Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

অণুগল্পে মিঠুন মুখার্জী

maro news
অণুগল্পে মিঠুন মুখার্জী

জীবন দান 

আজ ২০ শে জুন 2020। মহামারীর করালগ্রাসে বিশ্ববাসী মুহ্যমান। সভ্যতার এই সংকটে মনুষ্যত্বের অপমৃত্যু ঘটেছে। চারিদিকে মৃত্যু-মিছিল। প্রতি একশো বছর অন্তর নাকি মহামারী আসে। অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে চলেও যায়। কিন্তু এবারের মহামারী যেন যেতেই চায় না। যত দিন যাচ্ছে ততই ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্করতর রূপ নিচ্ছে। আজ আমি এমন একজন মানুষের কথা বলতে যাচ্ছি, এই মনুষ্যত্বহীন পরিবেশের মধ্যে তিনি এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। এরকম মানুষ লাখে একটা হয়। জন্মেছিলেন বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। দারিদ্রতার মধ্যে কাজ করে, সংসার চালিয়েছেন, পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে কলকাতার বড় লোকদের মধ্যে একজন। নাম শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। প্রথমেই নাম শুনে একটু অবাক হতে হয়। কারণ এই নামটি আমাদের সকলের কাছে খুব পরিচিত। তবে ভারতবাসী যে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে চেনেন, ইনি তিনি নন। তবে কাজের পরিধিতে তার থেকে একেবারে কম নন। বর্তমানে ঢাকা, ময়মনসিংহ ও কলকাতা মিলিয়ে ত্রিশ টির বেশী সোনার দোকান। 'শ্যামাপ্রসাদ জুয়েলার্স' নামকরণ নিজের নামে রেখেছেন। দুই দেশে দশটি বাড়ি,ত্রিশটির উপরে গাড়ি, কর্মচারী সব মিলিয়ে দুশো জন হবে। বাড়িতে থাকার মানুষ মাত্র তিনজন। শ্যামাপ্রসাদ বাবু, স্ত্রী সুগন্ধা দেবী ও তাদের একমাত্র মেয়ে রুনা। এছাড়া দুই দেশ মিলিয়ে দশটি স্কুল চালান তিনি। গরিব, অপারগ মানুষের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করানো হয় সেখানে। আজ দীর্ঘ কুড়ি বছরে বহু ছেলেমেয়ে তার উপকার পেয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন দেশে-বিদেশে। এই করোনার আবহে জানুয়ারি মাস থেকে গরিব মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছেন তিনি। প্রতিদিন কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তের পাঁচ হাজার গরিব মানুষের কাছে খাবার নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছেন তার লোকজন। এখনো একটা দিনও বাদ যায় নি। রাজ্য সরকারের হাতে তুলে দিয়েছেন পঞ্চাশ কোটি টাকা। মাক্স ও স্যানিটাইজার বিলিয়েছেন কুড়ি হাজার মানুষকে। তিনি বলেন-- "জীব সেবায় শিব সেবা। কিছু নিয়ে আসি নি, কিছু নিয়ে যেতে পারবো না। মানুষের জন্য কাজ করতে পারলে আমি আত্মিক শান্তি পাই,ভালো লাগে।" সর্বত্র তিনি তার নামের থেকে 'গরিবের ভগবান' বলে বেশি পরিচিত। যেখানে করোনা আক্রান্ত মানুষের কাছে যেতে মানুষ ভয় পায়; মনুষ্যত্ব মানুষের মধ্যে হারিয়ে গেছে, সেখানে মানুষের পাশে যাওয়ার সাহস দেখান তিনি। এই মাসের 5 তারিখে 'বিশ্ব পরিবেশ দিবস' উপলক্ষে দুই দেশে বৃক্ষরোপণ উৎসব করেছেন। পাঁচ হাজার নানান ধরনের চারাগাছ পুঁতেছেন। সারাবছর সেই গাছগুলি দেখাশোনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। করোনা সম্পর্কে বিভিন্ন জায়গায় সচেতনতামূলক ক্যাম্প করেছেন। আরো অনেক সমাজসেবামূলক কাজ করেন তিনি, যার হিসাব নেই। