Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

ছোটগল্পে আনোয়ার রশীদ সাগর

maro news
ছোটগল্পে আনোয়ার রশীদ সাগর

বদল

রোজিনা।বয়স আর কত হবে?- পনের বা ষোল।সবেমাত্র এসএসসি পাশ করেছে।এক বছর আগেই তার বাবা বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।তবু রোজিনার মন বেশ উড়ুউড়ু।সে উড়তে চায় আকাশে।
ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছে বিভাগীয় শহরের এক বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে।এখন তো আর নিজের ইচ্ছে মত, নিজের পছন্দের কলেজে ভর্তি হওয়া যায় না।লটারীর মাধ্যমে পছন্দীয় ১০/১২ টি কলেজের যে কোনো একটিতে কতৃপক্ষ ভর্তির অনুমতি দিয়ে দেয়।অনেকটা ঝড়োবাতাসে গাছ থেকে অজানার পথে ছিটকে পড়া পাতার মত। এসএসসি পাশ করার পর বান্ধবীদের সাথে দল ধরে সঙ্গী হয়ে,গ্রামের বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে, শহরের এক কম্পিউটার ব্যবসায়ীর দোকান থেকে,অনলাইনে চয়েস দিয়ে আবেদন করেছিল রোজিনা।তাই শেষ-মেষ অনেক ঘাটাঘাটি করে,ঘুরাঘুরি করে হয়রান হয়ে ও ক্লান্ত মনে, আকাশের ঠিকানাহীন উড়ন্ত পাখির মত উড়তে উড়তে গিয়ে, এই বিভাগীয় শহরে ভর্তি হতে বাধ্য হয়েছে। চেষ্টা করেছিল,নিজ এলাকার নিকটবর্তী কোনো কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য।দড়বড়িয়ে ছুটাছুটি করে, একবার এদিকে আর একবার ওদিকে খানাবাড়ি খেতে বসা মানুষের মত সামনে-পিছে ঘুরে ঘুরে দেখেছিল, সব কলেজেই ভর্তি শেষ। গাদন খেলার ঘর দখলের মত,দৌড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত হয়ে, বাবা-মা,স্বামী-শ্বশুর এবং শ্বাশুড়িকে রাজি করিয়ে ভর্তি হয়ে পড়ে। থাকার জন্য স্বামীর সাথে শহরে এসে, ঘুরে ঘুরে একটি মেসে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। তার আগে স্বামী-স্ত্রী দু'জনে কদিন হোটেলে থেকে থেকে বেশ রোমাঞ্চকর সময়টাও কেটেছে।হোটেলে থাকাকালিণ সময় স্বামী লতিফের মনে হয়েছিল 'হানিমুনে' এসেছে।এ এক নতুন অভিজ্ঞতা,নতুন জীবন।মনে হতো জীবনটা এমন পাখির মত হলে আরো ভালোই হতো,আজ এডালে-কাল ওডালে।বেশ মজা। সে মজা এক সময় অনেকটা ফুরিয়ে যায়। যেদিন মেসে উঠে এক রুমে তিনজন মেয়ে থাকা শুরু করে সেদিনই। লতিফ তার বউ রোজিনাকে রেখে,নিঃস্ব ও এতিম হয়ে যেন বাড়ি ফিরে আসতে বাধ্য হয়,মনটা খুবই খারাপ হয়ে যায়।একা একা ট্রেনে উঠে, বগির জানালা দিয়ে, বেশ ক'বার চাতক পাখির মত তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছিল।দেখতে দেখতে ট্রেনটা প-অ শব্দ করে চলতে থাকে ঝকাঝক-ঝকাঝক। মন কত কথা বলে-রে!রোজিনাকে ওড়নার আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে দেখে, মনে মনে, সেদিনই মনে হয়েছিল,মেয়েরা কাঁদতে পারে আর পুরুষরা পুড়তে পারে,হৃদয় পুড়ে ছার-খার হলেও চোখে পানি আসে না।অথচ মেয়েদের হৃদয়ে আগুন ধরলে ,চোখের পানিতে ভিজে সে আগুন নিভে যায়,ছেলেদের আগুন নেভে না,জ্বলতে থাকে নীরবে নিভৃতে। লতিফ নিজ গ্রামে একটা ঔষধের দোকান দিয়ে ব্যবসা করে।পাশাপাশি পল্লীচিকিৎসক হিসেবে এলাকায় বেশ সুনাম করেছে।সে সুত্র ধরে কর্মক্ষম যোগ্য ছেলে হিসেবে রোজিনার বাবা মহর মণ্ডল মেয়েকে লতিফের হাতে তুলে দিয়েছিল।তাছাড়া লতিফ আর রোজিনার মধ্যে হালকা মন দেওয়া-নেওয়া দেখেছিল রোজিনার মা ছামিয়ারা খাতুন।মহর মণ্ডলেরও চাষ-আবাদ রয়েছে।রয়েছে একটা বড় গুদামজাত ব্যবসা।ছোলা-মসুর-ধান-পাট কিনে ট্রাকে করে বিভিন্ন শহরে পাঠায়।যখন যেখানে পাঠালে লাভ হয়, তখন সেখানেই পাঠায়। মহর মণ্ডলের উচ্চরক্ত চাপ থাকায় মেপে দেওয়ার জন্য সকাল-বিকাল লতিফ রোজিনাদের বাড়ি যেতো।