প্রাণপ্রতিম ভাইয়ের মৃত্যুর শোকে আকুল হয়ে দৈত্যরাজ শুম্ভ দেবীকে বলল, “তুমি গর্ব করো না, কারণ তুমি অন্যের সাহায্যে এই যুদ্ধে জয়লাভ করেছ।” তখন দেবী বললেন,
একা আমিই এ জগতে বিরাজিত। আমি ছাড়া দ্বিতীয় কে আছে? রে দুষ্ট, এই সকল দেব দেবী আমারই বিভূতি। দ্যাখ্, এরা আমার দেহে বিলীন হচ্ছে।
অতএব এই ভাইরাস, এই অদৃশ্য প্রাণনাশী বীজাণু এও সেই আধারভূতা জগতস্তমেকা দেবী দুর্গারই অংশ। সেই স্থান ও কালের অতীত পরমাপ্রকৃতি ব্যতীত যখন আর কিছুই নেই তখন সকল দুষ্ট ও শিষ্ট তাঁরই বিভিন্ন রূপ। এই সংকটও তিনি, এর থেকে উদ্ধারের উপায়ও তিনি।
করোনার ক্রান্তিকালে, অদৃশ্য জীবাণুর মহাতাণ্ডবে জনজীবন পর্যুদস্ত। আমরা সকলেই কম বেশি গৃহবন্দী। কম বেশি দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত। নিজের জন্য। নিজের প্রিয়জনের জন্য। সামাজিক যোগাযোগ ছিন্ন হয়েছে। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত গৃহবন্দী জীবনযাপন করছি। মানুষ স্বভাবত সমাজবদ্ধ জীব। সমাজ ও সামাজিক জীবনে নিজেদের প্রকাশ ও ষ্ফুরণেই আমাদের বিকাশ। কিন্তু বহুদিন হল এক অবিশাষ্য কৃত্রিমতা আমাদের গ্রাস করেছে। দুয়ারে কড়া নাড়ছে দুর্গাপুজো। মাতৃশক্তির আরাধনার প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে আমরা অসহায়। কিন্তু সত্যিই কি অসহায়? এই দুঃসময়, এই অতিমারী কি আমাদের কিছু শিক্ষা দিয়ে যায় না? মানবসভ্যতার অভ্রংলিহ মিনার সকল যখন ধুলায় লুটোপুটি খাচ্ছে, সভ্যতার গৌরবমত্ত কপিধ্বজার অপ্রতিহত গতি হঠাৎই প্রতিহত, স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে পড়েছে আমাদের জয়রথ, আমাদের কৃত্রিম ব্যস্ততার বিরাট ঝুটো সত্তা হঠাৎ করে হাঁড়ি ফাটিয়ে প্রকাশ হয়ে পড়েছে, এই মানবসভ্যতার বুকে উদ্ধত ভৃগুর মত পদচিহ্ন এঁকে যাওয়া এই সংকটকাল আমাদের কি কিছু বলে যায় না? বলে যায় না কি এই নীলগ্রহ শুধুমাত্র তার শেষতম অধিবাসী দ্বিপেয় মানুষজাতির বসবাসের জন্যই শুধু নির্মাণ হয় নি? বলে যায় না কি লিভ অ্যান্ড লেট লিভ, বাঁচো এবং বাঁচতে দাও, এই মন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার সময় এসেছে। হয়তো আমাদের হতোদ্যম করে প্রকৃতির শ্বাস নেওয়ার সময় এসেছে।
বাবাই ওঠ। বাবাই? কি পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস? মহালয়া শুরু হয়ে গেছে।
উঠেছি তো মা। শুনছি। আধো ঘুমে জড়ানো গলায় বলি।
যা দেবী সর্বভূতেষু লজ্জারূপেণ সংস্থিতা
