Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

ছোট গল্পে জয়ন্ত বিশ্বাস

maro news
ছোট গল্পে জয়ন্ত বিশ্বাস

পৌনঃপুনিকতার লকডাউন

আমি সৌরভ। নাহ্ গাঙ্গুলী নই.. চাটুজ্জে। কর্মসূত্রে কলকাতায় আছি। একটু আগে একটা ফোন এসেছিল দূর্গাপুর থেকে...ফোনটা তুলতেই ওপার থেকে রুক্ষ গলায় একটা অভিযোগ শোনা গেল, "ঘুম ছাড়া তোর জীবনে আর কিছু নেই না কি? ওঠ আর কালকের প্ল্যান'টা ঠিক করে কর"।
কাল চিত্রা আর প্রত্যুষের বিবাহ বার্ষিকীর নিমন্ত্রণ। সিলভার জ্যুবলি! চিত্রার আজীবন কোনও আহামরি শখ নেই। তাই কি দেব- কি দেব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ল সাদার উপর লাল ফুলের ছবি আঁকা "বড় চায়ের কাপ"এর ভীষণ সাধ ওর। অনেক দোকান খুঁজে সেরকম দুটো মাগ কিনে রেখেছি। সেই সাথে রোজ একটু একটু করে ওদের একটা পোট্রেট করেছি;এই সামান্য জিনিস গুলোই ওদের জন্য। কাছের মানুষদের কিছু অন্যরকম ভালবাসা দিতে ইচ্ছে হয়.. বাজারজাত রেডিমেন্ট জিনিসপত্র নয়। যাইহোক, বৃষ্টি আনতে রাগ মেঘমল্লার এর যেমন ভূমিকা চিত্রার জীবনে প্রত্যুষের ভূমিকা অনেকটাই সেরকম । চৈত্রের দাবদহে চম্পা ফুলের মত ফুটেছিল মেয়েটা। চিত্রা নক্ষত্র থেকে চৈত্র নামটা এসেছে আর তা অনুকরণ করেই রাখা হয়েছে মেয়েটার নাম।একান্নবর্তী পরিবারের একমাত্র কন্যা সন্তান এবং ছোট থেকেই ধীর-স্থির বলে সবার কাছে আলাদা স্নেহ-ভালোবাসা পেয়ে এসেছে। ওর বছর আটেক বয়সে গোপীনাথবাবু ব্যবসার কাজে চলে যান ঝাড়খণ্ডে। বাবার অনুপস্থিতিতে মায়ের সাথে কাকা এবং বড় দাদারা চিত্রার অভিভাবকত্ব গ্রহন করেন। একদিন হঠাৎ করেই জ্বরে পড়ে আটবছরের ছোট্ট মেয়েটা। রোগশয্যার চতুর্থ রাতে খাঁট থেকে পড়ে গিয়ে বাড়ির লোকের উদ্বিগ্নতাকে আরও বাড়িয়ে দেয় সে। প্রতিদিনই এবেলা-ওবেলা করে ডাক্তার এসে দেখে যাচ্ছেন,ওষুধ দিচ্ছেন কিন্তু কোনও-ও পরিবর্তনের লক্ষন দেখা যাচ্ছে না। বরং শান্ত মেয়েটা কেমন যেন আরও শান্ত হয়ে পড়েছে এই চারদিনে। শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে আর অস্ফূটকন্ঠে জানায় শরীরে এতটুকু বল পাচ্ছে না। সেজকাকা, রমানাথ মিত্রের সিদ্ধান্তে স্থির হল কালই চিত্রাকে নিয়ে যাওয়া হবে দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালে এবং ঝাড়খণ্ডে টেলিগ্রাম করে গোপীনাথবাবু'কে সব জানানো হবে। এই দ্বিতীয় সিদ্ধান্তে সায় দিল না চোখ-মুখ শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকা ছোট্ট মেয়েটা নিজেই। ভিন রাজ্যে বাপের দুশ্চিন্তার কথা ভেবেই সে বারবার সকলকে বলেছে, "বাবাকে বলো না তোমারা.. বাবাকে বলবে না বলো"।
