Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব - ২১১)

maro news
দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব - ২১১)

পর্ব - ২১১

১৯৪৭ এ দেশ টুকরো হয়ে স্বাধীন হল। আর টুকরোগুলোর মধ‍্যে তৈরি হল চিরশত্রুতা। কারা এভাবে দেশটাকে টুকরো করতে পারল? শ‍্যামলী শুনেছে, কোচবিহার জেলায় "ছিটমহল" নামে একধরনের এলাকা বেশ কতকগুলো জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের নাকি ভারত বা বাংলাদেশ, কোনো রাষ্ট্রেরই নাগরিকত্ব জোটে নি। স্বাধীনতার পর আজ সাঁইত্রিশটা বছর কেটে গেল, এখনো দুটো দেশের সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ভাবার ফুরসৎ পেলেন না, এই অসহায় মানুষগুলোর সমস‍্যা কি করে মেটানো যায়। দেশের কর্তৃপক্ষ বদলে গেল। কিন্তু দেশের পুলিশ মিলিটারির আচরণ বদলালো না। বাবা গল্প করতেন কলকাতা ঘোরার। ব‍্যবসার কাজে ট্রেনে চড়ে ব‍্যাণ্ডেল। সেখান থেকে গঙ্গা পেরিয়ে নৈহাটি। নৈহাটি থেকে শিয়ালদা। কলেজ স্ট্রিটের কাছে শ্রীমানী মার্কেট। সেখানে বল বেয়ারিঙের পাইকারি বাজার। বাবা তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। কলেজ স্ট্রিটে ব‌ইয়ের বাজার। তারপর কলকাতা মেডিকেল কলেজ। সেখানে চিকিৎসা সরঞ্জামের বাজার। তারপর বাথরুম ফিটিংস এর বাজার। তারপর বৌবাজার মোড়ে কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটে ছানার বাজার। বৌবাজারে গহনা আর ফার্নিচার এর বাজার। ওয়েলিংটনের দিকে গেলে রেলিংয়ের বাজার। পোদ্দার কোর্টে ইলেকট্রিক সরঞ্জামের বাজার। ক‍্যানিং স্ট্রিটে ....
বাবা বলে যাচ্ছিলেন। শ‍্যামলী তখন ক্লাস এইটে পড়ত। বৌ বাজারে এক কোণে একটা ছোট্ট স্মৃতিস্তম্ভ। নাম লেখা আছে লতিকা, প্রতিভা, অমিয়া, গীতা... ১৯৪৯ সালে পুলিশের গুলিতে মৃত মেয়েরা। ১৯৪৯। তার মানে দেশ ছেড়ে ইংরেজরা বিদায় নিয়েছে। চারপাশে স্বাধীনতার টাটকা বাতাস থাকার কথা ছিল। হয় নি। বাতাসে বারুদ গন্ধ ছড়িয়ে গেল। স্বাধীন দেশের মেয়েরা মানুষের মতো বাঁচার দাবি করে প্রকাশ‍্য রাজপথে পুলিশের গুলি খেয়ে মরল। স্বাধীনতার স্বাদ। তখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়। সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রতিভাবান ও প্রবাদপ্রতিম ডাক্তার বিধান রায়। তাঁর শাসনকালে পুলিশ গুলি করল মেয়েদের মিছিলে।
সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা,
তাহাদের তরে মায়ের, বোনের, ভায়ের চরম ঘৃণা
ওরা গুলি ছোঁড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবীকে রোখে
ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই সারা বাংলার বুকে
ওরা এদেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।।
তুমি আজ জাগো তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি
আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী
আমার শহীদ ভায়ের আত্মা ডাকে
জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাটে
কয়েকটি দিন আগেই অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী শ‍্যামলী স্টেজে উঠে আবৃত্তি করে ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে। নিচে দর্শকাসনে অনেকের সাথে তার অভিভাবক হিসেবে দিদি ছিল। বৌ বাজারে ওই স্মৃতিস্তম্ভে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে চোখে জল এসেছিল মেয়ের। বাবা বলেছিলেন, কি হয়েছে রে? চোখে বালি পড়ল বুঝি?
