Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব - ২০৭)

maro news
দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব - ২০৭)

পর্ব - ২০৭

চার্চের আয়োজনে মামলায় ঊনিশ বছরের মেয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে, সে ধর্মদ্রোহী। আসলে চার্চের বকলমে ইংল্যাণ্ড সদ‍্যোতরুণী মেয়েটির মৃত্যু নিশ্চিত করতে চাইছে। ও মেয়ে যে ইংলিশ অহমিকার মুখে ঝামা ঘসে দিয়েছে। দিনের পর দিন ফ্রান্সের সাধারণ মানুষ স্বপ্ন দেখে গিয়েছে অজ পাড়াগাঁ থেকে একটা মেয়ে উঠে আসবে। সেই বাঁচাবে ফ্রান্সকে। বুড়োরা ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে ন‌ওজোয়ানদের বুকে সেই স্বপ্ন বুনে দিয়েছে। আর গেঁয়ো মেয়ে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের বাহিনীর সাথে রাজার দেওয়া বর্ম আর অস্ত্র নিয়ে যেই না এসে সাধারণ সেনানীদের সামনে এসে দাঁড়ালো, অমনি বুড়োদের মুখে মুখে শোনা প্রাচীন গল্প জেগে উঠল তরুণ প্রাণে। এই তো সেই দেবী, শক্তিস্বরূপিণী, শত্রুসংহারকারিণী, তেজোময়ী, বিঘ্নবিনাশিনী। ফ্রান্সের সেনানীরা গেয়ে উঠল, মাতা, তোমাকে বন্দনা করি। নব উদ্দীপনায় দীপ্ত তারা। এরপর শুধু ইতিহাস। পূর্ব গগনে বাজে জয়ভেরী, জয়ডঙ্কা। নতুন প্রাণশক্তিতে জেগে উঠল ফ্রান্স। আর পেতে লাগল জয়। একের পর এক রণাঙ্গনে ইংল‍্যাণ্ড পড়ল বিপর্যয়ের মুখে। তাই ইংল‍্যাণ্ড তো এ মেয়েকে ছাড়বে না। তাকে যতো রকমে যতোদূর হেয় করা যায়, ততোদূর হেয় করে মৃত‍্যুদণ্ড দেবে। ইংল‍্যাণ্ড এই যুদ্ধবন্দীকে এমন ভয়ঙ্কর শাস্তি দেবে যে চিরশত্রু ফ্রান্স জীবনে সেই অপমান ভুলতে পারবে না। আসলে জোয়ানের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করাটা ইংল‍্যাণ্ডের সর্বোচ্চ মহলের পলিটিক্যাল দায়। যে করেই হোক, চার্চকে পকেটে পুরে নিয়ে জোয়ানের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করো। তার জন‍্য যা করতে হয় তাই করো। নিয়মকানুন মানার সময় এটা নয়। ইজ্জত রক্ষার জন‍্য সভ‍্য নিয়মকানুন ভুলতে ইংরেজদের বাধে না। ইংরেজরা রণাঙ্গনে মীরজাফর খুঁজে নিতে জানে। আর অনেক সময়েই অশক্ত অসুস্থ ভীত সন্ত্রস্ত নেতৃত্ব নিজের আর পরিবারের সদস্যদের বেঁচে থাকার তাগিদে আত্মসমর্পণের কথা ভাবে। আত্মসম্মানবোধ খুইয়ে জীবশরীরটুকুর  বেঁচে থাকাকে প্রাধান্য দেয়।
 যুদ্ধ জিততে জিততেও ফ্রান্সের একপক্ষের দোদুল্যমান অবস্থান লক্ষ্য করেছিল জোয়ান। কৌশলগত কারণ নাম দিয়ে ইংল‍্যাণ্ডের সাথে যুদ্ধবিরতি হয়েছিল।  একা জোয়ানের কিছু করার ছিল না। তবুও সে ফুঁসে উঠতে চেয়েছিল। আবার শুরু হল যুদ্ধ। একজায়গায় তার পায়ে কঠিন আঘাত হয়েছিল। ট্রেঞ্চে অনেকক্ষণ লুকিয়ে থাকার পর নিজের দলের লোকজন তাকে উদ্ধার করে। ১৪৩০ সালের তেইশে মে জোয়ানকে ঘিরে ফেলল একদল ইংরেজ তীরন্দাজ বাহিনী। তীর বিঁধল  বর্ম পরা জোয়ানের ঘাড়ের কাছে। একটু কাবু হয়ে পড়া মেয়েটাকে ঘোড়া থেকে হিঁচড়ে টেনে নামাল এক তীরন্দাজ। শত্রুবাহিনী তাকে ধরে নিয়ে চলল ।
