Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব - ১৭১)

maro news
দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব - ১৭১)

পর্ব - ১৭১

বাইরে বেরিয়ে মনে হল, রামনারায়ণ বাবুর গাড়িতে গতকাল সে রমানাথদের বাড়িতে গিয়েছিল। অরিন্দম দাশগুপ্তের গাড়ি ছিল। অরিন্দম নিজেই উৎসাহ করে তাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তবুও রমানাথদের বাড়িতে তার সাথে রমানাথের মায়ের সম্পর্কের কঠিনতার কথা ভেবেই সে অরিন্দম বাবুর গাড়িতে ওই বাড়িতে যেতে চায় নি। এই অরিন্দম ও প্রবাল যে নিঃস্বার্থভাবে তার বাবার গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় পাশে দাঁড়িয়ে ভরসা দিয়ে গিয়েছেন, সেটা সে নিজে বোঝে, আর সম্ভ্রমের সঙ্গে মনে রাখে। কিন্তু অনাত্মীয় নরনারীর মধ‍্যে মাংসল গন্ধ ছাড়া অন‍্য কোনো মাত্রার সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে কি না, এ নিয়ে সাধারণের কোনো ধারণাই নেই। শ্রাদ্ধানুষ্ঠান শেষে অরিন্দম ও প্রবালের সাথে তার সহজ সরল বন্ধুত্বকে কদর্থে নেওয়ায় শ‍্যামলী রীতিমতো কষ্ট পেয়েছে। তাই অরিন্দম প্রস্তাব দিলেও সে কঠিন হয়ে সে প্রস্তাব এড়িয়ে যেতে চেয়েছে। কেননা, কোনোভাবে যদি প্রকাশ পেয়ে যায় যে, গড়িয়ে যাওয়া সন্ধ্যায় রমানাথের বাড়িতে অরিন্দমবাবুর সাথে এক গাড়িতে সে পৌঁছেছে, তাহলে পাঁক ঘুলিয়ে তোলার আর অন্ত থাকবে না। এই পরিস্থিতিতে বলা মাত্র রামনারায়ণ একটা গাড়ি ভাড়া করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। যাতে সম্পর্ক সহজ স্বাভাবিক থাকে, তাই তাঁকে সে বাবদে টাকা দেওয়া উচিত। হয়তো তাতে তিনি বলতে পারেন, টাকা দেবার কি প্রয়োজন! হয়তো বা রাগ‌ই করবেন। তবুও শ‍্যামলীর মনে হল, তার দিক থেকে টাকা দিয়ে ব‍্যাপারটা মিটিয়ে নেওয়া উচিত।
কে জানে কেন আজ তার মনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্ণকুন্তী সংবাদ মনে ভেসে আসছে। ভাল আবৃত্তি করত বলে স্কুলের অনুষ্ঠানে বাংলার শিক্ষক মশায় তাকে বলেছিলেন কুন্তীর ভূমিকায় আবৃত্তি করতে। আর নিজে করেছিলেন কর্ণের পাঠ। মহাভারতের এই কুন্তীর কানীন পুত্র ওই কবিতায় একটা অসাধারণ উচ্চতা পেয়েছেন। বঞ্চনার এক কঠিন গল্প আর হাহাকার গোটা কবিতাটায় লিপ্ত হয়ে আছে। সন্তান প্রসব করার পর, তাকে দেখাশুনা করার দায়িত্ব প্রাথমিক ভাবে গর্ভধারিণী জননীর, আর পিতার উচিত সেই প্রসূতি জননীকে সর্বতোভাবে পুষ্টি যোগানো আর সুরক্ষা নিশ্চিত করা। সূর্য নামে এক রাজপুরুষ কুন্তীকে অবিবাহিতা অবস্থায় গোপনে অঙ্গস্পর্শ করেন, বিহার করেন, ও কুন্তী অন্তঃসত্ত্বা হন। পৃথা কুন্তী লোকচক্ষে ভাল থাকবেন বলে তাঁর গর্ভাবস্থা ও সন্তান প্রসব ঘটনা লোকসমক্ষে প্রকাশিত হতে দেননি। একদম শৈশবেই একান্ত অসহায় অবস্থায় তিনি একটি পাত্রে করে নদীতে ভাসিয়ে দেন। রাধা এবং অধিরথ, অন্ত‍্যজ সমাজের মানুষ, তারা কুড়িয়ে পাওয়া শিশুটিকে লালন পালন করে বড়ো করে।
