Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

ছোটগল্পে আনোয়ার রশীদ সাগর

maro news
ছোটগল্পে আনোয়ার রশীদ সাগর

।। মাঠপেরিয়ে।।

খাঁ খাঁ রোদের ঝিলিক আকাশে-বাতাসে। থরথর কাঁপছে দূরের প্রকৃতি। একটু পা বাড়িয়ে, এই ভরদুপুরে মাঠের ধারে গেলাম।গরমে বুকপিঠ ঘামছিল। অথচ ঠাণ্ডা বাতাস এসে বুকটা জুড়িয়ে দিয়ে চলে গেলো। এত,এতকাল পর ওর সাথে দেখা! তাও এই মাঠের মাঝে ক্যানেলের ধারে। দীপা, তুমি এখানে? সেই আগের মত হাত বাড়িয়ে আঙ্গুল সোজা করে, দেখিয়ে বললো, ওইখানে আমরা বাড়ি করেছি। ধানের মাঠ পেরিয়ে ওই দূরে দেখা যাচ্ছে, দিগন্ত ছূঁয়ে কটা বাড়ি রয়েছে। কিছু নারিকেল গাছ আর লম্বা কিছু গাছের সবুজ পাতা দেখা যাচ্ছে। বললাম কবে থেকে,এখানে আছো। ও বললো, তা বছর চারিক। তে,তুমি এই দুপুরে রোদের মাঝে, এই মাঠের ধারে কী করছো? বললাম,ভালো লাগছিল না,তাই বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম। -বাসা,বাসা মানে? -দু'বছর আগে চাকুরিটা হয়েছে। প্রথম জোয়েন্ট করি রাজশাহীতে। এরপর এই আলমডাঙ্গাতে বদলি। ব্যাচেলার কোয়ার্টারে উঠেছি। -বউ ছেলেমেয়ে? - সে কপাল নিয়ে জন্মায়নি। চাকুরি হওয়ার পর বাবা পৃথিবী ছেড়ে গেলেন। তার ছ'মাস পর, মা'ও বিদায় নিলেন। এই ধাক্কা সামাল দিতে দিতেই, চলছে জীবনটা ঠেলাগাড়ির মত। বলতে বলতে আমার কণ্ঠ ভারি হয়ে আসে। দীপা হয়তো বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। তাই প্রসঙ্গটা অন্য দিকে টানার চেষ্টা করলো,এক সময় এসো আমাদের বাড়িতে। আমি অন্য মনস্ক হয়ে গেলাম। চেয়ে থাকলাম, বাতাসে দোল খাওয়া ধানের মাঠের দিকে। একটু দূরেই ভটভটভট শব্দ হচ্ছে। ধানের মাঠের পশ্চিম প্রান্তে, একটি কুঁড়ে ঘরের মধ্যে থেকে, শব্দটা বাতাসে কাঁপতে-কাঁপতে চলে যাচ্ছে দূরে কোথাও। ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ধানের মাঠ। কুঁড়ে ঘরের মধ্যে শ্যালোমেশিন বসানো রয়েছে। যশোর এমএম কলেজে, দীপা আমার এক ইয়ার নিচে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে পড়তো। আমি রাষ্ট্র বিজ্ঞানে ফাইনাল ইয়ারে পড়ি তখন। হঠাৎ একদিন দড়াটানা মোড়ে, বই কিনতে এসে, ওর সাথে পরিচয় হয়েছিল। তারপর মাঝে-মাঝে কথা হতো,দেখা হলে। প্রায়ই সালাম দিতো। এক সময় ওর আর আমার মধ্যে তুমি-আমি সম্পর্কটা হয়ে যায়। এরই কিছুদিন পর, ওর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকুরিটা হয়ে যায়। আর আমি হণ্যে হয়ে একটা চাকুরির জন্য ঘুরতে থাকি। প্রায় এক বছর আগে মাস্টার্স পাশ করে, যশোরে মেসে বসে থাকি। তারপর বাবার অসুস্থতার কারণে, খরচ বহন করতেই যশোর ছেড়ে ঢাকায় চলে যাই, চাকুরির জন্য। বেসরকারী বা কোম্পানী চাকুরি করে, লেখাপড়া করার চেয়ে, পৃথিবীতে কোন কষ্ট আছে বলে, আমি মনে করি না।সারাদিন কোম্পানীর কাজ করে এসে, ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। বই সামনে নিয়ে ঝিমাতাম। বই আর দেখা হতো না। যাহোক ভাগ্যক্রমে ঢাকায় যাওয়ার আগে, সমাজসেবা অধিদপ্তরে তৃতীয় শ্রেণির একটি চাকুরিতে পরীক্ষা দিয়ে গিয়েছিলাম।সেই চাকুরিটা তিন বছর পর হয়েছিল। তখন আমার সব আশা-ভরসা প্রায় শেষ।এত,এত বছরেও দীপার সাথে আর যোগাযোগ হয়নি বা আমিই লজ্জায় যোগাযোগ রাখিনি-শুধু চাকুরি না পাওয়ার কারণে। দীপা তো এইচএসসি পরীক্ষার সার্টিফিকেট দিয়েই প্রাইমারী চাকুরিটা পেয়েছিল। আর আমি তো মাস্টার্স পাশ সার্টিফিকেট দিয়েও, এমন একটা চাকুরি পাইনি। লজ্জায় আমার মাথা নত হয়ে গিয়েছিল।
দীপা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,কী ভাবছো এতো?- দুঃখ-কষ্ট নিয়েই তো জীবন। আমার বাবাও মারা গেছে। মায়ের সাথে থাকি, মা মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পায়, ভালোই চলে। বললাম,তোমার সংসার ছেলেমেয়ে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আমারও পোড়াকপাল। বাবার বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে করে, ঘরসংসার করার আগেই সেই মানুষটা মোটর সাইকেল দূর্ঘটনায় মারা যায়। কী আর করা,সেই শোক এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। -এখন? -জানি না। বলেই দীপা চলে গেলো,ওই দূরের মাঠ পেরিয়ে,মেঠোপথ ধরে। যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, তার পিছন দিয়ে রেললাইন আঁকাবাকা সমান্তরাল চলে গেছে।শুধু শব্দ হলো প-অ-অ-অ....।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register