Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

মেঘ প্রবন্ধে রঞ্জিতা চট্টোপাধ্যায় (শিকাগো)

maro news
মেঘ প্রবন্ধে রঞ্জিতা চট্টোপাধ্যায় (শিকাগো)

তিলোত্তমা মজুমদার-আমার প্রিয় একালের বাংলা এক কথাশিল্পী

কথাশিল্পী বিশেষণটি নামের আগে থাকলে যে লেখকের কথা মুহূর্তে বাঙালী পাঠকমাত্রেরই মনে পড়ে যায় তিনি হলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। গল্প ও উপন্যাসে তার বলা সাধারণ মানুষের জীবনকথা উন্নীত হয়েছে শিল্পের পর্যায়ে। তাই তিনি কথাশিল্পী। একজন লেখকের পক্ষে কাজটি খুব সহজ নয়।সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে জড়িয়ে আছে নানা হতাশা, ক্ষোভ, বঞ্চনা, গ্লানি। আছে লোভ, হিংসা, রাগ, লালসার বিচিত্র প্রকাশ। তাই কোন লেখকের রচনার প্রধান বিষয়বস্তু যদি হয় মানুষের নিত্যকার জীবনের “কান্না হাসির দোল দোলান পৌষ-ফাগুনের পালাগান”, খুব স্বাভাবিকভাবেই সেখানে জীবনের নেতিবাচক, অন্ধকার দিকটির বেশ দীর্ঘ ছায়া পড়ে। সেই অন্ধকারের উৎস থেকে আলোর উৎসরণ ঘটান একমাত্র দক্ষ সাহিত্যশিল্পীদের পক্ষেই সম্ভব। আর এই কাজটিতে সফল হলেই গল্পকার বা ঔপন্যাসিকের বলা কথা হয়ে ওঠে কথাশিল্প।
“বিজয় তিওয়ারি শেষ পর্যন্ত খুপরি দোকানটায় মুড়ি, চিড়ে, ছোলা, বাতাসা, আচার নিয়ে বসল। তার বাপ এখানে তামাক কুচিয়ে খৈনি বেচত। নিজেও খেত হরদম। খাদ্যনালীতে কর্কট রোগ হল। ডাক্তারবাবু বললেন এ হল তামাকু সেবনের অপকারিতা” বাচনভঙ্গীর সহজতায় এটুকু পড়েই পৌঁছে গেলাম বিজয় তিওয়ারির খুপরি মুড়ির দোকানটায়। ১৪২২ সালের শারদীয়া দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত তিলোত্তমা মজুমদারের ছোট গল্প “গোলাপি ওড়না”। সাবলীল, স্বচ্ছন্দ শুরু। গল্প যত এগোয় ক্রমশ চোখের সামনে ফুটে ওঠে বিধবা মা কুন্তী আর বউ রূপাকে নিয়ে বিজয়ের সংসারের চিত্র, তার দোকানের আশেপাশের পরিবেশ, খদ্দেরদের পরিচয়। গল্পের একটি অন্যতম প্রধান চরিত্র কিন্তু মনুষ্যেতর এক প্রাণী- “তুলতুলে নরম পাটকিলে গা” ওলা একটি ছাগলছানা। বউয়ের ওজর আপত্তি অগ্রাহ্য করে বিজয় ছাগল পোষে। নাম রাখে তার লটপটে। গল্পে নাটকীয়তা ঘনিয়ে ওঠে যখন এক সন্ধ্যাতে “ফরসা, ছিপছিপে, টানা টানা চোখ,পাতলা নাক, গোলাপি সালোয়ার কামিজ দোপার্টা, কাঁধে কালো ব্যাগ-দেখলেই ভাল লাগে” এমন একটি মেয়ে বিজয়ের দোকানে এসে দাঁডায়। ছাগলছানাটির প্রেমে পড়ে যায় সেও। আর বিজয়? তার ভালবাসা মেয়েটির মধ্যে আছে। প্রেম-ট্রেম নয়। বিজয় এই মেয়েকে নিয়ে ময়দানে যেতে চায় না, সিনেমা হলে বসে চটকাতে চায় না, শুধু রোজকার জীবনে এই একটু দেখা হওয়া থাক। এটুকুর জন্য সে লটপটেকে আমৃত্যু কাছে রাখতেও রাজি।” মুড়ির দোকানদার বিজয়ের এই অনুভূতি বড় কবিত্বময়। এই অনুভূতির প্রকাশভঙ্গীতে গল্প কবিতার সীমারেখা মুছে যায়। সাধারণ একটি ছোটগল্প পাঠকমনকে ছুঁয়ে যায় গভীরভাবে। মধাবিত্ত জীবনের বাস্তবতার মধ্যে এই স্বপ্নময় অনুভূতি বুনে দেওয়াই হল শিল্প। আর এই কাজটিতে লেখিকা সফল হয়েছেন পুরোপুরি।  
