Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব - ২০২)

maro news
দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব - ২০২)

পর্ব - ২০২

ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে রমানাথ অনবরত পায়চারি করে চলেছেন। তার মা নিজের ঘরে গিয়ে স্বামীর ছবির পায়ের কাছে মাথা ঠেকিয়ে লুটিয়ে পড়ে আছেন। মালিটা হতভম্ব হয়ে বসে আছে দালানের এক কোণে। তার এত দিনের জীবনে সে এমনটি কখনোই দেখে নি। শ‍্যামলী দিদিমণি এ বাড়িতে বৌমণি হয়ে আসবেন, এ কথা সে অনেক দিন ধরে শুনে এসেছে। বাড়ির কর্তা বেঁচে থাকতে সে বহুবার তাঁর মুখে দিদিমণির গুণগান শুনেছে। নতুন বৌ বাড়িতে বাগানের মধ্যে ব‍্যাডমিন্টন খেলবেন শুনে সে রীতিমতো অবাক হয়ে গিয়েছিল। ব‌উ মানুষ কেমন হয় সে জানে। কলেজে পড়া মেয়েরা কেমন হয়, তাও সে দেখেছে। উত্তম সুচিত্রার সিনেমা সে অনেকবার দেখেছে। সিনেমার নায়িকাদের মধ‍্যে আগের যুগে ছিলেন মধুবালা, আশা পারেখ, সায়রা বানু, পরে পরে হেমা মালিনী, রেখা। টিভিতে সিনেমা দেখতে পেত সে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। বাড়ির কর্তা বলতেন, আয়, ঘরে এসে বোস। সে কখনোই ঘরে ঢুকত না। কেননা, গিন্নি মা থাকতেন। সেই সব সিনেমা দেখে নায়িকাদের নানাবিধ লাস‍্য, ছলা কলা সম্বন্ধে তার ধারণা ছিল। কিন্তু, সে সব রুপোলি পর্দার জিনিস। অর্থাৎ মফস্বল শহরে তা চলে না। এই বাড়িতে ভাবী বধূমাতা ব‍্যাডমিন্টন খেলবেন কি পোশাক পরে, সে মাঝে মাঝেই চিন্তা করত। আচ্ছা, বাড়ির পিছনের পুকুরে কি তিনি সাঁতার কাটবেন? শর্মিলা ঠাকুরের মতো পোশাক পরে?
তারপর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের দিন যখন সে শ‍্যামলীকে দেখল, তখন প্রয়াত কর্তামশায়ের জন‍্য তার চোখে জল এসে যেতে লাগল। সত‍্যি, এ বাড়ির হাল ধরতে এমনই গম্ভীর আর মজবুত মানুষ দরকার। সে মেয়ের সামনে দাঁড়ালে মাথাটা অমনি নিচু হয়ে আসে। তার একটা হুকুম তামিল করতে পেলে দিনটা ভাল যায়। মালি খুব আশা করেছিল, এ মেয়ে বৌমণি হয়ে এলে, কখনো কখনো কাছে গিয়ে বলবে বাড়ির কর্তামশায়ের কাছে তার বহু গুণগান সে শুনেছে।
কিন্তু শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের দিন‌ই যে কর্তামায়ের সাথে দিদিমণির মন কষাকষি হয়েছিল, সে ভালভাবেই জানে। খোকাবাবু বৌয়ের সাথে ছাতে গিয়ে গল্পসল্প করেছিল। সেটা কর্তামা ভালভাবে নেন নি। কিন্তু কর্তামশায় বেঁচে থাকতে শেষ দিকে দিদিমণির কথা যে কোনো ছুতোয় টেনে আনতেন। বাগানে শখ করে আম গাছের চারা লাগাবেন বলে, টানা গাড়ি করে কলকাতা গেলেন। গাছ বাছাইয়ের জন‍্যে মধ‍্যমগ্রামের নার্সারি পর্যন্ত যেতে হল। বৌমা গাছে জল দেবেন। তোকে জলের বালতি নিয়ে কাছে কাছে থাকতে হবে। বলতেন তিনি। সারের বস্তা আনালেন । তারপর বললেন, তার অঢেল পড়াশুনা। তোকে সায়েবি জার্নাল পড়ে বুঝিয়ে দেবে কখন কিভাবে গাছের যত্ন আত্তি করতে হয়।.... বসে বসে মাথা নাড়ে প্রৌঢ় মালি। নাঃ, কাজটা খুব খারাপ হল। এমন গুণী মেয়েকে এতটা অপমান ধর্মে স‌ইবে না।