একুশে ফেব্রুয়ারি কবিতাটা ১৯৫২ সালের ওই ২১ ফেব্রুয়ারিতে লিখেছিলেন কবি ও সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী। আবৃত্তি করার আগে স্টেজে টানটান দাঁড়িয়ে এই তথ‍্যটা শ‍্যামলী বলেছিল । আরো বলেছিল, এই কবিতাটিতে প্রথম সুরারোপ করেন আবদুল লতিফ। পরে সুর করেন আলতাফ মাহমুদ। আলতাফ সাহেবের করা সুরটা জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
এসব তথ‍্য আবৃত্তি করতে উঠে কেউ বলত না। কোনোমতে মুখস্থ করা একটা জিনিস তোতাপাখির মতো উগরে দিতে পারলে হল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি লেখায় বলেছেন, একটি ছাত্র "রিভার" শব্দের সংজ্ঞা চমৎকার মুখস্থ বললে, নদীর ধারে দাঁড়িয়ে প্রশ্নকর্তা জানতে চেয়েছিলেন, ছেলেটি কখনো "রিভার" দেখেছে কি না। কুলকুল করে নদীর বহে  যাওয়া দেখতে দেখতে ছেলেটি বলেছিল, না।
স্বাধীনতা ও দেশভাগের বছরেই পাকিস্তানের শাসকেরা বাঙালির প্রতি জঘন্য দুর্ব‍্যবহার শুরু করেন। পূর্ব ও পশ্চিম মিলিয়ে গোটা পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৫৪% ছিল বাঙালি। কিন্তু তাদের মুখের ভাষা ব‍্যবহারের আইনি অধিকার কেড়ে নিয়ে গায়ের জোরে উর্দূ চাপিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ। ছাত্ররা এটা মেনে নেয় নি। ১৯৪৭ ডিসেম্বর এর ৮ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক‍্যাম্পাসে ছাত্র সমাবেশ থেকে জোরদার প্রতিবাদ ওঠে। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি, বাংলা ক‍্যালেণ্ডারে ১৩৫৮ সালের ৮ ফাল্গুন, সরকারের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে ছাত্রেরা ১৪৪ ধারা অমান্য করে। তাতে পুলিশ গুলি ছোঁড়ে। সেই গুলিতে নিহত হয় সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত। আহত হয় অনেক ছাত্র। পুব বাংলার আইনসভায়, মনোরঞ্জন ধর, বসন্তকুমার দাস, শামসুদ্দিন আহমেদ এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সহ ছয় বিধায়ক মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে আহত ছাত্রদের দেখতে হাসপাতালে যাওয়ার দাবি জানান এবং শোকের চিহ্ন হিসেবে গণপরিষদ মুলতবির দাবি করেন।মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, শরফুদ্দীন আহমেদ, শামসুদ্দীন আহমেদ খন্দকার এবং মশিউদ্দিন আহমেদ সহ সরকারি দলের কিছু সদস্য সমর্থন দেন। তবে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায়; এতে সালাম,  বরকত,  রফিক,  জব্বার প্রমুখ ছাত্র হতাহত হয়। সেসময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফফার চৌধুরী ঢাকা মেডিকেলে যান আহত ছাত্রদের দেখতে। ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান, যেটি ছিল ভাষা সংগ্রামী রফিকের লাশ। লাশটি দেখে তাঁর মনে হয়, এটা যেন তার নিজের ভাইয়েরই রক্তমাখা লাশ। তৎক্ষণাৎ তাঁর মনে গানের প্রথম দুইটি লাইন জেগে উঠে। পরে কয়েকদিনের মধ্যে ধীরে ধীরে তিনি গানটি লিখেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রকাশিত লিফলেটে এটি 'একুশের গান' শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত 'একুশে সংকলনে'ও এটি প্রকাশিত হয়
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আগে বিশিষ্ট অতিথি হিসেবে আসা এক অচেনা ব‍্যক্তি তাঁর বক্তব্যে এসব বলেন। শ‍্যামলী যে যৎসামান্য হলেও কবিতাটি নিয়ে কিছু তথ‍্য দিতে চেয়েছে এই চেষ্টাটাকে তিনি প্রশংসা করেছিলেন।
কিন্তু  বৌ বাজারে লতিকা, প্রতিভা, অমিয়া গীতাদের স্মৃতিস্তম্ভে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শ‍্যামলী কিছুতেই বুঝতে পারে নি, লতিকা প্রতিভা অমিয়া গীতাদের নিয়ে তেমন কোনো কবিতা এই বাংলাতেও লেখা হল না কেন!
