Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব - ২০৮)

maro news
দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব - ২০৮)

পর্ব - ২০৮

শ‍্যামলীর মনে পড়ে কেন জোয়ান মেয়েটা পুরুষের পোশাক পরেছিল। নারীর শরীর ভীষণ ভাবে লোভের শিকার। শত্রু এলাকার মধ‍্য দিয়ে যাবার সময় লোকজনের লালসাপূর্ণ দৃষ্টি থেকে নিজের নারীশরীরের উচ্চাবচতা, পেলবতা আড়াল করার বাস্তবিক প্রয়োজন ছিল জোয়ানের। পুরুষের পোশাক, তার আঁটোসাঁটো বাঁধুনি, যে সুরক্ষা দিতে পারে, সে সব দিনের প্রথানুগত মেয়েলি পোশাকে তা নিশ্চিত করা শক্ত হত। বাস্তব অভিজ্ঞতাকে মাথায় নিয়ে জোয়ানের পরনে ছিল পুরুষালি পোশাক। ইংরেজের কারাগারে বন্দিত্বের সময়ে তার সমস্ত পোশাক কেড়ে নিয়ে তাকে বেআব্রু করে রেখেছিল রক্ষীরা।
শ‍্যামলীর মনে পড়ে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির নেত্রী রোজা লুক্সেমবার্গ এর কথা। তাঁকে আরেক জন কমিউনিস্ট নেতা কার্ল লিবনেক্ট এর সাথে অত‍্যাচার করে মারা হয়।
একবার নাকি রোজাকে ধরে সমস্ত পোশাক খুলিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়েছিল নাৎসি বাহিনী। শোনা কথা। পরে এক সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেছিল, আপনার অস্বস্তিবোধ হয় নি, আপনাকে অমন করে সব পোশাক খুলিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল?
চমৎকার একটি উত্তর দিয়েছেন রোজা। লজ্জা কেন করবে? মানুষ লজ্জা পায় মানুষের কাছে। কুত্তাদের কাছে লজ্জা কেন করবে?
এদেশের কমিউনিস্ট সংগঠক নেত্রী ইলা মিত্রের কথাও মনে পড়ে শ‍্যামলীর। কলকাতার বেথুন কলেজের ডাকাবুকো ছাত্রী ইলা সেন। বিয়ের পর মিত্র।
১৯২৫ সালের অক্টোবরে জন্মেছিলেন ইলা। এখনো এই ১৯৮৪ তেও তিনি বেঁচে আছেন। ১৯৪৪ সালে বিএ পাশ করেন। বাংলা সাহিত্যে অনার্স। ওঁর  পিতৃকুলের আদি বাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গের ঝিনাইদহ জেলায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় ঝিনেদার জমিদারের কথা মনে পড়ল। জমিদার বাড়ির বৌরাণী হলেন ইলা। তাঁর স্বামী রামচন্দ্রপুরের জমিদার রমেন্দ্রনাথ মিত্র। কিন্তু জমিদার হলে কি হবে রমেন্দ্রনাথ গরিব মানুষের মুক্তি আন্দোলনের সংগঠক। ছিলেন মালদা জেলার কৃষকসভার প্রেসিডেন্ট। তখন চাষিরা তেভাগা আন্দোলন গড়ে তুলছে। অনেক চাষিই অন‍্যের জমিতে সারাবছর হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে ফসল ফলায়। অথচ পরিশ্রমের যথেষ্ট মূল‍্য তারা পায় না। তেভাগা আন্দোলনে চাষি দাবি করল উৎপাদিত ফসল তিন ভাগ হবে। একভাগ পাবে জমির মালিক, রায়ত। আর বাকি দুইভাগ চাষির, যে খেটেখুটে যোগাড়যন্ত্র করে ফসল ফলিয়েছে। কিন্তু এই একান্ত ন‍্যায়সঙ্গত দাবিটিও সদ‍্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ মেনে নেন নি। ভারত ও পাকিস্তান, দুটি দেশের স্বাধীনতাই যে কতদূর সীমিত ও যৎসামান্য ছিল, চাষির এই আন্দোলনে পুলিশি নির্যাতন তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল।
