Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব - ১৬১)

maro news
দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব - ১৬১)

পর্ব - ১৬১

শক্ত গলায় বাসন্তীবালা সবিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই ঠিক কি বলতে চাইছিস, পষ্ট করে বল্ তো।
সবিতা যেন বাসন্তীবালার কথা কানেই নিতে চান না। শশাঙ্কের দিকে তাকিয়ে বলেন, তোমাদের মেয়ে অনেক দিন ধরে বলেছে, এই মানব জীবনের চেয়ে দামি আর কিছু নেই। পুজোয় তোমাদের জামা কাপড় কেনার টাকাকটা বেহাত হয়ে গেল। ও নিজের জলপানির টাকা থেকে আমার জন‍্যে শাড়ি কিনে আনল। দামি শাড়ি তো আমি আশা করি নি, তবুও পিসির কথা ভেবে ওইটুকু মেয়ে যে এনেছে, আমার ভাল লেগেছিল খুব।
আমাকে সব সময় বোঝাত, পিসি, রাতে আরাম করে শুয়ো, বলে নিজের একটা নাইটি আমাকে পরিয়ে দিয়েছে। কতবার বুঝিয়েছে, এই যে জীবন, এর আগেও কিছু ছিল না। পরেও কিছু থাকবে না। এই জীবনেই যা কিছু করার করে নিতে হবে।
আমায় ও বলেছে রাধিকা সুন্দরীর বিয়ে হয়েছিল আয়ান ঘোষের সাথে। কিন্তু আয়ান ঘোষ পুরুষ ছিল না। হিজড়া ছিল। হিজড়াদের পছন্দ অপছন্দের ধরন ধারন অন‍্য রকম। তাই রাধিকাকে আয়ান ঘোষ কাছে ঘেঁষতে দিত না। সেই রকম লোকের সঙ্গে থাকাটাই একটা সমস্যা। রাধিকা তাই লুকিয়ে চুরিয়ে কৃষ্ণসঙ্গ করত। সেটা করার জন‍্য রাধিকাকে জটিলা কুটিলা খারাপ খারাপ কথা বলত। কিন্তু, আজ আর রাধিকাকে কেউ খারাপ বলে না।
আমার বাপ মা ইশকুলে পাঠালো না, সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিল। যেন বিয়ে দিলেই সব চুকে বুকে গেল। তাঁর‌ও তখন বয়স কম। আমি তো কচি মেয়ে। খেলাবাটি খেলতে খেলতে তুলে এনে বিয়ে। আমার যখন বিয়ে হচ্ছে, উপুঝন্তি বিষ্টি। বর যাত্তর এসেছে। তাদের কত হাঁকডাক। বাবা আমার থরথর করে কাঁপছে।  দাঁড়াতে দেবার জায়গা নেই। তারা সব  আমার বাপকে গাল দিচ্ছে। বিষ্টি হলে একটা চাষিবাসি লোক কি করবে বলো! বিয়ে ভেস্তে যায় যায়।
সেই যে অতো ভিজল, কাশরোগে ধরল বাবাকে। বাঁচল না বেশিদিন। আমার বর‌ও কেন যে কি করে মরে গেল, আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি।
বর্ণ পরিচয় ব‌ই যে আমি দেখিনি, তা নয়। কিন্তু বিদ‍্যাসাগর যে বিধবাদের একটা ব‍্যবস্থা দিয়েছিলেন, কেউ তো বলে নি। মাসিক শুরু হবার আগেই আমি শাঁখা সিঁদুর হারালাম।
শশাঙ্ক পাল বললেন, দ‍্যাখ্ সবিতা, এগুলো তো সব আমি জানি। তা তুই নিজের জায়গাটা গড়বি বলতে কি বোঝাতে চাইছিস?
সবিতা বললেন, তোমাদের টিভিটা তখনও ভাঙে নি। একদিন একটা সিনেমা দিয়েছিল। মেয়েটা খুব ভাল গুড় আর পাটালি বানাতে পারত। আর বচ্চন সেগুলো বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যেত। এত চমৎকার সোয়াদ, যে ওর পাটালি আর গুড় পড়তে পেত না।