গতরাতের ঠিক করে রাখা Ambassador গাড়িটা এসে পৌঁছতেই মলিনাদেবী মাতৃত্বের সুরক্ষাবলয়ে মেয়েকে ঢেকে গাড়িতে গিয়ে বসলেন। চালকের পাশের জায়গা'টুকুতে একটু চাপাচাপি করে জায়গা করে নেন চিত্রার মেজকা আর সেজকা। জীবনে প্রথমবার মোটরগাড়ি চড়ার স্বাদটুকু ওরা কেউই হয়তো উপভোগ করতে পারলেন না সেদিন। একদিন পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে জানানো হল প্যারাটাইফয়েড ভাইরাসের আক্রমণে চিত্রার হাত ও পায়ের কর্মক্ষমতা বিকল হয়ে গেছে। হ্যাঁ, এরকমও হয়... একদিনের জ্বরেও নাকি এমনটা সম্ভব হয়। খবরটা শুনে মিত্র পরিবারের পায়ের নীচের মাটিটা সরে গেল, বিশাল আকাশটা যেন ভেঙে পড়েছে নিতান্ত ছোটো ছোটো এই মাথাগুলোর উপর।
তারপর দুবছরের মধ্যেই কাছের মানুষগুলোর ভরসা-আশ্বাসের হাত পাকাপাকিভাবে সরে গেলেও সস্ত্রীক গোপীনাথবাবু আর চিত্রার সেজকার অদম্য মনের জোর আর সাধ্যানুসার প্রচেষ্টায় ওই ছোট দুটো হাত আবার আগের মতো সবল হলেও পা দুটো ধীরে ধীরে ধনুকের মতো বেঁকতে শুরু হয়েছে। এই দুবছরে সংসার শ্রী হারিয়েছে, হাঁড়ি আলাদা হয়েছে। দশবছরের মেয়েটার পেটে পাঠশালার বিদ্দেটুকু ছাড়া আর বেশিকিছু না থাকলেও জীবনে টাকার গুরুত্ব কতখানি এতদিন দেখতে দেখতে সে ভালোই বুঝতে পেরেছে। নাহলে ওইটুকু মেয়ে মলিনাদেবীকে বলতে পারে, "মা, বাবার টাকা নেই বলেই কাকুরা আর কথা বলেনা তাই না? আমাকে আর ডাক্তার দেখাতে হবে না.. আমি পা ভাঁজ করে বসে হাতে ভর করে টেনেটেনে তো চলতে পারছি। এতেই হবে"। অসহায়তার লবনাক্ত জলের ফোঁটাগুলো আঁচলের কোণে লুকিয়ে মলিনাদেবী মমত্বের শীতল হাত রাখলেন মেয়ের মাথায়।
জন্মলগ্নের খটখটে রুক্ষতা হয়তো মেয়েটার জীবনের প্রতিটা ধাপে তার রাক্ষুসে ডালপালা প্রসারিত করে রেখেছে। হাতে ভর দিয়ে ঘষে ঘষে শরীরটাকে এগিয়ে নিতে নিতে আরও দশটা বছর পার করে কালের নিয়মে বাবা-মায়ের বিশাল বটগাছের ছায়াটুকুও হারায় চৈত্রে ফোঁটা চম্পাফুলটি। এখন সংসার বলতে সংসার না বাঁধা সেজকা আর দুই দাদা।
চন্দনগাছ কাটলেও সে যেমন সুগন্ধ ত্যাগ করে না তেমনি শত শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্বেও চিত্রার সদ্গুন, দায়িত্বশীলতা আর মমতা এতটুকু নিষ্প্রভ হয়নি। অস্তাচলগামী সংসারটাকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছে সে। এমতাবস্থায় তাদের বাড়িতে ভাড়া এলো নিজের চেষ্টায় জীবনে সার্বিক সুন্দর ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আশায় ঘর পালানো একটা ছেলে, প্রত্যুষ... প্রত্যুষ চ্যাটার্জি। সাথে দুটো ব্যাগ। একটায় জামাকাপড়, একটা কলাইকোলার থালা গ্লাস আর অন্যটায় একটা বালিশ, গোটা তিনেক বিছানার চাদর আর একটা ফাইল। রমানাথবাবুর ঘরের