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের এই সকল কাজ করার পিছনে উদ্দেশ্য ছিল। ছোটবেলায় অভাব নিজের চোখে দেখেছেন। না খেতে পেয়ে অনেক দরিদ্র মানুষকে মারা যেতে দেখেছেন তিনি। মেধা থাকা সত্ত্বেও পড়তে না পারার যন্ত্রণায় কষ্ট পেতে দেখেছেন তিনি। তাই ছোটবেলা থেকেই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, অসহায় দরিদ্র মানুষের জন্য কিছু করে দেখাতে হবে। আজ তিনি তার প্রতিজ্ঞা পূরণে সফল হয়েছেন। প্রচুর মানুষের দুহাত ভরা আশীর্বাদ তার বেঁচে থাকার মূলধন হয়ে উঠেছে। কথায় আছে ভালো মানুষের কপাল সব সময় ভালো হয় না। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের একমাত্র মেয়ে নিজের পছন্দে বিয়ে করে সংসার করতে পারেন নি। তাই বাবার সঙ্গে থাকেন রুনা।রুনার স্বামী নেশা করে প্রায় তার উপর অত্যাচার করত। পয়সা পিশাচি তপন রুনাকে তার বাবার কাছ থেকে শুধু টাকা নিয়ে আসতে বলতো। শ্যামাপ্রসাদ বাবু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কলকাতার দুটি সোনার দোকান তপনকে চালাতে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিন মাস একটা টাকাও লাভ চোখে দেখতে পারেন নি। তিনি শেষমেষ ধৈর্য হারিয়ে বেশ বড় অংকের টাকা দিয়ে ডিভোর্স করিয়ে দেন তিনি। তিনি মেয়েকে নিজের পছন্দমত ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বর্তমান সময়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সোনার ব্যবসায় করোনার কারণে একটু মন্দা যাচ্ছে। তবুও কর্মচারীদের মাইনে তিনি প্রত্যেক মাসে দিয়ে যাচ্ছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা তার জুয়েলারিতে কাজ করছেন তাদের মাইনে এই সময় এক টাকাও কমাননি তিনি। এই কারণে তার কর্মচারীদের কাজের উদ্যমে ঘাটতি নেই। সমাজসেবামূলক কাজে মেয়ে রুনাকেও সঙ্গে নিয়েছেন তিনি। পিতার আদর্শে মেয়ের মানসিক পরিবেশ গড়ে ওঠে। ফেলে আসা দিনের কথা কাজের মধ্যে থেকে ভুলে যায় সে। ধীরে ধীরে রুনা শ্যামাপ্রসাদ বাবুর সমস্ত ব্যবসা বুঝে নেয়। একজন মেয়ে হয়ে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখায় সে। রুনার প্রতি পিতার বিশ্বাসের জায়গা আরো পোক্ত হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে নিজে না থেকে রুনাকে দায়িত্ব সামলানোর জন্য একা ছেড়ে দেয় সে। ধীরে ধীরে চাবুক তৈরি হয় রুনা। জুয়েলারির শাখাগুলি দেখাশোনা সঙ্গে সঙ্গে সমাজসেবামূলক বিভিন্ন কাজ করতে থাকে রুনা। একদিন বাবাকে বলে-- "বাবা, আমার বিশ্বাস তোমার মত আমিও একজন জনদরদি সমাজসেবী হয়ে উঠতে পারব। বিয়েই জীবনের সবকিছু নয়। মানুষের জন্য কাজ করে আমি মানসিক তৃপ্তি পাই। সংসারের কলহের থেকে এটা ঢের বেশি শান্তির।" দিন যায় রুনা সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। বাবা বিয়ের কথা বললে সে কোনমতে রাজি হয় না। কথায় আছে ন্যাড়া বেলতলায় একবার যায়। বিয়ের প্রতি অনীহা দেখে শ্যামাপ্রসাদ বাবু ও সুগন্ধা দেবী রুনাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, তারা না থাকলে তখন রুনা একা একা কিভাবে বাঁচবে। রুনা জানায় মানুষকে নিয়ে তার দিন চলে যাবে। সমাজসেবাটা যেন পিতার থেকে রক্তে পেয়েছে সে। সাধারণ মানুষের জন্য নিজের জীবনকে এভাবে উৎসর্গ করতে দেখে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় একদিকে যেমন আনন্দ পায়, তেমনি অন্যদিকে মেয়ের ব্যক্তিগত সুখ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কথা ভেবে দুঃখও পায়। মনে মনে ঈশ্বরকে বলেন-- "ঈশ্বর, তুমি আমার এই সরল মনের মেয়েটিকে দেখো। ওর সুখীই আমার সুখ, ওর আনন্দই আমার আনন্দ।"
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register