শশাঙ্ক বললেন, হ‍্যাঁ জানি তো। সৌদাগর। নূতন, বচ্চন আর পদ্মা খান্না ছিল।
শ‍্যামলী বলল, সুধেন্দু রায়ের ফিল্ম। বাঙালি লেখক নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্প রস। তিয়াত্তর সালে রিলিজ হয়েছিল।
শশাঙ্ক পাল বললেন, সবিতা, তুই আসল কথাটা না বলে খালি এ কথা সে কথা বলে চলেছিস। শ‍্যামলীর ওই বদগুণটা তুই শিখে নিয়েছিস দেখছি।
সবিতা বললেন, আগে আমি বাইরের পুরুষ দেখলে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতাম। তোমাদের মেয়ে কি সুন্দর করে কত লোকের সঙ্গে কথা বলে দেখতে দেখতে ইচ্ছে হল আমিও কথা বলব। তারপর সিনেমায় দেখেছিলুম, রামকৃষ্ণ ঠাকুর রাসমণিকে বলছে, তোমার মথুর জামাইয়ের পা ভাঙলে কি তাকে ফেলে দেবে? নাকি, ডাক্তার কবরেজ দেখিয়ে সুস্থ করে আনবে? এই জীবনে একটা আঘাত এসেছে বলে পুরো জীবনটা মিথ‍্যে হয়ে যাবে না। যা আছে, তাকেই ভাল করে নিয়ে এগোতে হবে।
কদিন ধরে ভেবেছিলাম পাণ্ডুরাজার বাচ্চা হচ্ছিল না। পাণ্ডুরাজার শরীর খারাপ ছিল কিনা। তারপর দেবতাদের সঙ্গে মেলামেশা করে কুন্তীর তিন তিনটে বাচ্চা হল। পাণ্ডুরাজার ফ‍্যামিলিতে গণ্ডগোল ছিল। বাচ্চা না হবার রোগটা ওর বাবার‌ও ছিল। তখন বাইরে থেকে ব‍্যাসদেবকে ডেকে এনে সমস্যার সমাধান হল‌। তার মানে বুঝতে পারলাম, সমস্যাকে বড় করে না দেখে, কি করে সামলে সুমলে জীবনটাকে এগিয়ে নিতে হবে, তাই ভাবা দরকার।
শশাঙ্ক বললেন, তুই একথা সেকথা বলা থামিয়ে আসল কথা বল?
সবিতা বললেন, দুগ্গা ঠাকুরকে দশটা হাত দিয়ে সাজিয়েছে, তার মানে কি এই যে সত‍্যি সত্যি কারো দশটা হাত হয়? অসুর মারার ত্রিশূল দিয়ে মারতে তো দুটোর বেশি হাত লাগে নি! এই যে কথাগুলো তোমার বাড়তি মনে হলেও আমার জন‍্যে সেগুলো দরকার।
বাজারে একটা লোকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। ওর একটা ফুটপাতের হোটেল আছে। আমি সেখেনে রান্নার কাজ করব। একদিন টিপিন কৌটো করে কপির তরকারি করে নিয়ে গিয়ে ছিলাম। খেয়ে তার সুখ‍্যাতি আর ধরে না। বলল, তুই যদি এখেনে রাঁধিস্ তো মাস গেলে কড়কড়ে একশো টাকা দেব। খাওয়া থাকা ফিরি।
শশাঙ্ক পাল অবাক হয়ে বললেন, তুই বলিস্ কি রে? ভদ্রঘরের বিধবা মেয়ে তুই, এই বয়সে একটা অজাত কুজাত কার না কার কাছে খাটতে যাবি? চৌদ্দ জাতের এঁটো বাসন মাজবি?
সমাজ সংসার নিয়ে তোর কোনো ধারণা আছে? তোকে যে ও একহাটে কিনে আরেক হাটে বেচে দেবে রে? না না, এসব আমি হতে দেব না।

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register