বাঁদিকের ১০×১০ঘরটায় উঠেছে। সকালবেলা স্নান সেরে মালিকের দেওয়া তালাটা দরজায় ঝুলিয়ে চলে যায় আর সন্ধ্যার পর হোটেলের ছ্যাঁত-ছ্যোঁত করে রাঁধা খাবার আর গরমে কুঁচকে যাওয়া একটা প্লাস্টিকের বোতলে চা কিনে ফেরে। কুঁয়োর জলে হাত মুখ ধুয়ে ঘরে গিয়ে গ্লাসে চা ঢেলে হিসেবের খাতাটা খুলে বসে। মাঝখানে হাতের কলমটা খাতার উপর রেখে দেওয়ালে ঝোলানো বেলবটম্ প্যান্টের পকেট থেকে একটা চারমিনার গোল্ড বার করে এনে জ্বালায়। হিসেবপত্তর মিটলে থালায় খাবার ঢেলে খেয়েদেয়ে কখনও চিণ্ময় লাহিড়ী কিংবা কখনও নিধুবাবু'র টপ্পা গুনগুন করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। এই রুটিন কয়েকদিন দেখে একদিন সন্ধ্যাবেলা রমানাথবাবু ছোকরাকে ডেকে বললেন, "তোমার তো বিশাল সংসার হে... তা সারাদিন অভিযান চালিয়ে কোনো নতুন দ্বীপ-টীপ আবিষ্কার করলে নাকি?" "আপনাদের আশীর্ব্বাদ থাকলে বিশাল সাম্রাজ্য না হোক ছোট্ট একটুকরো জমির উপর নিজের একটা সাম্রাজ্য একদিন ঠিকই করতে পারব" সহাস্যমুখে উত্তর দিলো প্রত্যুষ। বার্ধক্যে উপনীত রমানাথ মিত্তিরের সঙ্গে ছোকরার আড্ডাটা সেদিন ভালোই জমেছিল। নিজেদের গল্প আদানপ্রদানের মাঝে একপর্যায়ে ঠিক হল বাইরের খাবার খেয়ে খেয়ে পেটের রোগ না বাঁধিয়ে কাল থেকে বাড়িওয়ালাদের সাথেই নুনভাত, ডালভাত যখন যা জুটবে তাই খেতে হবে প্রত্যুষ'কে। আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ছেলে এভাবে করুণা গ্রহন করবে না। তাই তখনই সে কথার মারপ্যাচে বিনয়ের সাথে খাওয়ার খরচবাবদ একটা নির্দিষ্ট রাশি দেবে বলে জানিয়ে দেয়। এভাবে ধীরে ধীরে তার পরিচয় গড়ে উঠতে থাকে চিত্রা ও তার পরিবারের সাথে। একটা মেয়ে কিভাবে সমস্ত দীনতা জীর্ণতাকে সরিয়ে রেখে ভালোবেসে সব একাহাতে সামলে চলেছে তা আর অদেখা-অজানা থাকে না প্রত্যুষের। বিন্দু বিন্দু মায়া জন্মাতে শুরু করে ওর উপর... সেখান থেকে বিশ্বাসে উত্তোরণ।
এখন প্রত্যুষের আয় বেড়েছে, খাট আসায় মেঝের বিছনা উঠে গেছে, চারমিনার গোল্ডের পরিবর্তে এখন গোল্ডফ্লেক ফিল্টার কিং। তাহলে কি বাবুয়ানা পেয়ে বসতে শুরু করেছে? টাকাপয়সা নয়-ছয় করে ফেলেছে? এসব ভাবতে ভাবতে সে ঠিক করে চিত্রার কাছেই এবার থেকে সব জমা রাখবে। 'অভাবে স্বভাব নষ্ট' এই গতানুগতিক ধারনায় কখনই তালিকাভুক্ত করা যায়নি নিয়তির দোরে উপেক্ষিতা মেয়েটাকে। বিশ্বাসের সুতোয় ভর করে নিয়মিত টাকা আসে তার হাতে, নিরাপদে সঞ্চিত হবে এই আশায় ; আর একটা মানুষের এই অগাধ বিশ্বাসের মান'কে সে ভাঙবে? কখনই না.. গরিবমানুষের কাছে মানই একমাত্র কাঙ্খিত ধন ; money নয়। এভাবেই একটার পর একটা বিশ্বাসের সুতোর পাকে দুজনের মধ্যে সেতুটা বেশ পোক্ত হল।
