Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

ছোটগল্পে বিজন মণ্ডল

maro news
ছোটগল্পে বিজন মণ্ডল

অসমাপ্ত প্রেম

একটু আলাদা প্রকৃতির বলা যায়--- বকাটে স্বভাবের ছেলে পবন। যে যাই বলুক তাদের কাজ সে করবেই। ভালো - মন্দ বিচার করার মতো বোধ হয়তো ভগবান তাকে দেয়নি। যে কারনে তাকে সকলে পবন পাগল বলে ডাকতো। বিধাতার পরিহাসে কার কপালে কখন যে কি ঘটে যায় তা কার জানা আছে ! হঠাৎ করে অজানা রোগে তাকে আর তার মা'কে রেখে তার বাবা সুবেন হাজরা এ জগতের সমস্ত বন্ধন ত্যাগ করে পরলোকে চলে গেল। শোকে শোকে শারীরিক ভাবে অক্ষম তার মা ও তাকে অনাথ করে চলে গেল , না ফিরে আসার জগতে। মুহূর্তের মধ্যেই সে সব কিছু হারিয়ে একা হয়ে গেল।
অবশেষে গ্রাম প্রধানের সুপারিশে নিঃসহায় পবন সম্ভ্রান্ত মহিমোহন চাটুজ্জের বাড়িতে পেটে ভাতে মাথা গোজার ঠাই পেল। মহিমোহন চাটুজ্জে কাপড়ের ব্যবসায় বড়ই টাকা করে নিয়েছে। দুই মেয়ে ইন্দুমতি আর দেবরানী ও চাটুজ্জে দম্পতি --এই চার জনার সংসার তাঁর। অবশ্য পবন সহ দুই চাকর আর একটি রান্নার মেয়েও ছিল তার পরিবারের সঙ্গে জড়িয়ে। কোলকাতার বিখ্যাত ব্যবসায়ী নিশিকান্ত চৌধুরির ছোট ছেলের সাথে গত বছর মহা ধুম ধামে ইন্দুমতির বিয়ে দিয়েছেন। ছোটটি বেশ ছোটই বটে।
পবন আসায় অবশ্য ১২বছরের দেবরানীর বেশ সুবিধাই হয়েছে। যখন তখন যে কোন কাজ পবনকে দিয়ে করিয়ে নেয়। বছর চারেক ছোট , ছোটমেম এর কথা কখনই ফেলতো না সে। দেবরানীকে পবন ছোটমেম বলেই ডাকত। বরং বলা যায় ছোটমেমের কাজ করার জন্যই সে সারাক্ষন মুখিয়ে থাকতো।
আজ দেবরানী ষোড়ষী। যৌবনের সমস্ত স্বরূপ নিয়ে সে বিশ্ব মাঝে যেন খেলা করছে। তার মনে পবন আজ আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। পবনের সারল্যতা তার আবেগি মনটাকে প্রত্যেক মুহূর্তে আকৃষ্ট করে। কিন্তু লোক লজ্জার ভয়ে তার বাড়িতের শুধুমাত্র পেটে ভাতে কাজ করা বকাটে ছেলেটিকে তার মনের কথা বলতে পারে না। কেবল প্রেম দ্বীপ্ত মায়াবী চোখে অশ্রু ঝরায় দিনের পর দিন।
এদিকে ছোটমেম যে নিজের অজান্তে কখন পবনে মনে প্রেমর স্বরূপ পেয়েছে তা পবন বুঝতেই পারেনি। ভালোবাসার জোয়ার তার মনকে ক্ষত বিক্ষত করছে প্রত্যেকটা মুহূর্ত। কিন্তু কোন যোগ্যতার তার আদরের ছোটমেমকে নিজের অন্ধ সাম্রাজ্যের রানী করবে ! কি আছে তার যে ভালোবাসাকে বুকে জড়িয়ে ধরে জীবন কাটবে ! পেটে ভাতে খাটা , জীর্ণ ছাউনির গোয়ালের বারান্দায় রাত্রি যাপন করা হতচ্ছাড়া সে। কি করে কোন সাহসে অন্নদাতার আদুরে অপরূপা মেয়েকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে ! কোন এক অজানা জগতের রাজ পুত্রের অর্ধাঙ্গিনী হবে তারই মনে বসবাসকারী ভালোবাসার প্রতিরূপ।
দিনের পর দিন এই ভাবে দুটি অতৃপ্ত প্রেমাত্মা গুমরে গুমরে মরতে থাকে। যখন গরুর খাওয়া দিতে যায় তখন দোতালার ছাদ থেকে অশ্রু সিক্ত নয়নে অপলক দৃষ্টিতে পবনের দিকে তাকিয়ে থাকে দেবরাণী। পবনও কেবল একটি বারের জন্য তার মনে রক্ষিত প্রিয়তমাকে দেখার জন্য উপরের দিকে তাকায়। পরক্ষনেই মনটাকে পাথরের মত করে সেখান থেকে চলে যায়।
আজ চাটুজ্জে বাড়িতে সাঁনাই বেজে উঠেছে। চাটুজ্জে দম্পতি খুব ব্যস্ত আজ। দু'দিন আগে থেকেই অতিথিদের আনা গোনা শুরু হয়ে গেছে। সকলের সকল রকমের বন্দবস্ত করার জন্য তাদের বসবার মতো অবসর টুকু নেই। কি করেই বা থাকবে , নারায়ন পুরের মহিমোহন চাটুজ্জের অষ্টাদশী কনিষ্ঠা কণ্যার বিয়ে বলে কথা।!! ডেপুটি মেজিস্ট্রেটের এক মাত্র পুত্রে সঙ্গে বিয়ে হতে চলেছে যে----।
নব সাজে সজ্জিত হয়ে দেবরানীও বেশ মুখরিত। কিন্তু তার চোখের আড়ালে কোথাও যেন না পাওয়ার বেদনার ছাপ স্পষ্ট। ও দিকে ১০৩ জ্বর নিয়ে ছেড়া কম্বল মুড়ি দিয়ে গোমাতার কোলের কাছে শুয়ে আছে ছোটমেমের অন্তরের গভীরে বসবাস কারী প্রেম। আজ সে শীর্ণ- ভগ্ন হৃদয় তার। সে যে কি হারাতে চলেছে তা হয়তো কোন দিন কেউ জানতেও পারবে না। তার ছোটমেমকে কোন দিন হয়তো আর দেখতে পারবে না --- , এটাই ভাবতে ভাবতে জ্বর আরো বেড়ে যায়। কিন্তু তাতে কার কি যায় আসে। তার খোঁজ নেওয়ার মত এ জগৎ সংসারে কেই বা আছে !
নতুন জীবন সঙ্গীকে পাশে পেয়েও দেবরানী যেন অপরিপূর্ণ। সর্বক্ষণ যেন সে কিছু খুঁজে চলেছে । বিদায় বেলায় নব পতিকে দাঁড় করিয়ে এক দৌঁড়ে পবনের কাছে এসে কিছু মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে আবেগি ধরা স্বরে ধীরে ডেকে উঠল --" এই পবন পাগল , আমি চলে যাচ্ছি -" শীর্ণ হাতে মুখের উপর থেকে নাংরা ছিন্ন কম্বলটা সরিয়ে তোতলা গলায় বলে উঠল ---""তুমি চললে , ছোটমেম ------!!??" কোন উত্তর না দিয়ে দেবরানী ধীর পায়ে স্বামীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো --- রওনা দিল নব জীবনের লক্ষ্যে ----
পবনের জীবনে উপস্থিত হোল অন্তিম পরিনতি। ছেড়া কম্বলে ঢেকে গেল তার মুখ----- হাজার স্বপ্নের সমাধি সিক্ত হোল তার অশ্রু ধারায় -
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register