 বন্দিনী জোয়ান বেশ কয়েকবার পালাবার উদ্যোগ নিয়েছিল। একবার তো সে প্রায় সত্তর ফুট উঁচু থেকে জলার কাদায় ঝাঁপিয়ে ছিল। এরপর ইংরেজরা আর কোনো ঝুঁকি নেয় নি। রুয়েঁ শহরেতে , যেখানে ইংল‍্যাণ্ড অধিকৃত ফ্রান্সের শাসনকেন্দ্র, সেখানেই ১৪৩১ সালের ৯ জানুয়ারি বিচার অথবা অবিচার সাজানো হল জোয়ানের বিরুদ্ধে।
 কতো রকম দ্বিচারিতা জানে ইংরেজরা। পোষা একটা বিশপ, একলেসিয়াসটিকাল আইন বা চার্চের আইনে যার সেই জায়গায় বিচারের একতিয়ারটাই নেই, তেমন একটা বিশপকে রাখা হল বিচারসভার শীর্ষে। এই লোকটা আসলে ইংরেজ শাসকের পায়ে তৈলমর্দন করে বিশপের চেয়ার বাগিয়েছিল।
বিচার যে করতে হবে, তার জন‍্য প্রাথমিক ভাবে একটা অপরাধ খুঁজে বের করা দরকার করে। জোয়ানের বিরুদ্ধে তেমন প্রাথমিক অপরাধটুকুই খুঁজে পেলেন না চার্চের নোটারি নিকোলাস বেইলি।
বিচারপতিদের মধ‍্যে বাছাই করে ইংল‍্যাণ্ডের আর বার্গাণ্ডির ধর্মনেতাদের রাখা হল। ফ্রান্সের ধর্মনেতারা জায়গাই পেলেন না। জোয়ানকে ইংরেজরা ভয়ঙ্করতম শত্রু হিসেবে গণ‍্য করেছিল। অথচ  বাস্তবে ও মেয়ে অস্ত্র নিয়ে রণাঙ্গনে নেমেছিল কি না, সে নিয়ে ইতিহাস বিশেষজ্ঞরা দ্বিমত পোষণ করেন। এমনকি সে মেয়ে সৈন্যদল পরিচালনা করত, এমন দাবিও প্রশ্নাতীত নয়। জোয়ান নিজে বলেছে, সে যুদ্ধক্ষেত্রে একজন সৈন্যকেও আঘাত করে নি, হত‍্যা তো দূরের কথা। জোয়ান আরো বলেছে, তার হাতে শুধুমাত্র পতাকাটুকুই ছিল, কেননা সে মনে করত, তার পতাকা চল্লিশখানা তরোয়ালের চাইতেও বেশি কার্যকরী। বাস্তবে সৈন্যদের পরিচালনা করতেন অভিজাতরা। কিন্তু পতাকা হাতে জোয়ানের উপস্থিতিই সেনাবাহিনীর মধ‍্যে মত্তহস্তীর বল যোগাত। অভিজাতরা জোয়ানের পরামর্শ নিতেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, জোয়ানের মধ‍্য দিয়ে ঐশী শক্তি কথা বলে।
কিন্তু একটা ব‍্যাপারে ইতিহাসবিদদের মধ‍্যে ঐকমত্য রয়েছে যে, জোয়ানের স্রেফ উপস্থিতিই সেনাবাহিনীকে দুর্মর সাহস যুগিয়ে দুর্ধর্ষ করে তুলত।
এহেন জোয়ানের বিরুদ্ধে ইংরেজের তর্জনীচালিত ধর্ম আদালত অভিযোগ আনল  ধর্মদ্রোহিতার। অথচ মুশকিল ছিল যে শুধুমাত্র ধর্মদ্রোহিতার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না। চার্চের আইনে তা বলে না। ধর্মদ্রোহিতার সাথে আরো কিছু অপরাধের বোঝা চাপিয়ে দিতে পারলে তবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায়। ইংরেজের পোষা ধর্ম আদালত জোয়ানের বিরুদ্ধে পুরুষদের পোশাক পরার মতো অপরাধের মামলাও তুলল। মেয়ে হয়ে পুরুষের পোশাক পরা? ছি ছি, সে যে ভয়ানক ধর্মবিরোধী কাজ!
আচ্ছা, আমি কেন জোয়ান অফ আর্কের কথা এত ভাবছি? শ‍্যামলী ভাবতে বসল।
লম্বা লম্বা গাছেরা চাঁদের আলোয় মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে প্রশ্ন করল, কেন শ‍্যামলী, জোয়ানকে নিয়ে তোমায় এত আকাশ পাতাল ভাবনা পেয়ে বসল কেন?

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register