আচ্ছা, শুধুই কি মায়া আর বিশ্বাস? কোনোরকম আন্তরিক সখ্যতা কি নেই? প্রশ্নগুলো অনেকবারই উঁকি দিয়েছে প্রত্যুষের মনে। কিন্তু যুক্তি-তর্ক-দর্শনের বিশ্লেষণে স্বপ্ন কখনও ধূসর হয়ে যায়-এটা ভেবেই সে কখনই বেশী আমল দেয়নি ওই প্রশ্নগুলোকে। এরমধ্যেই একদিন পড়ল জ্বরে। শুশ্রুষা করল সেই চিত্রাই। মানবিকতার এই দায় তো আর এরিয়ে যাওয়া যায় না।
বর্ণময় ফুল ফুটলে হিতকারী পতঙ্গ যেমন ধেয়ে আসে তেমনি অনর্থকারী কীটেরাও কিন্তু আসে। সমালোচকগণেরা এতদিন নিজেদের মধ্যে গুঞ্জন করছিলেন কিন্তু এই বিছানার পাশে বসে সেবাযত্নের ঘটনায় তাদের সমস্ত বাঁধ ভেঙে গেল। মিত্তির বাড়ির অন্যান্য শরীকদের সাথে মিলে প্রকাশ্যে কুৎসা রটাতে শুরু করে। পিঠটা এবার দেওয়ালে ঠেকে গেল চিত্রার। জীবন এতদিন যা দিয়েছে তা'সবইতো হাসি মুখে গ্রহণ করেছে মেয়েটা... কোনও দিন,কোনও কিছুর জন্য আফসোস করেনি। কিন্তু বদনাম! বদনাম মাথায় নিয়ে মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে অন্ধকারের অতলে ডুবে থাকার চেয়ে মৃত্যু বোধহয় অনেক অনেক শান্তির।
নিন্দুকদের থামাতে নয় বরং সরল মেয়েটার কথা ভেবে অনেক বাতবিতন্ডার পর প্রত্যুষ সকলকে জানায় আজই সে চিত্রাকে বিয়ে করবে।
‌তারপর থেকে আজ অবধি এই ২৫ বছর একটা দিনও আলাদা থাকে নি ওরা। বিয়ের পর একলহমায় সুখও নেমে আসেনি ওদের জীবনে। তৎকালীন সমাজের পরিকাঠামোয় বিকলাঙ্গ, অব্রাহ্মণ পুত্রবধূকে মেনে নিতে পারেনি শ্বশুরবাড়ির একটা মানুষও। আর তাই তাদের সান্নিধ্যের আশ্রয় থেকেও বঞ্চিত হতে হয় নবদম্পতিকে। কর্মক্ষেত্র থেকে প্রদত্ত কোয়ার্টারে স্ত্রী'কে নিয়ে ওঠে প্রত্যুষ।
দুঃখ তো আজীবন সঙ্গ দিতে পারে না এই প্রত্যয় নিয়ে শুরু হয় ওদের নতুন এক জীবন। ফিজিওথ্যারাপি দিয়ে পুনরায় চিত্রার চিকিৎসা শুরু করে প্রত্যুষ।রোজ দুপুরে মধ্য বয়স্কা একজন এসে ম্যাসাজ করিয়ে যান।পায়ের গোড়ালি থেকে হাঁটুর উপর পর্যন্ত একটা করে কাঠ বেঁধে আর হাত দুটোকে জানলার গ্রিলের সঙ্গে বেঁধে ক্রুসিফিকেশানের ভঙ্গিমায় দাঁড় করানো হয় চিত্রাকে। তারপর বিবিধ জরিবুটির তেল দিয়ে থেরাপি চলতে থাকে। এতে পা দুটো ধীরে ধীরে একটু সোজা হয়েছে। প্রত্যুষের বিশ্বাস আর একাগ্রতা দেখে বোধহয় বাঁকা হাসি হেসেছিলেন নিয়তি। একদিন খবর আসে মধ্যবয়স্কা মহিলাটি স্টোভ ব্লাষ্ট করে প্রাণ হারিয়েছেন। চিত্রার প্রতি সকলের উপেক্ষা আর অবহেলা প্রত্যুষের ভেতরের জেদকে নিয়ত অনুপ্রাণিত করেছে। তাই এত সহজেই পরাজয় স্বীকার করতে সে নারাজ। টালমাটাল একটা পরিস্থিতিতে চিত্রার মধ্যে আগমন ঘটে নতুন সদস্যের। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের প্রসূতিবিভাগের ডাক্তারদের পাশাপাশি অন্যান্য ডাক্তারদের সাথে প্রত্যুষ আলোচনা করে যাতে কোনও উপায়ে একদিন আবার চিত্রা উঠে দাঁড়াতে পারে।
