? যে মানুষটার রাত দিন জুড়ে শুধু তার মেয়েরা, তাকে কেন কষ্ট দি. হালকা বকা দিয়ে ফোনটা রেখে দিলাম. দিনের বেলা ঘর পরিস্কার, টুকটাক দোকান বাজার, রান্না আর আলসেমি করে কেটে গেলো. সন্ধ্যে নামলে, চারদিক চুপ চাপ. রাস্তার জোরালো আলোর কিছুটা রেশ অন্ধকার ঘরের ভেতর পড়ছে. যে ঘরে থাকি সেই ঘরের শুধু আলো জ্বালিয়ে রেখে ইলেকট্রিসিটি বাঁচাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য. ইলেকট্রিসিটি আছে বলে অপব্যাবহার করবো নাকি. রাত আটটা নাগাদ দেখি আমার ফোন বাজছে. ফোনের স্ক্রিনে দেখি এমদাদুলের নম্বর ভাসছে. আমরা ওকে এমদা বলে ডাকি. জুতো সেলাই থেকে চন্ডি বা কোরান পাঠ যেকোনো দরকারে এমদাকে ডাকলে লোক বা দোকানের খোঁজ দিয়ে দেয় . ওর বন্ধুবান্ধব যেমন রামিজ , মঈদুল ওকে স্থানীয় ডন বলে ডাকে আর এমদা এসব শুনে হাসে . আমরাও নানা দরকারে ওর থেকে কাজের লোক বা সাহায্য নিয়ে থাকি. কিন্তু আজ তো ওকে ডাকিনি , তাহলে ও রাতে ফোন করছে কেন ? দোতলা থেকে দেখি নিচের রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে . ফোনটা ধরতেই বলে, 'ম্যাডাম একটু নিচে নেমে আসবেন'. নিচে নেমে সদর দরজা খুলে দেখি, কখন ও গেট টপকে সদর দরজা অব্দি চলে এসেছে. ওকে সদর দরজায় দেখবো আশা করিনি, তাই ভয় ভয় জিজ্ঞাসা করে বসলাম, 'ভেতরে এলে কি করে?' . ও নিজেই বললো গেট টপকে ঢুকেছে. হাতে দেখি একটা ব্যাগ . আমার হাতে দিয়ে বলল, 'ম্যাডাম বৌ বাড়িতে পিঠে বানিয়েছে, তাই আপনাকে দিতে এলাম, সাথে একটু চানা ও আছে'. কিছুদিন আগে নতুন বছরের শুরুতে আমি ওদের মানে এমদা , রমিজ , মঈদুল, নিতাই, জগুর বাচ্ছাদের একটু কেক, চকলেট , বিস্কুট এবং চিপস দিয়েছিলাম. এমদার পিঠে দিতে আসাকে আমি তার প্রতিদান মনে করিনা, আমি মনে করি যে এটা একটা মানব ধর্ম যা আমরা হারিয়ে ফেলেছি বা হারাতে বসেছি কারণ আমরা কাউকে আর বিশ্বাস করে উঠতে পারছিনা. বিশ্বাস করবো কি করে যাকেই দেখি সে নিজের স্বার্থের জন্য সম্পর্ক রাখছে বা মিশছে. খুব কম মানুষকে কাছে পেয়েছি যারা বিনা স্বার্থে পাশে থেকেছে. চারিদিকের উথাল পাথাল সমাজে এমদার সাথে আমাদের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে জানিনা, ওর সাথে সম্পর্কের সবে তো শুরু. এমদাকে বললাম টিফিন বাক্স কাল দেব, এমদা চলে গেলো. দরজা বন্ধ করে দিলাম, রান্না ঘরে গিয়ে টিফিন বাক্স খুলে দেখি ভাজা পিঠে. সঙ্গে সঙ্গে মুখে দিলাম , কি অসাধারণ খেতে. বিস্বাস যখন ধর্ম কাল পাত্র পাত্রী ছাপিয়ে জিতে যায়, তখন এই পিঠে এরকমি অমৃত সমান লাগে, পূজার প্রসাদ হয়ে ওঠে. ভীষণ ভালো লাগলো এই ভেবে যে মকর সংক্রান্তি তে এমদার বাড়িতেও পিঠে হয়, আর আমি সেই প্রসাদ পেয়েছি. এটাই আমার আনন্দ এটাই আমার পুজো এটাই আমার উৎসব. এই ঘটনাটা আপনাদের কে জানানো আমার কাছে ভীষণ গর্বের. লেখার সময় ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম. ক্ষমা প্রাথী যদি লেখাতে পিঠের থেকে আবেগ বেশি থাকে.

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register