 তেভাগা আন্দোলনকে দমন করতে উদ‍্যত হয়েছিল ভারত এবং পূর্ব পাকিস্তানের শাসকেরা। অজস্র চাষিপরিবারের রক্ত ও অশ্রুর বিনিময়ে পরে জমিদারি উচ্ছেদ আইন ও ভূমিসংস্কার আইন আসে। শ্রেণীগত অবস্থানে জমিদার হয়েও যাঁরা চাষির স্বার্থে ভেবেছেন, তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অগ্রগণ‍্য। আর সদ‍্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে ইলা ও রমেন্দ্রনাথ মিত্র চাষির আন্দোলন গড়তে জীবনপণ করলেন।
এর মধ‍্যেই ইলার পেটে সন্তান এসেছে। ১৯৪৮ সালে পুত্র মোহনকে জন্ম দিয়েই রামচন্দ্র পুরে শাশুড়ি মায়ের হাতে তার দায়ভার তুলে দিয়ে তিন চার সপ্তাহের মধ্যে আবার আন্দোলনের ময়দানে ফিরে যান ইলা। দেশভাগের ফলে অবিভক্ত মালদা জেলার  পাঁচ পাঁচটি থানা এলাকা গিয়ে পড়ল পূর্ব পাকিস্তানের এলাকায়। অদ্ভুত এই ভারত বিভাগ। কার উর্বর মস্তিষ্কের ফসল এটা কে জানে!
মালদা জেলা থেকে ছিঁড়ে নিয়ে নাচোল সহ পাঁচটি থানা এলাকা গিয়ে জুড়ল পূর্ব পাকিস্তানের রাজশাহী জেলায়। ইলার শাশুড়ি সিদ্ধান্ত নিলেন প্রজার স্বার্থে তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানে থাকবেন। মুসলমান প্রজাদের মনে ভরসা জোগাতে প্রজাবৎসল রমেন্দ্রনাথ মিত্র পাকিস্তানের পতাকাও উত্তোলন করেন। ইলা ও রমেন্দ্রনাথ দুজন মিলে চাষির তেভাগা আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন। ১৯৫০ এর জানুয়ারি মাসের পাঁচ তারিখে চাষির দাবি মেনে নেওয়ার ডেড লাইন দেওয়া হয়। চাষিরা ঘিরে ফেলে নাচোল থানা। তাদের উদ্ধার করতে সাত জানুয়ারি, ১৯৫০ তারিখে দুহাজার সৈন‍্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘরে ঘরে ঢুকে তারা চাষির উপর হামলা শুরু করে। মেয়েদের উপর শ্লীলতাহানি ও যৌন নির্যাতন শুরু হয়। পুলিশের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল আনসার বাহিনী।
রমেন্দ্রনাথ ও ইলা দুটি আলাদা আলাদা চাষিদলকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। প্রবল মিলিটারি আক্রমণে দুজনে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। রমেন্দ্রনাথ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। সাঁওতাল রমণীর পোশাক পরে সাঁওতালি  আদিবাসীর ভাষায় কথা বলতে বলতে মিলিটারির চোখে ধুলো দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে যেতে গিয়ে ধরা পড়লেন প্রজাদের আদরের রাণীমা, ইলা মিত্র।
তারপর নাচোল থানায় চারদিন ধরে আটকে রেখে তথ‍্য আদায়ের নামে পুলিশের হাতে নিদারুণ যৌন অত‍্যাচার।
বন্দিনী মেয়ের উপর যৌন অত‍্যাচার করতে পুলিশ মিলিটারি কোনোদিন পিছপা হয় নি। ওটা শাসকের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। যোসেফ স্ট‍্যালিন পর্যন্ত পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে সমাজতন্ত্রের ধ্বজা ওড়ানোর নেশায় এ ধরনের কাজে মদত দিয়েছেন।  ধর্মীয় আদালতে জোয়ান জানিয়েছিল, কারাগারে তাকে বিবস্ত্র করে রাখা হয়েছিল। আর একদিন এক রাজপুরুষ তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। তরুণীর বিবসন শরীর নিয়ে রাজপুরুষেরা কি করে রুনু গুহনিয়োগীরা ভাল জানেন। শ‍্যামলীর মাথায় আগুন ছুটতে থাকে। দুদিন আগেই মাঝরাতে মায়ের কাছে শুয়ে তলপেটে ব‍্যথা অনুভবের কথা আর বালথাজার ফিল্মের কথা উঁকি মেরে যায়।

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register