Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব - ৪৩)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব - ৪৩)

পুপুর ডায়েরী 

হাল খাতা, নববর্ষ, এইসব আসে। বাংলা বছরের হিসেব আসে মনে। আর তখনই মনে পড়ে ভালবাসাকে। কলকাতা। আমার প্রাণের কলকাতা। ধুলো মাখা মেঘলা কলকাতা। হেমন্তের বিষন্ন কলকাতা। টিপটিপ বর্ষার মন কেমন কলকাতা। হাঁটু অবধি জলে ডোবা মন খারাপ কলকাতা। তবু ভালো, ভীষণ ভালো কলকাতা। কিন্তু ইদানীং, বড্ড অচেনা হয়ে যাচ্ছে চেনা কলকাতা। হয়ত আমি বুড়ো হচ্ছি বলেই। চারু মার্কেট নামক বাজার আর বাস স্টপটি যে আমার নিজের পরিচয়, বড়ো হওয়া, ঠিকানা, এ সব কিছুর সঙ্গে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িত, তার যে এই দুহাজার চব্বিশ সালে আর কোনো চিহ্নই রইল না। তার সাথে, আমার কতো গল্প। কতো মানুষের মুখের মিছিল, গলা, কতো আদর। নেতাজী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। পুরোনো মিষ্টির দোকান ছিল চারু মার্কেটের গোড়া থেকে। বাজারের প্রধান ছাদের ঘেরাটোপের একটু বাইরের দিকে ঘড়িঘরের দিকে পিঠ ফেরানো দোকান। ট্রাম লাইন সরানো হতেই ভাঙা পড়েছিল দোকানটা। কিন্তু আমার ইস্কুল চলা পর্যন্ত, বাজার সেরে বেরোবার আগে ওই দোকান থেকেই মিষ্টি কিনে বেরিয়ে আসতেন বাবা মশাই। দোকানে কী যে ভিড় থাকত! অনেক কর্মচারীদের মধ্যে, খুব রোগা পাকানো একটি মানুষ ছিলেন। ফর্সাই ছিলো গায়ের রঙ, যদিও চামড়ারা কুঁচকে গেছিলো শাড়ির ভাঁজের মতো। সাদা হাতা ওয়ালা গেঞ্জি, আর সাদা ধুতি ছাড়া অন্য কোন পোশাকে কখনো দেখিনি। আমাদের ছোটো বেলায় বেশিরভাগ মানুষ ধুতিই পড়তেন। বিশেষত সাধারণ বিত্তের মানুষ। তো, সেই গেঞ্জি গায়ে, মালকোঁচা দিয়ে ধুতি পড়া মানুষটি কী দ্রুত গতিতে চলাফেরা করতেন, যারা না দেখেছে কল্পনাই করতে পারবেনা কিছুতে। পুপুর মাথাটা মিষ্টির কাঁচের থরে থরে সাজানো তাকের থেকে ঢের নীচে থাকত। চিত হয়ে দেখতে হত কাঁচের ওপারের মানুষদের। বাবার মাথা শোকেসের অনেক ওপরে। সেই, এটা দিন ওটা দিন কথাবার্তা মাথার ওপর দিয়ে ভাসতে থাকে। তার মধ্যেই, সেই দাঁত একটু উঁচু শীর্ণ মুখের মানুষটি এক গাল হেসে উঁকি মারেন নীচু হয়ে। —- খুকি! তুমি এসেছ মা? এই নাও, এই নাও। একটা ছোট্ট কাগজের ঠোঙা শোকেস টপকে নেমে আসতো পুপুর হাতে। প্রথম বার, সে হাত বাড়ায়নি। ভুরু কুঁচকে বাবার দিকে তাকিয়েছিলো। বাবা হেসে উঠতে, গরিব রোগা মানুষটি হাত জোড় করে বলেছিলেন, এর দাম দেবেন না বাবু। মা জননীকে এটুকু আমি দিতে পারি তো। বাবা নির্মল হাসি হেসে বলেছিলেন, আচ্ছা, নাও মা গো। সেই থেকে, এই ট্র‍্যাডিশন চলেছে। বাবা একটু বেশি করে প্রতি রবিবারই মিষ্টি নিয়েছেন এ দোকান থেকে। সেই ছোট্ট ঠোঙা থেকে বাড়িতে এসে বেরোতো আশ্চর্য সব আনন্দ। ছোট্ট গুজিয়া। শাঁখ সন্দেশ। আতা সন্দেশ। কমলা কিটকিটে চিনির, কিন্তু সবচেয়ে প্রিয়, দানাদার। রসকদম। অন্য অন্য রকম ছোট্ট অবাক-খুশি। সময় যেতে যেতে, পুপু কাঁচের শোকেসের উচ্চতা ছাপিয়ে উঁচু হয়ে গেছে। একা একা দোকানে ও যেতে শুরু করেছে। এ ঠোঙা নিতে আপত্তি গজিয়েছে মনে। চট করে শিঙারা ইত্যাদি নিয়ে পালিয়ে আসার চেষ্টা থাকে। তারপর সে দোকান ও নেই হয়ে গেছে। সে বাজারটাও রইল না। মনের মধ্যে সঞ্চিত হয়ে রয়েই গেলো, একেবারেই অপরিচিত মানুষের অজস্র স্নেহের এক মধুর স্মৃতি। খুব মিষ্টি গলার সুর। –---এসো মা, এসো এসো, কেমন আছো? এই নাও।.. ছোটো বেলাতেই পুপু বুঝেছিল, গরীব মানুষের আর্থিক দারিদ্র্য, কোনো ভাবেই তার স্নেহশীলতার অভাব ঘটায়না। অবশ্য, আজকের বানিজ্যিক যুগে, কোনো কর্মচারী, এমন আদর কোনো শিশুকে দেখাতে পারেন কিনা, সেও প্রশ্ন জাগে।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register