ছামিয়ারা খাতুনও লতিফের ব্যবহারে মুগ্ধ।পাড়ার বা গ্রামের অন্য ছেলেরা চাচী বলে সম্বোধণ করে ছামিয়ারা খাতুনকে।তবে লতিফ তাকে খালাআম্মা বলে সম্বোধন করতো।লতিফের ডাকে ছামিয়ারা খাতুনের মনে এক ধরনের মায়ার ছাপ পড়ে যায়। তাছাড়া ঔষধপত্র প্রয়োজন হলে, লতিফের দোকানে রোজিনায় গিয়ে নিয়ে আসতো। এভাবে সম্পর্কের বাঁধনটা শক্ত হতে থাকে। মহর মণ্ডলের বড় ছেলে ঢাকা শহরে একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে।অনেক টাকা ব্যয় হয়।তাই মেয়েটা লতিফের সাথে বিয়ে দিলে আর্থিক দিকটাও সাশ্রয় হবে আবার ভালো জামাইও পাওয়া যাবে।সবদিক বিবেচনা করে বিয়েটা দিয়ে দেয়। লতিফ সারাদিন ঔষধের দোকানে থাকে,গ্রামে গ্রামে রোগী দেখে।বেশ ব্যাস্ত সময় কাটে দিনের বেলা।কিন্তু রাতে বাড়ি ফিরে বড়ই অন্ধকার লাগে দুনিয়াটা। উদাস মন নিয়ে গ্রামের ও আশপাশের রোগী ফেলে,ব্যবসার কাজ থুয়ে,মাঝে মাঝে শহরে গিয়ে রোজিনাকে সঙ্গে নিয়ে এসে, হোটেলে রাত কাটিয়ে আসে। যখন শহরে যায় তখন রোজিয়া ও তার বান্ধবীদের পিছনে অনেক টাকা খরচ হয় বা খরচ করে।খরচ করার সময় মনে মনে বড়ই আনন্দ লাগে লতিফের।রোজিনার সাথে আরো দু'জন হাসিমাখা রাঙা ঠোঁটের ষোড়শী মেয়ে মাতিয়ে রাখে লতিফের মনটাকে।রেস্তোয়ারায় গিয়ে সবাইকে খাওয়ায়,শহরের দর্শনীয় জায়গা গুলো ঘুরে ঘুরে দেখে বেড়ায়।মনে নানা ধরনের রঙ লেগে যায়। অন্য দু'জন মেয়ে তাকে দুলাভাই বলে সম্বোধন করে।বেশ রোমাঞ্চকর সময় কাটছিল।এভাবে কিছুদিন চলে যায়।তারপর ভ্রমর যেমন ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায়,রেণু জড়িয়ে যায় পাখায় বা পায়ে।সে রকমই হয় লতিফের। ঝরতে থাকে ভালোবাসার আয়না।যেদিকে তাকায় যেন ড্রেসিং টেবিলের গ্লাসের ভিতর নতুন মুখ ভেসে ওঠে। সে মুখ সাদা ঝকঝকে দাঁত বের করে,লাল গোলাপের মত পাপড়ি মেলে শুধুই হাসে। ঠোঁট জোড়া যেন আকাশের রঙধনু হয়ে যায়,আধো বৃষ্টিভেজা মনে। লতিফ যেমন মনের আয়নায় রোজিনার অন্য বান্ধবীকে কল্পনা করে,তেমন রোজিনার মনের আয়নায় দেখতে পায়, অনার্স ফাস্ট ইয়ারে পড়া হামিদকে। চটপটে তরুণ হামিদ রোজিনার বান্ধবী সাফিনার বড় ভাই।একই কলেজে সমাজ বিজ্ঞানে পড়ে। দিন যায় রাত আসে।বদলায় মন, বর্ষার সকাল দুপুরের আকাশের মত।
রোজিনা একদিন মেস মালিককে স্বামীর সাথে যাওয়ার কথা বলে মেস থেকে বেরিয়ে যায়। ঠিক সেদিনই অপর বান্ধবী সালমা খাতুন ফোন করে লতিফকে,দুলা ভাই কোথায় আছেন? লতিফ ফোনেই বলে,আমি পৌঁছিয়ে যাবো সন্ধ্যা ছয়টায়।সালমা খাতুন মনের মত সেজে অপেক্ষা করে। সূর্য পাটে বসার আগে আগে, সালমা মেসমালিককে বাড়ি যাওয়ার কথা বলে, বেরিয়ে যায় ব্যাগ হাতে নিয়ে। বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছিয়ে দেখতে পায় লতিফ অপেক্ষায় আছে তারই জন্য। দু'জনেই একটি অটো রিজার্ভভাড়া করে উঠে বসে। রোমাঞ্চময় রাত চলে যায় অতিদ্রুত। আফসোস যেন,দু'জোড়া কবুতরের,বাকবাকুম বাকবাকুম করে ডেকে ওঠে বার বার। সময় আর স্রোত তো কারো জন্য অপেক্ষা করে না।কত আপনজন মরে যায়,কতজন হারিয়ে যায়,কতজন সামনে দিয়ে,কষ্ট দিয়ে চলেও যায়-কেউ মনে রাখে না। সেক্স আর স্বার্থ যেন জমজ দুই ভাই।একই চিহারায় একই স্বভাবে মানুষের মনে গেঁথে থাকে। একই হোটেলে পাশাপাশি দু'রুমে, দুটি জুটি মুখোমুখি,সকালে নিজেদের আবিস্কার করে। তাকিয়ে থাকে একে অপরের দিকে।তারপর যার যার পথে পা বাড়ায়,শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে, চোখের পাতা মেলিয়ে দিয়ে, আনমনা হয়ে সে চোখ নামিয়ে নেয় নিজ নিজ পায়ের পাতার দিকে।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register