কর্ণের ছিল সহজাত কবচ কুণ্ডল। ছিল বীরত্বব‍্যঞ্জক শরীরী গঠন। এ জিনিস যে রাধা অধিরথের শরীরী মিলনসঞ্জাত সন্তানের লভ‍্য নয়, তা যে কেউ বুঝতে পারেন। কর্ণের শরীরী গঠনটুকুই শুধু বীরোচিত ছিল না, তার মনের গড়ন, সাহস, ব‍্যক্তিত্ব ও স্পর্ধা সবকিছুই ছিল বীরশ্রেষ্ঠের অনুরূপ। অথচ সূতপুত্র অর্থাৎ  রথচালকের সন্তান বলেই কর্ণের সামাজিক পরিচিতি। অধিরথ কথার অর্থ‌ও তাই। সূত কথাটি এসেছে সূত্র থেকে। সূত্র ধরে রথের ঘোড়াকে পরিচালনা করেন অধিরথ। কর্ণের সামাজিক পরিচয় সেই অধিরথের সন্তান হিসেবে। অধিরথ শব্দটিও ব‍্যক্তি নাম হিসেবে সীমিত না থেকে একটি বিশেষ জীবিকার মানুষের শ্রেণিনাম হয়ে গিয়েছে।
 রথচালকের সন্তানেরা সাধারণতঃ ভৃত‍্যশ্রেণির মানুষের জীবনযাপন করতে আগ্রহী থাকে। তারা রাজপুত্রদের সঙ্গে যুদ্ধ খেলায় অবতীর্ণ হবার কথা ভাবতেই পারে না। কিন্তু কর্ণ পারে। ঘোড়াচালকের সন্তান কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারে না যে সে যোজনগন্ধা বেদিজা পাঞ্চালীর পাণিগ্রহণ করবে। কিন্তু কর্ণ পারে।
এই জায়গাটায় বার বার ধাক্কা দেওয়া হয়েছে পাণ্ডবদের তরফে। পাণ্ডবেরা কেউ মর্ত‍্য মানবের ঔরসজাত সন্তান নয়। তারা সবাই অমিত পরাক্রমশালী দেবতাদের বায়োলজিক‍্যাল বেবি। কর্ণ‌ও তাই। এই কারণেই সচেতন ভাবেই পাণ্ডবেরা একযোগে হেয় করতে চাইত কর্ণকে। আর একা কর্ণ মনে মনে বিক্ষত হতে হতে একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের স্বপ্ন দেখত।
জন্মের প্রদোষকালের এইসব গল্প নিয়ে সন্ধ‍্যাসবিতার বন্দনা নিরত কর্ণের কাছে কুন্তী যখন সিংহাসনের টোপ মেলে ধরলেন, তখন সেটিকে কর্ণ খুব খেলো বলেই গণ‍্য করল। একটি নদী বয়ে চলেছে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। একজন নারী নিজেকে মা বলে চিনিয়ে এক দীপ্তিমান পুরুষের কাছে যুদ্ধবিরতি প্রার্থনা করছে।
স্কুলের অনুষ্ঠানে কুন্তীর ভূমিকায় কবিতা পাঠ করেছিল শ‍্যামলী। এখন সে কর্ণের কথাগুলো মনে মনে আউড়ে যাচ্ছে।
এমন সময় সূর্য অস্ত যাচ্ছে। রামনারায়ণ মিশ্রের বাড়ির লোহার গেটের সামনে সে গিয়ে দাঁড়াতেই দরোয়ান গেট খুলে দিল।

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register