Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

অনুগল্পে বিপুল জামান

maro news
অনুগল্পে বিপুল জামান

বড় বেদনার ছোট্ট গল্প

গল্পটা ছোট। এবং সাধারণ । গল্পটা একটা ছেলের এবং তার বাবার, তার পরিবারের। ছেলেটা যখন ক্লাস সেভেনে পড়ে তখন সে ক্রিকেট ব্যাট কেনার জন্যে একটা মাটির ব্যাংকে টাকা জমাতো। একরাতে মা আর বাবা ছেলেটার ঘরে আসে। মা লক্ষ্য রাখে ছেলেটা ঘুম থেকে উঠছে কিনা আর বাবাটা মাটির ব্যাংকটা নিয়ে অন্য ঘরে চলে যায়। ছেলেটার ঘুম ভেঙে গেলেও চুপচাপ শুঁয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর বাবা ফিরে আসে, মাটির ব্যাংক যথাস্থানে রেখে দেয়। বাবা আর মা ঘর থেকে চলে যায়। ছেলেটা বোঝে তার মাটির ব্যাংক থেকে কিছু টাকা সরিয়ে ফেলেছে বাবা। সেদিন ছেলেটা এক মুহূর্তে অনেক বড় হয়ে যায়। অনেক বড়।
সে ছোটবেলা থেকেই দেখেছে বাবার হাতে টাকা থাকে না। বাবা ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি সপ্তম। ছোট ভাই দেশের বাইরে। বাকি ছ'জনই বোন আর তারা সবাই তার বড়। তাদের আবদার, শখ মেটাতে মেটাতে আর কর্তব্য পালন করতে গিয়ে হাতে টাকা থাকতো না। দেনা করতে হতো দোকানে দোকানে। নিজের পরিবারের জন্য তিনি তিনবেলা ভাত জুটাতে হিমশিম খেতেন। দুই ছেলে জন্ম থেকেই দেখছে বলে ওদের ব্যাপারটা সয়ে গেছে। কিন্তু ছোট্ট মেয়েটা এখনও অবুঝ। তাই নানা ব্যাপারে ভীষণ জেদ ধরে। সে গতবছর স্কুলে ভর্তি হয়েছে। গতবছরের স্কুলের ব্যাগটা একটু ছিঁড়ে গেছে। ওর মা সেটা সেলাই করে দিলেও তা মেয়েটা পছন্দ হয়নি। সে নতুন ব্যাগ চায়। নতুন ব্যাগের জন্য ঘ্যান ঘ্যান করতেই মা দিয়েছে একটা চড় কষিয়ে। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। এই পরিবারের কেউ আজ রাতে খায়নি। মেয়েটাকে কাল অবশ্যই একটা ব্যাগ কিনে দিনে হবে। হাতে টাকা নেই। বাজারে ধার করার মতো পরিস্যহিতি নেই। আসল ভেঙে খেতে খেতে দোকান ফাঁকা হতে শুরু করেছে। বাবাটা নিজের পরামর্শে নাকি মায়ের পরামর্শে সেদিন ছেলেটার ঘরে এসেছিল তা ছেলেটা জানে না। জানার চেষ্টাও করেনি। কারন সেদিন রাতে ছেলেটা বড় হয়ে গিয়েছিল। বুঝছিল, কিছু জিনিস না জানাটাই মঙ্গল। কিছু জিনিস না জানতে দেয়াটাই মঙ্গল। তারপর থেকে ছেলেটা তার বৃত্তির টাকা পেলে বাবার হাতে দিত। বায়না সে আগেও করতো না। সেদিনের পর থেকে আরো। সে বড় হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখে এখানে খরচ কম হলেও টিউশনি করে খরচ চালানোর কোন উপায় নেই। বাড়ি থেকে টাকা এনে পড়তে হবে। সে জানে বাবা চার চারটে বছর ধরে এই খরচ চালাতে পারবে না। অন্যদিকে সে শুনেছে কত কত ছেলেরা স্রেফ টিউশনি করে নিজের লেখাপড়ার খরচ তো চালায়-ই ,বাড়িতেও টাকা পাঠায়। সাত পাঁচ ভেবে সে ফিরে আসে। পরের বছর পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়। টিউশনিও জোগাড় করে। বাবার কাছে টাকাও পাঠায়। কিন্তু সেটা ওই প্রথম বছরের কয়েকটা মাস মাত্র। বাবাটা মারা যায় হঠাৎ-ই, ব্রেনস্টোক। সেই ছোট্ট বেলা থেকেই এত বড় সংসারের হিসেবটা বাবার মাথা আর নিতে পারছিল না।
যেমনটা বলেছিলাম, গল্পটা ছোট এবং সাধারণ। গল্পটা প্রায় শেষের দিকে। বাবার মৃত্যুর পর বড় ভাই বউ আর বাচ্চা নিয়ে আলাদা হয়ে গেল। ছোট ভাই, বোন আর মায়ের বাড়তি এই বোঝা সে টানবে না। বাবার জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েছে সে-বাড়তি বোঝা টানার এ পরিণতি তা কখনও যে ভালো হয় না সে নিজের চোখে দেখেছে। বাবার জীবনের ভুল সে নিজের জীবনে পুনরাবৃত্তি হতে দিতে চায় না। ছেলেটা প্রথমে টিউশনি করে এবং পরে পার্ট টাইম চাকরি করে নিজের পড়াশোনা, বোনের পড়াশোনা আর সংসারের খরচ চালায় ছেলেটা স্বপ্ন দেখে একদিন হয়ত এই টাকা পয়সার টানাটানি থাকবে না। কিন্তু মনে মনে সে জানে সে কখনও ধনী হবে না। উপার্জন করে বাবার হাতে দিতে পারলে সে নিজেকে ধন্য ও ধনী বলে মনে করতে পারতো। বাবা সে সুযোগ তাকে দেয়নি।
বাবাকে পেলে ছেলেটা কী বলতো? ছেলেটা বলতো, আপনি আপনার পরিবারের জন্য 'যথেষ্ট' করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আপনি কেন আমাকে আপনার জন্যে 'যথেষ্ট' করার সুযোগ দিলেন না? সারাজীবনে আপনি একটুও শান্তি পাননি, আপনি বলতেন আমরা বড় হলে আপনার শান্তি, ছেলের ভাতেই বাপের সবচেয়ে বড় সুখ, আপনি সে সুখের জন্য কেন একটুখানি অপেক্ষা করেননি?
এই ছোট্ট গল্পে এই ছোট্ট প্রশ্নের বেদনা অনেক বড়। বেদনায় ছেলেটির বুক ফেটে যেতে চায়।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register