Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

T3 || ২১শে ফেব্রুয়ারি - হৃদয়ে বসতে বাংলা || 26য় শম্পা সাহা 

maro news
T3 || ২১শে ফেব্রুয়ারি - হৃদয়ে বসতে বাংলা || 26য় শম্পা সাহা 

শান্তি

 আসমা তারার মন ভালো নেই। কী করেই বা থাকবে? আম্মু, আব্বু, বড় বোন বিলকিস, যে হাঁটতে নড়তে একদম পারে না! তারা সব পড়ে রয়েছে সেই কোওওওওন দূর দেশে। ওর বাড়ির সামনের যে ফাঁকা আধফালি উঠোন, তাতে এই শীতেও ঝাঁপিয়ে কুল এসেছে! আম্মু বলে, বাতাবী নেবুর ফুলের গন্ধে রাতে ঘুম আসে না! আম্মুর মন নাকি আনচান, আনচান করে, আসমার জন্য! সে তো আসমারও করে! নিজের বাড়ি, ঘর, কলেজ, রাস্তা, উঠোনের সজনে, বাতাবী, কুল গাছ,  সব ছেড়ে ওকে চলে আসতে হয়েছে এই শীতের দেশে! যেখানে সারা বছরই প্রায় শীত। বরফ ঢাকা রাস্তা ঘাট, ভারী কোট, টুপি, হাঁটু পর্যন্ত পা ঢাকা বুট ছাড়া রাস্তায় বেরোনোই যায় না। সেখানে বসন্ত, শীত, বর্ষা সব অসম্ভব ঋতু যে! এখানের লোকের খাওয়া দাওয়া, রহন সহন সব আলাদা রকম!
  রকিব সারা দিন নিজের রিসার্চের কাজ আর সন্ধ্যায় অড জবে ব্যস্ত। স্টুডেন্ট ভিসা পাওয়ার পর দুজনেই এখানে চলে এসেছে।‌ রকিবের কাজ শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে কিন্তু ওর এখনো ঢিমে তালে! আসলে এই প্রচণ্ড শীতটা কাটলে পরেই ওরও ব্যস্ততা বেড়ে যাবে। তখন অবশ্য আসমা এভাবে একা একা শহরটা চিনতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পাবে না।
  এই আলাদা শহর, আলাদা লোকজন, আলাদা খাওয়া দাওয়া সবটাই আসমার সয়ে যায় কিন্তু সমস্যা হলো জিভ। একটানা অন্য ভাষায় কথা বলতে বলতে ওর যেন জিভ ব্যথা করে! একটু বাংলা বলার জন্য প্রাণটা আনচান করে। উইক এন্ড গেটটুগেদারে যারা একত্রিত হয়, তারা সবাই যেন হামলে পড়ে ! তবে শুধু আলু সেদ্ধ, কালো জিরে দিয়ে পাতলা মুসুর ডাল, লাল লাল সিদল ভর্তার জন্য নয়, বাংলা ভাষাটার জন্যেও! সে তো এখন অনেক দেরি!! আজ সবে বুধবার দুপুর! রকিব কাল রাতে কাজের জন্য ফিরতে পারেনি! রাতটা তো কেটে গেছে কিন্তু দিনটা যেন কাটতেই চায় না। রকিব ফোনে বলেছে ওর ফিরতে ফিরতে আজ রাত হয়ে যাবে। তাই স্যালামি আর স্যালাড দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে কিছু কেনাকাটার জন্য বেড়োয় আসমা। টুকিটাকি কিছু কেনাকাটা ওই যাকে বলে উইনডো শপিং সেরে ভ্যাঙ্কুভারের অন্যতম বিখ্যাত কফি শপ, রিচার্ড স্ট্রীটের কাফে মেডিনার একেবারে ধারের টেবিলে এসে বসে ও!! এক কাপ গরম কফি ওর এই মুহূর্তেই দরকার! বেশ ঠাণ্ডা আজ। এই দুপুরেও সূর্যের মুখ দেখানোর নাম নেই। একেতেই ঝুপঝাপ বৃষ্টি তো লেগেই আছে, তাতে যেন ঠান্ডাটা আরো এক ধাপ হাড় কাঁপিয়ে দেওয়ার পর্যায় পৌঁছায়! ধুর! এই সব শীত কালের বৃষ্টিতে , বিলকিস আর ও দুইবোন আম্মুর গা ঘেঁষে বসে জ্বিন পরীর গল্প শুনতো আর গরম গরম পেঁয়াজু সঙ্গে আরো নানান ভাজাভুজি! বৃষ্টি নামলেই আব্বু তার মেহেন্দি করা দাড়িতে হাত বুলিয়ে আবদারের সুরে বলতো,
