Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

কবিতায় আকিব শিকদার

maro news
কবিতায় আকিব শিকদার

১। দুটানায় দিনযাপন

বাবার ক্যান্সার।  গলায় ব্যান্ডেজ, ব্যান্ডেজে রক্ত। এগারোটি থেরাপিতে চুল সাফ। চামড়ায় কালো দাগ। বিদেশে নিয়ে ভালো ডাক্তার দেখালে হতো। টাকা কোথায়...
বউকে ডেকে জানতে চাই- “কী করতে পাড়ি?” বউ বলে- “যা ভালো মনেহয় করো।” বাবা যখন যন্ত্রণায় কুকিয়ে উঠে, চিংড়ি মাছের মতো দলা পাকিয়ে যায়, বড়ো মায়া হয়। সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়িটা বেচে দেবো। কিন্তু, বউ সন্তান নিয়ে থাকবো কোথায়! এদিকে বাবার মৃত্যু যন্ত্রণা, ওদিকে একমাত্র ছেলেকে অকুল সাগরে ফেলা। চিকিৎসার অভাবে বাবা মরলে লোকে বলবে- “কেমন ছেলে! বিনাচিকিৎসায় বাবাকে মারলো।” বাড়ি ভিটা বেচে দিলে কুৎসা রটবে- “কেমন বাপ! সন্তানের কথা ভাবলো না!”
অসুস্থ বাপ বাড়ি বিক্রির গুঞ্জন শুনে বলেছিলো- “আমি আর কদিন! তোরা সুখে থাক বাবা, নাতিটার খেয়াল রাখিস।” কার খেয়াল রাখবো, নাতিটার? নাকি অসুস্থ বাবার? ভাবতে ভাবতে কাচের গ্লাসে বেলের শরবতে চামচ নাড়ছিলাম। হাত পা কাপছে, মুখ ঘামছে। শরবতে তিন ফোটা বিষ মিশিয়ে দিয়েছি আমি। তিব্র বিষ, মুখে নিলে মৃত্যু। মনেপড়লো ছোট বেলায় ম্যালেরিয়া জরে সতেরো দিন ছিলাম হাসপাতালে। চিকিৎসার খরচ যোগাতে বাবা তার প্রিয় মোটরসাইকেলটি বেচে দিয়েছিলো। কই.. একবারও তো বিষমাখা চকলেট খাইয়ে মেরে ফেলার কথা ভাবেনি। হাতের চামচ থেমে গেলো। বাবার বানানো বাড়ি ভিটা বেচেই বাবাকে বাচাবো। পরক্ষনে মনেপরলো ছেলের পড়াশোনা, বউয়ের আবদার, সংসারের নানা খরচ।
বেলের শরবতে বিষ। না... বাবার হাতে কিছুতেই বিষের গ্লাস ধরিয়ে দিতে পারবো না। বাবা কতো স্নেহে মানুষ করেছে আমাকে। শহরে রেখে শিক্ষিত করেছে, মোটা অঙ্কের ঘুষে চাকরী জুটিয়েছে, তার হাতে তুলে দেবো বিষের গ্লাস! বিষমিশ্রিত শরবত পিরিচে ঢেকে বাবার বিছানার পাশে রেখে চলে গেলাম দুর। যেন কিছুই জানি না, জানতেও চাই না। যেন বাড়ি থেকে পালাতে পারলেই বাচি, এমনকি পৃথিবী থেকেও...
আমার ছেলেটা গিয়েছিলো বাবাকে ঔষধ খাওয়াতে। রুগির পথ্য আপেল কমলা আঙুরের বেশি অংশ নাতিকে সস্নেহে খেতে দিতো বাবা, আজ দিলো শরবত ভরা গ্লাস। নাতি এক চুমুক মুখে নিয়েই মেঝেতে ঢলে পড়লো। তারপর... বাবা বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, ছেলে মেঝেতে পড়ে আছে নিস্তেজ। কী করবো! হায়... কোন দিকে যাবো আমি...!

২। টাইম ফুল

বারান্দার ঝুলন্ত টবে ফুটেছে টাইম ফুল। ঘাসের ডগায় গোলাপ-আকার মেরুন ফুলগুলো সকাল দশটায় ফুটে, চুপিসারে চুপসে দুপুরের প্রথম ভাগেই। এই ফুল আমাদের উঠোনে, ভিটের পাশে যেখানে টিনের চালের পানি ঝরে, সেখানে ফুটতো অনেক। বাবা, তখন সাইকেল হাতে দাড়াতে আঙিনায়। ক্রিংক্রিং বেল বাজিয়ে বলতে- ‘দেড়ি হয়ে গেলো, কৈ-রে..! আয় তারাতাড়ি’। আমি বইপত্র গোছানোতে ব্যাস্ত, আর মা আমার চুলে বাধছেন ঝুটি চিরুনী চালিয়ে- তারপর দুটো ক্লিপ। বাবা তুমি প্রাইমারী মাস্টার, আমি তোমার স্কুলে ছাত্রী চতুর্থ শ্রেনীর। উঠোনের কোন থেকে দুটো ফুল ছিড়ে কানে গুজে ছুটলাম, সাইকেলে উঠলাম। তখন মায়ের গলা- ‘গ্লাসভরা দুধ, খেয়ে তো গেলি না ?’ আমাদের ছাই রঙা গাভীটা দিতো দুধ এক হাড়ি, আর তার বাছুর কে রাখতো পরিপাটি জিহ্বায় চেটে। আহা কী মাতৃত্ব ! মায়েদের কতো মায়া !
যেদিন আমার বিয়ে ঠিক, সবাই খুশি, বিদেশে চাকুরে ছেলে,অঢেল টাকা। মা,তুমি চুপচাপ ছিলে কেনো বলতো...? মেয়ে মানুষের জাত, তাই বুঝি যথার্থ বুঝে ছিলে মেয়েদের মনস্তত্ব। টাইম ফুল সময় ধরে ফুটে,সময় ধরেই ঝরে । আমার যৌবন, মাতৃত্ব, সংসার...! সময় গেলে তো আর হবে না সাধন।
তোমাদের মেয়ের জামাই বিয়ের প্রথম মাসে গেলো ভিনদেশে। তিনটি বছর পার, তবু দেশে ফিরবার নাম নেই, সে দেশের গ্রীনকার্ড পেয়ে তবেই ফিরবে, জানি না লাগবে কতো দিন। তুমি তো জানো না মা, জানালার গ্রীল ধরে দাড়িয়ে দুরের আকাশ দেখি। দেখি উড়ে যাওয়া মেঘ, পাখি আর বিমান। বড়ো একা একা লাগে, মানুষের সান্নিধ্যের অভাব কি যে যন্ত্রনার, কী করে বুঝাই...! আমি যেন পৃথিবীর বিলুপ্তপ্রায় সেই প্রানী, বেঁচে আছি একটি মাত্র - একাকী। খুব জাগে সাধ,ফিরে যাই শৈশবে। বাবার সাইকেলে ক্রিংক্রিং। তোমার স্নেহে ঝুটিবাধা চুল, কানে গুজা টাইম ফুল।
সোনার চুড়ি, হিড়েকুচি নেকলেস, বিদেশি প্রসাধন যেন আমার হাতের শিকল- যেন আমাকে লোহার খাচায় যাপটে ধরে,অজগর হয়ে খেতে চায় গিলে। এমন জীবন আমি চাইনি বাবা,এমন জীবন আমি চাইনি তো মা, এমন জীবন আমি চাই না ইশ্বর।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register