Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব - ৫৮)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব - ৫৮)

সালিশির রায়

কিস্তি - ৬৩ 

ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই অঞ্জলির গলা বাষ্প রুদ্ধ হয়ে আসে। ভাইকে আদর করে অঞ্জলি।তারপরই দিদি আর ভাই হোম ছেড়ে চলে যায়। মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়অঞ্জলির। মনে হয় এত বড়ো পৃথিবীতে সে বুঝি একা। দিদিদের চলে যাওয়ার পথের দিকে উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সে। আচমকা পিঠে কার স্পর্শে চেয়ে দেখে কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন আলাপনবাবু। হোমের অন্যান্য মেয়েরা তখন যে যার ঘরে।তাই খুব একটা অস্বস্তিতে পড়তে হয় না অঞ্জলিকে। তাছাড়া গ্রুপ , জিনিসপত্র বিক্রি, পড়াশোনা নিয়ে আলাপনবাবুর সঙ্গে তাকেই বেশিরভাগ সময় কথা বলতে হয়। তাই তাদের কথা বলা নিয়ে বিশেষ কেউ কৌতুহলও দেখায় না। কৌতুহল সৃষ্টি হয় এমন পরিস্থিতিও সে ঘটতে দেয় না সচরাচর। তাস্বত্ত্বেও কি করে যে সে শ্রাবণীর কাছে ধরা পড়ে গেল কে জানে। আসলে প্রেমটাও একটা রোগের মতো। কিছু কিছু রোগের মতো যতই গোপন করা হোক না কেন ঠিক ফুটে বেরোবেই। তবে এনিয়ে তার অবশ্য অপরাধ বোধ নেই , অপরাধ তো সে কিছু করছে না। তাই লুকোছাপা করতেও তার মন চায় না। কিন্তু আলাপনবাবুর কথা ভেবেই তাকে লুকোছাপা করতে হয়। অত বড়ো একজন মানী মানুষকে তার মতো নগন্য একটা মেয়ের প্রেমে পড়তে দেখে যদি কেউ আলাপনবাবুকে নিচু নজরে দেখে তা হলেই সে সইতে পারবে না। সে যে সত্যিই আলাপনবাবুকে ভালোবেসে ফেলেছে। ভালোবাসার মানুষকে অন্যের চোখে ছোট হয়ে যাওয়া দেখতে কেউই মেনে নিতে পারে না। এসব ছাপিয়ে অন্যরকম একটা আশঙ্কাও কাজ করে তার মনের মধ্যে। কতটুকুই বা সে চেনে আলাপনবাবুকে ? এমনিতেই সে ঘা খাওয়া একটা মানুষ। সেই ক্ষত এখনও শুকোয় নি। মাঝে মধ্যেই যেন রক্ত ঝরে। ফের যদি একই আঘাত খেতে হয় তাহলে সে তা সইবে কেমন করে ? তবে আলাপনবাবুকে তার সেই সন্দেহের উর্দ্ধেই মনে হয়। নাহলে তার হাতে ভাইফোঁটা নেওয়াএড়াতে ওই অজুহাত খাড়া করতেন না। কথাটা মনে পড়তেই আলাপনবাবুকে চেপে ধরে সে। বলে, আচ্ছা আপনার কেউ মারা গিয়েছে বলে তো শুনি নি। তাহলে ভাইফোঁটা নেওয়ার সময় কালাশৌচের কথা বললেন কেন বলুন তো ? ---- না হলে যে তোমার হাত থেকেও আমায় ফোঁটা নিতে হত। সেটা আমার মোটেই ভালো লাগত না। --- ওরে বাবা , আপনার মাথাতেও এত দুষ্টু বুদ্ধি খেলে ? আপনাকে তো আমার ভোলেভালে টাইপের মনে হয়। আমিও বিষয়টি নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল ভাইফোঁটার আয়োজন করতে গিয়ে যেন নিজেই গলায় ফাস পড়েছি। আপনিই সেই ফাস থেকে আমার উদ্ধার করলেন। --- বেশ যা হওয়ার তা হয়ে গ্যাছে। এবার কিন্তু আর অন্যদিকে মন দেওয়া চলবে না। সামনেই পরীক্ষা। আপাতত সেদিকেই শুধু মন দাও। --- আপনি সব সময় আমাকে পড়ো পড়ো করেন কেন বলুন তো? ---- কারণ তুমি নিজের পড়ার চেয়ে অন্যের বিষয় নিয়ে বেশি মাথা ঘামাও বলে। ---- অন্যের বিষয়ে মাথা ঘামানোটা কি খারাপ ? --- আমি কি তাই বলেছি ? আসলে সামনে তোমার পরীক্ষা। মাধ্যমিকের মতো ভালো রেজাল্ট না হলে আমি ডি,এম সাহেবের কাছে আমার মুখ থাকবে না। ---- ঠিক আছে মশাই আপনার মুখ যাতে থাকে সে চেষ্টা আমি করব। তাহলে হবে তো ? বাবা , একেবারে হেডমাস্টার যেন। --- ভালো রেজাল্ট হলে আমার আর কিছু বলার নেই। আমি তোমার ভালো চায়। --- বুঝি বাবা বুঝি। তোমার জন্যই ----।