-ও বিলকিসের আম্মু,অইবো নাকি?
আম্মুও ছদ্ম রাগ দেখিয়ে ধুপধাপ আওয়াজ করে রান্না ঘরে গিয়ে বসতো, কুচি কুচি পেঁয়াজ কেটে বেসনের গোলায় চুবিয়ে খাস্তা গরমাগরম পেঁয়াজু ভাজতে! কোথায় কী? সে সব যে আবার কবে পাবো?? আম্মু, আব্বু ডাকার সুযোগ ও তো নেই সেই ফোনে ছাড়া! নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে আসমার বুক থেকে।
  হঠাৎ পেছনে কে যেন বলে,
-আরে না না, তা বললে কী হয়?
অ্যাআআআআ.... বাংলা!! ভ্যাঙ্কুবারে বাংলা!! তাও আবার পুরো দস্তুর ইংলিশ এক কফি শপে, তাও এই সময়!! ও কি ভুল শুনছে?? তাড়াতাড়ি পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, এক নরম মুখের, শ্যামলা রোগাটে, বছর বাইশ চব্বিশের এক ছেলে ফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে! ওর এক মাথা কালো চুল, তামাটে গায়ের রং, বড় বড় চোখ আর সর্বোপরি কান জুড়োনো বাংলা শুনে আসমা যেন প্রাণ ফিরে পায়!! এ তো নিশ্চয়ই বাঙালি!! এ দেশে আসার পর থেকেই ওর এটা হচ্ছে। ও যে ওর মুখের ভাষাটাকে এত ভালো বাসতো তা কি নিজের দেশে থাকতে বুঝেছে কখনো? বরং সুযোগ পেলেই ইংরেজি আর হিন্দি সিনেমা দেখার দৌলতে হিন্দি বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতো। কিন্তু সেই অত্যন্ত পরিচিত, হেলাফেলার মাতৃভাষাটাও যে এত আপন, এত মধুর লাগতে পারে তা এখানে না এলে কি কখনো জানতো আসমা তারা? ফোন রাখলে, গুটি গুটি আসমা এগোয় ছেলেটির টেবিলের দিকে। কয়েকবার একটু ইতস্তত করে, কী ভাববে কী জানি? কিন্তু একটু বাংলায় কথা বলা যাবে, জিভটা তো অন্তত শান্তি পাবে! এই ভেবে আসমা বলে,
-আপনি বাঙালি?
ছেলেটিও এই অজানা অচেনা বিদেশে বাংলা শুনে রীতিমতো থমকে যায়! যদিও এখানে কেন বাঙালি সব জায়গাতেই কিন্তু তবু দেশের মতন আর কই? অবাক হয়ে বলে ,
-হ্যাঁ
-আমিও বাঙালি! বাংলাদেশের কুমিল্লা থেকে। আপনি?
-আমি ভারত, বর্ধমান!
-একসাথে কফি খাওয়া যায়?
-হ্যাঁ, বসুন না!
দেশে হলে হয়তো আসমা কোনো মতেই পারতো না একটা অচেনা ছেলের সঙ্গে গায়ে পড়ে আলাপ করতে। কিন্তু বিদেশ বিভুঁইয়ে বাংলা ভাষার জন্য তো একটু করাই যায়! দু কাপ কফি নিয়ে বসে পড়ে দুজনে। পরবর্তী দু তিন ঘণ্টা তো অন্তত জিভ কানের শান্তি!
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register