আর এই আমাদের “সাহিত্য পর্যালোচনা” বিভাগের স্বল্প পরিসরে তিলোত্তমার সাহিত্য সম্ভার থেকে অগুণতি উদাহরণ দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু সম্পূর্ণ নিজস্ব ভঙ্গীতে তিনি তার ছোটগল্প, উপন্যাস ও কবিতায় স্বপ্ন আর কঠিন বাস্তবের সার্থক মেলবন্ধন ঘটিয়ে চলেছেন। ফলে তার লেখায় তৈরী হয়েছে সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি আঙ্গিক যা তাকে সমকালীন অন্যান্য লেখকদের থেকে আলাদা করে চিনিয়েছে পাঠকদের।
গল্পের  শেষে মেয়েটি বিজয়কে জানায় তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তাই আর সে মুড়ি খেতে বিজয়ের দোকানে আসবে না। লটপটিয়াকে বাজারের দামের তিনগুণ দামে বিক্রী করে বউয়ের হাতে টাকার গোছা তুলে দেয় বিজয়। তারপর বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে ভাবতে থাকে, “একটা পাটকিলে বকরা আর গোলাপি দোপা্টা জড়ান মেয়ের কথা। নিজের কথাও। কেন সে লটপটিয়াকে বেচে দিল? লোভে? নাকি গোলাপি ওডনা উড়ে গেল বলে?লটপটে তাকে ছেড়ে যেতে চায় নি। বিজয় জোর করে দুর করে দিল। পেঁয়াজ-রসুনে কষা মাংস হয়ে যাবে জেনেও দিয়ে দিল উৎসবের কশাইয়ের হাতে। হয়তো মেয়েটাকেও কেউ-----!?”
ভাবনা শেষ হয় না বিজয়ের। গল্প শেষ হয়। কিন্তু আদর্শ ছোটগল্পের মত এই গল্পের শেষ লাইনে পৌঁছে পাঠকের মনে হয় “শেষ হয়ে হইল না শেষ।” বিজয়ের মনের দ্বন্দ্ব পাঠক মনেও প্রশ্ন জাগায়, সত্যিই তো, কি পরিণতি হবে গোলাপি ওড়নার? আর এই প্রশ্নের সঙ্গেই পাঠকদের মনোযোগ আকৃষ্ট হয় সমাজে মেয়েদের জায়গার মতো গভীর প্রসঙ্গে। সাবলীল ভঙ্গীতে বলে চলা আপাত অর্থে সাধারণ একটি ছোটগল্প গল্পকারের পরিবেশনার গুণে মনে রেখাপাত করে। 
তিলোত্তমা মজুমদার বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে নবীন। তার জন্ম ইংরাজী ১৯৬৬ সালের ১১ই জানুয়ারী। ছোটবেলা কেটেছে চা বাগানের পরিবেশে, কালচিনিতে। ১৯৮৫ সালে চলে আসেন কলকাতায়। তার লেখালিখির জীবন শুরু হয় ১৯৯৩ সাল থেকে। প্রথম লেখা বের হয় কালচিনি থেকে প্রকাশিত “উন্মেষ” পত্রিকায়। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস “ঋ।” আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকমহলে সাড়া ফেলে দেন তিলোত্তমা। তার অনেক গলপ এবং উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু নানরকম সম্পর্কের টানাপোডেন। অনেক সময় সে টানাপোডেন যে কোন সম্পর্কের স্বাভাবিক ঘাত-প্রতিঘাত থেকে অনেকটা আলাদা। তার উপন্যাসে বর্ণিত মনের গভীর গোপনে থাকা অন্ধকার এক দিক। “চাদের গায়ে টাদ”, “বসুধারা”, “রাজপাট”, “চাঁদু” প্রভৃতি উপন্যাসে যথেষ্ট সাহসিকতার সাথে মানবমনের এইসব বিচিত্র জটিল মনস্তত্ত্বে আলোকপাত করেছেন তিনি। এইসব উপন্যাসের নানাভাবে এসেছে সমকামিতা, ইডিপাস কমগ্নেক্স, ঈশ্বর আরাধনার আড়ালে নারীপাচার, রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরোধ এবং বিশ্বাসঘাতকতা। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার ভাষা সাহিত্যসুষমা হারায় নি কোথাও। আর সেখানেই শিল্পী হিসেবে তার সার্থকতা। 
আমার আলোচ্য গল্পটিতেও তার সাহিত্যসাধনার এই দিকট পরিষ্কার। সেখানে বিজয়ের গোলাপি ওড়না মেয়েটির প্রতি মনোভাবে বৈষ্ণব কবিজনোচিত অহৈতুকী প্রেমের মতো ভাব ব্যঞ্জনাময় অনুভূতি চিত্রিত। গল্পের নামকরণেও সেই প্রতীকী ব্যঞ্জনা লক্ষ্য করার মতো। বৈষ্ণব গীতিকবিতায় নীল শাড়ী রাধার এবং পীতবসন কৃষ্ণের প্রতিভূ হয়েছে বারবার৷ এই গল্পতে “গোলাপি ওড়না”ও বিজয়ের কাছে এক অধরা সৌন্দর্য ও আবেগের প্রতীক। তার নিম্ন মধ্যবিত্ত খেটে খাওয়া জীবনে এই অনুভূতি অলৌকিক। একই সঙ্গে এই কাহিনীতে আছে আসাদ এবং রাজুর মতো চরিত্র যাদের কাছে মেয়ে মানেই শরীরী অস্তিত্ব। তিলোত্তমার ছোটগল্পের নির্মাণ, চরিত্র চিত্রণের স্বাতন্ত্র্য শক্তি, ভাষা ব্যাবহারের অপূর্ব নির্মমতা বিস্ময়ে স্তব্ধ করে দেয় পাঠককে।
“অতঃপর তিনি বিষ্ণুর পদপ্রান্ত হতে উৎসৃতা হলেন। আকাশগঙ্গা রূপে প্রবাহিতা মন্দাকিনী নাম্নী ওই তরঙ্গিনী মর্ত্যাভিমুখে প্রবল শক্তিতে ধাবিতা হলে তাঁর রূপালোকে দশদিশি ভরা অন্ধকার বিদূরিত হল। তাঁর  উল্লোল বিভঙ্গে দেবগণ বিমোহিত হলেন।” (রাজপাট,২০০৮) এই অপরূপ ভাষা পড়তে পড়তে যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে পাঠকের। “বসুধারা' উপন্যাসের জন্য আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। পেয়েছেন আরও অন্যান্য পুরস্কার তার সাহিত্যসাধনার স্বীকৃতি স্বরূপ। তবে একজন সাহিত্যিকের শ্রেষ্ঠ স্বীকৃতি যখন তাঁর অভিজ্ঞতা আর পাঠকের অভিজ্ঞতা তীব্রতায়, নীরবতায় অভিন্ন হয়ে যায়। তিলোত্তমা মজুমদার নিঃসন্দেহেই বাংলা সাহিত্যের আকাশে এক ভাস্বর সংযোজন। আশা করি এই লেখিকা আরও লিখবেন। আর পাঠক হিসেবে আমাদের অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র প্রসারিত ও সমৃদ্ধ হতে থাকবে।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register