তারপরেই জিভ কেটে থেমে যায় অঞ্জলি। লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে তার মুখ চোখ। কোনরকমে সামলে নিয়ে বলে , এই দেখুন টানে ভুল করে তুমি বলে ফেলেছি। --- তুমিটাই থাক না। বেশ মিষ্টি শোনাচ্ছে কিন্তু। ---- খেপেছেন ? তাহলে আমি লজ্জায় মরে যাব। হোমের মেয়েগুলো আমাকে ছেড়ে কথা বলবে ভেবেছেন। আমার পিছনে লেগে লেগে অস্থির করে তুলবে। তখন আমার পড়াশোনা লাটে উঠবে।ভালো হবে তো ? --- না , না তাহলে থাক বরং। কিন্তু একদিন তো তোমাকে তুমিতে নামতেই হবে , তখন কি হবে ? ---- সে সেদিন যা হওয়ার হবে , আজ থেকে সে কথা ভেবে লাভ নেই। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। হোমের ঘরে ঘরে জ্বলে ওঠে আলো। তাকে পড়তে বসার তাড়া দিয়ে বিদায় নেন আলাপনবাবু। নিজের ঘরে ফেরে অঞ্জলি। ততক্ষণে সঞ্চিতা আর মালতি বই নিয়ে বসে গ্যাছে। সঞ্চিতা আর প্রতিমার সঙ্গে এবারে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবে মালতিও। তার কাছে পড়াশোনা দেখিয়ে নেওয়ার জন্য সাবিত্রীদির জায়গায় উঠে এসেছে সে। তারা মন দিয়ে পড়া শুরু করে দেয়।সেদিন রাতে আর পড়াতে মন বসাতে পারে না অঞ্জলি। আলাপনবাবুকে ঘিরে রঙিন স্বপ্নের জাল বুনে চলে তার মন। আলাপনবাবু তার পাশে থাকলে সে তার জীবনে বিভীষিকাময় দিনগুলো ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবে। কিন্তু আলাপনবাবু কি ততদিন পর্যন্ত তার পাশে থাকবেন ? এমন নয়তো ডি,এমের কাছে নিজের মুখ রক্ষার জন্য তাকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর পর নিজেকে সরিয়ে নেবেন ? তাছাড়া কোন অংশেই তো সে আলাপনবাবুর যোগ্য নয়। তাই পড়াশোনা করে আগে আলাপনবাবুর যোগ্য হয়ে উঠতে হবে তাকে। তারপর আলাপনবাবু যদি মুখ ফিরিয়ে নেন তো নেবেন। সেক্ষেত্রে কি'ই বা করার আছে তার ? আলপনবাবু তো তার ছিল না , তাই তাকে ধরে রাখার কি অধিকারই বা আছে তার ? আদৌ কি কোন অধিকার থাকে ? স্বীকার করলে থাকে , না করলে নেই। কিন্তু আলাপনবাবু মুখ ফিরিয়ে নিলে তার খুব কষ্ট হবে। সেই কষ্ট সহ্য করবে কেমন করে সে ?