কাজের সহায়িকারা রান্নাঘরে ফিরে গিয়ে মনে করে শ‍্যামলীর কথা। সে যখন এসে দাঁড়াল, দেখেই মনে হল একে মানতে হবে। প্রথম দিন এসেই সে কাজের মেয়েদের বলে দিল, এটা শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। আরো দিই, আরো খাও, এসব আদিখ্যেতা করবে না। শাদা শাড়িতে মুক্তোহারটা আর মুক্তোর ঝোলানো দুল, সাথে মানানস‌ই চন্দনের টিপ। কোনো জড়তা ছিল না। যেন সে জানে, রাজরাণী হবার জন‍্য‌ই তার জন্ম। কর্তামায়ের কাছে সব সময় বাড়ির কর্তা বলতেন এই রকম ট্রে চাই, শ‍্যামলীর ভাল লাগবে। ওই রকম শরবতের সেট চাই, শ‍্যামলী শরবত খাইয়েছিল। তাঁর মুখে শুনে শুনেই একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল তাদের। তারপর সে যখন এল, বোঝা গেল, কেন কর্তামশায় তার অত সুখ‍্যাতি করতেন। কিন্তু সে যে ডাইনি, এটা তো কোনোদিন মাথায় আসে নি। যে খোকাবাবু সবসময় মায়ের নেওটা হয়ে থাকত, কোনো একটা কাজ বললে, "মা কি বলে দেখি" ছাড়া আর কিছু বলত না, সে যখন বৌয়ের জন‍্য মাকে চড়া গলায় কথা বলে, তখন আশ্চর্য হতে হবে বৈকি! যখন বিয়েটা হয় নি, তখন সাঁঝের বেলা হুটপাট আসার দরকারটা কি? ডাইনিরা নানা রকম চেহারা নিতে জানে। সাদা সরল মেয়েদের চেহারার ভেতর টুপ করে ঢুকে পড়তে পারে। দিনের বেলা যে একটা ভারি শান্ত ভদ্র মেয়ে, রাতের কুহেলিতে সেই মেয়েই ভয়ঙ্করী ডাইনি হয়ে উঠতে পারে। ন‌ইলে বিয়ে হয় নি, কিছু না, রান্নাঘরে এসে দাপুটে গলায় বলে দিল, চাল বের করো, দুধ বের করো, রুপোর বাসন বের করো। কেন, পায়েস কি তারা কোনোদিন করে নি? তাকেই সন্ধে রাত্তিরে পায়েস করে খাওয়াতে হবে কেন? ওই পায়েস দিয়ে যাদুটোনা করে নিয়েছিল খোকাবাবুকে।
 আর ওই টপ করে সবার সামনে চুমু খেয়ে ফেলা। ওটাও একটা কায়দা। সাজোয়ান মাতৃভক্ত ভালমানুষ লোকটাকে ভেড়া বানিয়ে ফেলল নিমেষে।
 দুটি অশিক্ষিত গ্রাম‍্য মেয়ে ভয়ে থরথর করে কেঁপে ওঠে। স্পষ্ট বোঝা গেল রুমালটা রেখে যাওয়ায়। ওই দ‍্যাখো, অত বড় মানুষটা ঘরের ভেতর কেমন দাপাদাপি করছে। তুকের জোরটা আন্দাজ করো। কি করে রাতটা কাটবে কে জানে? ডাইনিরা উড়ে উড়ে বেড়াতে পারে। জানালার সামান‍্য ফাঁক, এমনকি ঘুলঘুলি দিয়েও ঢুকে পড়তে পারে। আজ রাতে জল সরতে যাবে কি করে, ভাবে দুটি সহায়িকা। আর শিউরে শিউরে উঠতে থাকে।

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register