Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

মার্গে অনন্য সম্মান সুমিতা চৌধুরী (সেরা)

maro news
মার্গে অনন্য সম্মান সুমিতা চৌধুরী (সেরা)

অনন্য সৃষ্টি সাহিত্য পরিবার পাক্ষিক প্রতিযোগিতা পর্ব - ৩০ বিষয় - সততার মূল্য

এক রাতপরীর রূপকথা

কুহুর জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে মেডিকেল কলেজে জয়েন করার আজ প্রথম দিন। তাই ঘিঞ্জি বস্তির প্রতিটি ঝুপড়িতে আজ আনন্দ-উৎসবের রোল। কুহুর এই সাফল্যের পিছনের গল্পগুলো বড়োই অন্ধকারাচ্ছন্ন। শুধু কুহু নয়, তার মা জুঁই, অধুনা জুলি এবং সৎবাবা প্রকাশের এক দমবন্ধ কান্নার ইতিহাস, হার না মানার অদম্য জেদের নিত্য সংগ্রাম লেখা আছে তাতে। এক প্রত্যন্ত গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে জুঁইয়ের শুধু রূপের গুণে খুব বড়লোক ঘরে, প্রায় বিনা কথা-বার্তায়, বিনা পণে, পাত্রপক্ষের বিয়ের সকল সাজ-সরঞ্জাম, খরচ-খরচার বদান্যতায় রূপকথার গল্পের মতোই বিয়ে হয়ে যায় সুদূর দিল্লিতে। কিন্তু রূপকথা থেকে রাতকথা হতে সময় লাগে না একমাসও। হঠাৎই গ্রামে খবর যায়, জুঁই আর বেঁচে নেই। দিল্লির নতুন আবহাওয়ায় হঠাৎই ভীষণরকম অসুস্থ হয়ে মারা গেছে সে, আর ওখান থেকে দেহ বয়ে নিয়ে আসা অনেক খরচসাপেক্ষ, তাই দাহকার্য তারা নিজেরাই দিল্লিতেই সম্পন্ন করে নিয়েছেন। আর্থিক অসঙ্গতিতে বুকভাসানো কান্না সম্বল করে জুঁইয়ের মৃত্যু মেনে নেওয়া ছাড়া গতি ছিল না জুঁইয়ের বাড়ির লোকেদের। হ্যাঁ জুঁই সত্যিই মরেছিল ,শুধু দেহে, মনেই নয়, পরিচিতিতেও। টাকা আর হাত বদলের খেলায় ততোদিনে ঘুরেফিরে কোলকাতারই এক পতিতাপল্লীতে নতুন যৌনকর্মী জুলির জন্ম হয়েছিল যে। ততোদিনে কুহুর অস্তিত্ব জানান দিয়ে গেছে জুঁই থুড়ি জুলির শরীর। এরকমই এক রাতে খদ্দের খোঁজার পথেই দেখা হয় প্রকাশের সাথে। অবাঙালি প্রকাশ বারে ড্রাম বাজায়, মাঝে মাঝে ডুয়েটে গলাও মেলায়। জুলির রূপের সাথেই তার আড় না ভাঙ্গা আড়ষ্টতা প্রকাশকে কেন জানি আরো বেশী আকর্ষণ করেছিল জুলির প্রতি। প্রকাশের দুচাকার আমন্ত্রণেই জুলিও কেন জানি সে রাতে গিয়ে উঠেছিল প্রকাশের ঝুপড়িতে রাতের অতিথি হয়ে। অনাথ প্রকাশের মনের জ্বালা, বা দেহের ক্ষুধা কতোটা মিটেছিল জানা নেই সে রাতে, তবে এক রাতেই প্রকাশ জুলির সবথেকে কাছের, সবথেকে বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে উঠেছিল। প্রকাশের মনের সান্নিধ্যে জুলি অকপটে বলেছিল তার সব কথা। সবটা জেনে প্রকাশ আরেকটা অনাথ বাচ্চার জন্ম হতে দিতে চায়নি। তাই, জুলিকে আর ফিরতে দেয়নি যৌনপল্লীর অন্ধগলিতে। এক রাতে সম্পর্কের নতুন সমীকরণে, বস্তির সবার কাছে তাকে নিজের বউয়ের স্বীকৃতি দেয় সে। এরপর শুরু হয় আরেক নতুন অধ্যায়। ঐ বস্তির ঘরেই জন্ম নেয় কুহু, বেড়ে উঠতে থাকে আদরে-অনাদরে। জুলি আর কুহুর জীবনে প্রকাশ যেন সত্যিই এক আলোর প্রকাশ হয়েই আসে। প্রকাশ ও জুলির নতুন সংগ্রাম শুরু হয় কুহুকে মানুষ করার। প্রকাশের কর্মস্থল সেই বারেই জুলি গান গাইতে শুরু করে। তাদের যৌথ রোজগারের টাকায় শিশুবয়স থেকেই কুহুকে তারা সঠিক শিক্ষায় মানুষ গড়ার কাজে ব্রতী হয়, কুহুকে সঠিক বয়সে স্কুলে ভর্তি করিয়ে ও টিউশন দিয়ে। তাদের একটাই শপথ ছিল, আগামীদিনে কুহুকে আলোর পথে নিয়ে যাওয়া। এই পরিবেশে বাচ্চারা খুব বেশিদিন ছোটো থাকে না। কুহুও ছিল না। খানিক বড়ো হতেই তার হাজারো প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড়িয়েও প্রকাশ নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় নিজেকে ও জুলিকে ভাঙতে দেয়নি কোনোদিন, শক্ত রেখে খুব ধীরে সুস্থে, গল্পকথার মতোই নিজেদের জীবন মেলে ধরেছিল কুহুর কাছে এক খোলা খাতার মতোই। আর তার সাথেই কুহুর মনে এই অন্ধকার থেকে আলোর রাস্তায় যাওয়ার এক অদম্য জেদ তৈরী করে দিয়েছিল। তাকে বুঝতে শিখিয়েছিল, এই অন্ধগলির দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাদের তিনজনেরই। তাই ঘুরে দাঁড়িয়ে বাঁচার রাস্তা খোঁজা ছাড়া মরণ নিশ্চিত। তাও বাস্তবে মরণ নয়, এই পৃথিবীতে থেকে প্রতিদিন শরীরে ও মনে তিলে তিলে মরা। হ্যাঁ কুহু ঘুরে দাঁড়িয়েছিল সবটা বুঝেই। তাই তো আজ এতো আলোর রোশনাই চারিদিকে। কুহুকে প্রতিষ্ঠিত করতে, জুলি আর প্রকাশের আর্থিক সংগ্রাম, জীবনের হার না মানা লড়াই আর শিক্ষাকে সম্বল করে কুহুর প্রতিষ্ঠার তথা সাফল্যের লড়াই আজ স্বীকৃতি পেয়েছে। হ্যাঁ, রাতপরীদেরও কিছু রূপকথার গল্প থাকে বই কি!!
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register