সে তো একটা ঘা খাওয়া মেয়ে। একই ক্ষতে বার বার আঘাত যে বড়ো যন্ত্রনার হবে তা ভালোই উপলব্ধি করে সে। তাছাড়া প্রথম আঘাতের পর সে এই হোমকে পেয়েছিল, হোমের এই মানুষগুলোকে পেয়েছিল। সর্বোপরি পেয়েছিল আলাপনবাবুকে।আর আলাপনবাবুর সাহায্যে সে হোমে গড়ে তুলেছিল নিজেকে ভুলিয়ে রাখার পরিবেশ।কিন্তু সব ছেড়ে তাকে একাকী ফিরে যেতে হলে যে তার আবার দম বন্ধ হয়ে আসবে। ওইসব কথা ভাবতে ভাবতেই দু'চোখের পাতা এক করতে পারে না অঞ্জলি। এক সময় রাত গভীর হয়।চেয়ে দেখে দু'দিকের বেডে ঘুমিয়ে কাদা সঞ্চিতা আর মালতি। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে সে। মুখে চোখে জল দিয়ে পুরোদ্যমে পড়া শুরু করে দেয় সে। নিজেকে আলাপনবাবুর যোগ্য করে তুলতেই হবে তাকে। শুরু হয় অঞ্জলির নিজেকে যোগ্য করে তোলার কঠিন লড়াই। দেখতে দেখতে চলে আসে পরীক্ষা। আগে পরে পরীক্ষা হয় সঞ্চিতা আর তার।আলাপনবাবুই সঞ্চিতাদের গাড়িতে করে পরীক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে যান। সে একা বলে তাকে মোটরবাইকেই নিয়ে যান তিনি। পরীক্ষার দিনগুলিতে পাছে সে অমনোযোগী হয়ে পড়ে সেই জন্য অন্য কোন আলোচনা করতে চাইতেন না আলাপনবাবু। সে'ই বরং টুক-টাক কথা বলেছে।আলাপনবাবু হু-হা দায়সারা গোছের উত্তর দিয়েছেন। অভিমান হলেও বুঝতে অসুবিধা হয়নি তার ভালোর জন্যই আলাপনবাবু ওই ধরণের আচরণ করছেন। এমন কি প্রতিদিন পরীক্ষা শেষে প্রশ্নপত্রের সঙ্গে তার উত্তর মিলিয়ে দেখেও সে চাপে পড়ে যেতে পারে ভেবে কোন মন্তব্যও করেন নি। শেষের দিন অবশ্য মাধ্যমিক পরীক্ষার মতো খাবার দোকানে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন , এ যাত্রাও তুমি আমার মুখ রাখবে বলেই মনে হচ্ছে। শুনে হাফ ছেড়ে বাঁচে সে।পরীক্ষার মতোই আগে পড়ে রেজাল্টও বের হয় তাদের। সঞ্চিতা প্রথম বিভাগ আর বাকি দুজন দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করে। কয়েকটা নম্বর কমের জন্য সে প্রথম বিভাগ পায় নি।তার মনটা কিছুটা খারাপ হয়ে যায়। মন খারাপ হয়ে যায় আলাপনবাবুরও। কিন্তু তিনি তাকে সেটা বুঝতে দিতে চান না। বরং তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, উচ্চ মাধ্যমিকে দ্বিতীয় বিভাগ পাওয়াটা কম ব্যাপার নয়। তাই এ নিয়ে মন খারাপ না করে পরের সিঁড়িটা আর ভালো ভাবে টপকানোর জন্য কাল থেকেই ঝাঁপিয়ে নেমে পড়ে। আলাপনবাবু কথা শুনে তার দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অঞ্জলি। আলাপনবাবুও চেয়ে থাকেন তার দিকে। দুজনের চোখে তখন আবেশের ঘোর।

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register