আশাহীন একটা ক্ষীণ আশার সন্ধান পায় প্রত্যুষ। ভেলরে গিয়ে অপারেশন করাতে হবে এবং সেখানে নিয়মিত চিকিৎসার অন্তর্জালে ছ'টা বছর রাখতে হবে চিত্রাকে। প্রতিবছর একটা করে অপারেশন। ছ' বছরে মোট ছ'টা। এব্যাপারে চিত্রাকে কিছুই জানায় না সে। স্থির করে সন্তানের জন্মের পর ওদের নিয়ে ভেলোরে চলে যাবে। মনে মনে এই আশাটাকে লালন করতে থাকে। ন' মাসের কিছু পরে চিত্রা একটু ফুটফুটে মেয়ের জন্ম দেয়। নাহ্, বিন্দুমাত্র আশঙ্কার কারন নেই... সদ্যোজাত শিশুটি একদমই সুস্থ এবং স্বাভাবিক। মেয়ে বলে শ্বশুরবাড়ির থেকে কেউ একটিবারের জন্য আসেন নি। তা না আসুক, মুখ ফিরিয়ে থাকুক। কিন্তু দূর থেকে পূত্রবধূর সব কর্তব্য করে গেছে চিত্রা। দুঃখ নামক এতদিনের ছায়াসঙ্গী ব্যক্তিটি এবার বোধকরি ক্লান্ত হয়েছেন। ছোট্ট কোয়ার্টারের দুকামরার ঘরটা এখন স্বর্নাভ সুখের ছটায় উজ্জ্বল। প্রত্যুষ এক পরিচারিকা নিয়োগ করেছে চিত্রার সাহায্যার্থে। তবে সন্তান সামলে রান্নাটা নিজের হাতেই করছে চিত্রা। প্রত্যুষের মতে তার স্ত্রীর মতো আলুপোস্ত, সর্ষে ফোড়ন দিয়ে ডাল আর অমন কাটাপোনার টক কেউ রাঁধতে পারে না ; এই স্বাদের টানে সে বারবার ফিরে আসবে। আর এগুলোই চিত্রার কাছে পরমপ্রাপ্তি।
বাচ্চাটা এখন হামাগুড়ি দিতে পারে। এবার মনের কথাটা চিত্রাকে জানায় প্রত্যুষ। ছটা বছর অন্যরাজ্যে???! শুনেই আঁতকে ওঠে চিত্রা। এখানে অনেক দায়িত্ব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল মেয়েটার ভবিষ্যৎ। ওর ভবিষ্যৎ গড়ার শুরুতেই কুয়াশায় ঢাকা অনিশ্চিত একটা পথে পা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কি করে নিতে পারে প্রত্যুষ? কোনোমতেই সায় নেই চিত্রার। অনেক বোঝানো হলেও অনিশ্চয়তার মোটা পর্দাটা রয়েই যায় ওর মনে। আলোচনাটা তর্ক থেকে কিঞ্চিৎ ঝগড়ার পর্যায়ে গেলেও সিদ্ধান্তে অনড় একজন মা, একজন মেয়ে,একজন পুত্রবধূ আর একজন স্ত্রী। এসমস্ত দায়িত্ব, স্বামীর নিজের বাড়ির স্বপ্ন এসবই তার নিজের কাছে ভীষণ ভালোবাসার, এদের পায়ের নীচে মারিয়ে উঠে দাঁড়ানোর ইচ্ছেটাই ওর নেই। জীবনের এই পঙ্গুত্বটাও ভালোবাসা দিয়ে গ্রহণযোগ্য করে নিয়েছে সে। কিন্তু প্রত্যুষকে যখন কোনভাবেই বুঝিয়ে থামানো গেল না তখন এই বলে তাকে আশ্বস্ত করা হল যে 'মেয়ে আরেকটু বড়ো হলে আমি যাব'। তারপর দাম্পত্যের রসায়ন আরও অনেক সম্পৃক্ত হয়েছে,দামোদর দিয়ে অনেকজল বয়ে গেছে, একটা পুত্রসন্তানও এসেছে ওদের সংসারে। শ্বশুরবাড়ির আবহাওয়ায় তখন শীতের শেষ মুহূর্ত। জ্যোৎস্না যেমন তমশাকে নির্মল করে তেমনি চারিত্রিক গুনের সুকুমারতায় নির্মল হয় এক একটা পরিবৃত্তি। সংসারের মধ্যে সর্বক্ষণ ব্যস্ত চিত্রা প্রত্যুষ দুজনেই। প্রত্যুষের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, নিজের একটা সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পেরেছে। চিত্রার কথামতো বাড়িটার নাম দিয়েছে 'সপ্তচ্ছদ ছায়া'।বাড়িটা তখনও চোখ দিয়ে দেখেনি চিত্রা। একটু একটু করে সব গুছিয়ে গৃহপ্রবেশের দিন কোয়ার্টারের ঘরটা থেকে কোলে করে একটা গাড়িতে বসিয়ে প্রত্যুষ ওকে নিয়ে আসে ওদের নিজের বাড়িতে। বাড়িটার দরজায় দাঁড়িয়ে চিত্রার মনের মধ্যে দরবারির আলাপ বেজে ওঠে। একটা ছোট বাগানের মধ্যে দিয়ে ঘরে ঢোকার পথ। মূলফাটকের উপরের অর্ধবৃত্তাকার অংশটায় হলুদ রঙের অ্যালামান্ডা ফুলের লতা আর বাড়ির বাম দিকে একটা বেগনভেলিয়ার গাছ। কি আশ্চর্য! এগুলো সবই যে চিত্রার ভীষণ প্রিয়! কিন্তু প্রত্যুষকে তো কোনোদিন এসমন্ধে কিছু বলা হয়নি। তাহলে জানল কি করে? আসলে মায়ের ছোট থেকেই বাগান করার একটা নেশা ছিল.. বাঁকুড়ায় মামাবাড়িতে থাকার সময় বাবা সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। বেগনভেলিয়াকে মা বলতেন কাগজফুল। ওহ্! বুঝতে পেরে গিয়েছেন? হ্যাঁ, ওরা আমার মা-বাবা। কোনো নিমন্ত্রণ নয়। দিদি জামাইবাবুকে নিয়ে একটা আনন্দ মূহূর্ত উদযাপনের প্ল্যান করেছি। সচেতনতার কথা ভেবেই অনাড়ম্বরহীন আমাদের আড়ম্বর। কলকাতার এই ফ্ল্যাটে তিন নির্বাসিত অবস্থায় থেকে যতটা না হাপিয়ে উঠেছি তার চেয়ে অনেকবেশও হাঁপিয়ে উঠেছি প্রিয়মানুষগুলোর সান্নিধ্য না পেয়ে। তবে আমার মায়ের জীবনে লকডাউন'টা কিন্তু এতটুকু শিথিল হয়নি। বাঁকুড়া থেকে এসেছিল বর্ধমান সেখান থেকে আজকের দূর্গাপুরে। আসা যাওয়ার দিন ক'টা ছাড়া বাকিটুকু লকডাউন। যতবার জোর করা হয়েছে ততবার বলেছেন "এইটুকু ছিল বলেই আজ এত সুখ পেয়েছি, তোদের বাবাকে পেয়েছি, তোরা আছিস। তোদের সবাইকে অবলম্বন করে কবেই তো উঠে দাঁড়িয়েছি। জীবনের কাছে আমার এই কৃতজ্ঞতাটুকু নিয়েই এগিয়ে যেতে দে।"
বেগনভেলিয়া গাছটা এখন দোতলার বারান্দার রেলিংটাকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। রোজ বিকেলে চা নিয়ে নীচের চাতালটায় এসে ওরা দুজন মিলে বসে। হয়তো রোমান্থনেই মোক্ষ প্রাপ্তি হয় ওদের। কাল গিয়ে জোর করেই ওই বারান্দাটায় নিয়ে যাব মা'কে। তারপর জুঁইয়ের মালা বদল করে আবার বিস্ময়কর দাম্পত্যের পৌনঃপুনিকতায় চেনা মানুষকে প্রতিনিয়ত নতুন করে আবিষ্কারের ধারাটা নিরেট স্বকীয়তায় চলবে।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register