বড়ো হয়ে, কলেজে ভর্তি হবার পর খোঁজ খবর নিয়ে শ‍্যামলী জেনেছে, স্বাধীনতার পর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু করলে, দাঁতে নখে বদলা নেয় শাসক কংগ্রেস সরকার।
পশ্চিমবাংলায় তখন বিধান রায়ের শাসন চলছে।
পুলিশের হাতে বন্দী হয় শত শত কমিউনিস্ট কর্মী। এমনকি কারাগারের ভিতরেও বন্দিদের উপর গুলি চালাতে বিধান রায়ের পুলিশ দ্বিধা করে নি। দমদমে জেলের অভ‍্যন্তরে নিহত হন কৃষক কর্মী প্রভাত কুণ্ডু ও ছাত্রকর্মী সুশীল চক্রবর্তী। স্বাধীন দেশের নাগরিকদের উপর এই অমানুষিক পুলিশি বর্বরতার প্রতিবাদে সারাদেশে সাধারণ মানুষ ধিক্কার জানাতে শুরু করে। মহিলারাও পিছিয়ে ছিলেন না। পুলিশি বর্বরতার প্রতি নিন্দা জানাতে ১৯৪৯ সালের সাতাশ এপ্রিল নিখিলবঙ্গ মহিলা সমিতির উদ্যোগে বৌ বাজার স্ট্রিটে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় যোগ দিয়েছিলেন হাওড়া হুগলি চব্বিশ পরগণার প্রত‍্যন্ত গ্রাম থেকে আসা অনেক মহিলা। এসেছিলেন কলকাতার বস্তিবাসী আর মধ‍্যবিত্ত মহিলারাও। বৌ বাজার কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে আন্দোলনরত মহিলাদের মিছিলকে প্রতিহত করতে বিধান রায়ের পুলিশ গুলি ছোঁড়ে।
স্বাধীন দেশে রাজনৈতিক বন্দিমুক্তির দাবিতে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন লতিকা সেন, প্রতিভা গাঙ্গুলি, অমিয়া দত্ত, গীতা সরকার। মারা যান আরো এক যুবকর্মী বিমান ব‍্যানার্জি।
লতিকা সেন, বিয়ের আগে ছিলেন লতিকা দাশ। পূর্ববঙ্গের মেয়ে। সেখানকার মুনশিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের কন‍্যা। লতিকার জন্ম ১৯১৩ সালের ২৮ মে। তাঁর বাবা নিবারণচন্দ্র দাশ ও মা কিরণবালা দাশের শিক্ষায় লতিকারা সব কয়জন ভাইবোনেই অন‍্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন।
পরাধীন দেশে ভাইবোনের মধ‍্যে সবার বড় সুনীল আন্দোলন গড়ে তুলতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বন্দি ছিলেন। ১৯৩২ সালের জুন মাসে আরেকটি ভাই অনিলকুমার ইংরেজ শাসকের পুলিশের বর্বর নির্যাতনে কারাগারের মধ‍্যে মৃত্যু বরণ করেন। অনিলকুমারের মৃত্যুর কিছু দিনের মধ্যে কনিষ্ঠ ভাই পরিমলও ব্রিটিশ পুলিশের হাতে শহীদ হন। ১৯৩৫ সালে লতিকা, তখন বছর বাইশের তরুণী , তাঁর মা কিরণবালা দাশের সঙ্গে কলকাতায় চলে আসেন। পর বৎসর লতিকা কমিউনিস্ট পার্টির সদস‍্যপদ লাভ করেন। তিনি কলকাতার ভবানীপুরের বেলতলা গার্লস স্কুলে শিক্ষকতা করতে ন। কমিউনিস্ট সংশ্রবের দায়ে লতিকা শিক্ষকতার চাকরিটি হারান।
১৯৪৯ সালে বছর ছত্রিশের লতিকা মেয়েদের প্রতিবাদী মিছিলের পুরোভাগে দাঁড়িয়ে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। লতিকার ভাই অনিলকুমার আর পরিমল শহীদ হয়েছিল ইংরেজের পুলিশের হাতে। আর সতেরো বছর পরে লতিকা শহীদ হলেন স্বাধীন দেশের পুলিশের হাতে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তখন সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রতিভাবান ও প্রবাদপ্রতিম ডাক্তার বিধান রায়।
জীবনানন্দ দাশ শ‍্যামলীর কানে কানে বলতে থাকেন,
যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হ’য়ে
ব’লে যাবে কাছে এসে, ‘ইয়াসিন আমি,
হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ—
আর তুমি?’ আমার বুকের ’পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে
চোখ তুলে শুধাবে সে— রক্তনদী উদ্বেলিত হ’য়ে
বলে যাবে, ‘গগন, বিপিন, শশী, পাথুরেঘাটার;
মানিকতলার, শ্যামবাজারের, গ্যালিফ স্ট্রিটের, এন্টালীর—’
কোথাকার কেবা জানে; জীবনের ইতর শ্রেণীর
মানুষ তো এরা সব; ছেঁড়া জুতো পায়ে
বাজারের পোকাকাটা জিনিসের কেনাকাটা করে;
রাস্তার ধারে বসে দুই হাঁটুর মধ‍্যে মুখ গুঁজে শ‍্যামলী হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে, কোন্ এক অচেনা অজানা লতিকা প্রতিভা অমিয়া গীতা ইলা অর্চনার জন‍্য। চাঁদ চুপ করে দেখতে থাকে।

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register