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমোঃ
মহালয়ার শেষ পর্বে দেবীর রূপমাহাত্ম্য বর্ণনা করছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। আলসি সূর্য এখনো উঠি উঠি। আজ ছুটি। শিউলির নরম সাদা ছড়িয়ে আছে জানলার বাইরে। গন্ধে গন্ধে কাণ্ডে জড়িয়ে আছে শুঁয়োপোকা। ওরা একদিন প্রজাপতি হবে জানি। ঠিক জানি, একটু পরেই মুঠো মুঠো শিউলি ফুল কুড়িয়ে নিয়ে আসব। মালা গেঁথে দেব ঠাকুরের পায়ে। বাবা তর্পণে বসবে। আমার পূর্বপুরুষ জল পাবে। কিন্তু সে দেখার সময় কোথায় আমার? আমি তো সারাদিন সাইকেলে জি টি রোড ধরে টইটুম্বুর। এবারে পুজোর ছুটি তে ছুটি ছুটি হবে তো? আগের বছর জয় বাবা ফেলুনাথ দেখিয়েছিল ছুটি ছুটি তে। এবারে কোন সিনেমা দেখাবে? ছ দিন পরেই তো ষষ্ঠি। ট্রেনে করে ফুরুত করে খড়গপুর থেকে রামরাজাতলা। তারপর প্যান্ডেল ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখা। খুরুট সঙ্ঘ, বারোয়ারী তলা, ক্যাঁচাল সঙ্ঘ, শঙ্করমঠ। শ্রাবণীর সঙ্গে দুর্গাপুজার অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে গিয়ে একবার চোখাচোখি। একটা হার্টবীট মিস। সকাল বিকেল নতুন জামা পরা আর দশমীর দিন সকাল থেকেই বুকের ভিতর ভারী। সন্ধেবেলা চিলেকোঠার ঘরে লুকিয়ে মা-য়ের চলে যাওয়ার দুঃখে লুকিয়ে এক ফোঁটা চোখের জল ফেলে আবার পাজামা পাঞ্জাবী পড়ে গুরুজনদের প্রণাম করে পাড়া বেড়ানো আর নিমকিটা, ঘুগনিটা সাঁটানো এই ছিল আমাদের ছোটোবেলার পুজো। আজ হয়তো পুজো বদলে গেছে। হয়তো বদলে যাওয়াই নিয়ম। পৃথিবীর একমাত্র ধ্রুব বুঝি পরিবর্তন। তবু মা আসেন। আমাদের হৃদয় ময়ূরের মতন নেচে আসে। হে শক্তিরূপিণী আমাদের এই সঙ্কট কাল থেকে রক্ষা করো। তোমার কাছে করজোড়ে অনুরোধ, আমাদের প্রজ্ঞা দাও। আমাদের সে শিক্ষা দাও যা আমাদের এই পৃথিবীর সাথে, এই প্রকৃতির সাথে সহাবস্থান করতে শেখায়।
এই সংখ্যায় সাহিত্যিক তিলোত্তমা মজুমদারকে নিয়ে লিখছেন রঞ্জিতা চট্টোপাধ্যায়। আমরা কবি সম্বন্ধীয় লেখা, কাব্যালোচনা, সাহিত্যালোচনা চাই আরো বেশি করে। আপনিও পাঠান আপনার গল্প, কবিতা, রম্যরচনা, ভ্রমণ কাহিনি, সাহিত্যালোচনা। কবি শৈবাল তালুকদার একজন নিভৃত কবি। পড়ুন তার আশ্চর্য দুটি কবিতা। কবি বিদিতা ভট্টাচার্যের কবিতাগুচ্ছও আপনাকে ভাবাবে।
পরিশেষে বলি, প্রতিবারের মতই এবারেও খুব অল্প লেখা রাখলাম যাতে কবি/লেখক হারিয়ে না যায়। তবে পত্রিকার মান তখনই থাকবে যখন কিন্তু আপনার সেরা লেখাটা আপনি আমাদের পাঠাবেন।
0 Comments.