Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

ক্যাফে ধারাবাহিকে বিতস্তা ঘোষাল (পর্ব - ৩০)

maro news
ক্যাফে ধারাবাহিকে বিতস্তা ঘোষাল (পর্ব - ৩০)

কু ঝিক ঝিক দিন

৩০.

সেই দিনটা ছিল আমার জন্মদিন।সে দিন রাতে বাবা একটা টেপরেকর্ডার আনলেন।লম্বা বিশাল কালো রঙের।আর তার সঙ্গে কটি রবীন্দ্র সংগীতের ক্যাসেট।আর একটা ক্যামেরা।দুটোই বাবাকে কেউ দিয়েছিলেন। সেগুলো বাবা আমাকে দিলেন জন্মদিনের উপহার হিসেবে। আমাদের বাড়িতে জন্মদিন করার কোনো চল ছিল না।বড়জোর মা একটু পায়েস কিংবা মাংস রাঁধত।তখনো জন্মদিন হ্যাপি বার্থডে আর কেক কাটার উৎসব হয়নি।অন্তত আমাদের বাড়িতে নয়।অবশ্য বাবার বন্ধুদের বাড়িতে কেক কাটা হত।যদিও হাতে গোনা দু একজনের বাড়ি ছাড়া আমরা কোথাও যেতাম না। এই বাড়িটা হওয়ার পর সবচেয়ে অবাক করা যে দুটো জিনিস এসেছিল তার একটি সাদা কালো ছোটো টিভি।যেটার শার্টার খোলা বন্ধ করা হত,আর একটা ফ্রিজ। ও পাড়ায় থাকতে টিভি দেখতে যেতাম অমর জ্যেঠুর বাড়ি।সেও খুব কম । আর আমাদের ওই বাড়ির চারজনের পরিবারের একজনের ঘরেও টিভি বা ফ্রিজ কিছুই ছিল না।হয়তো সেগুলো তখন অত্যাবশ্যক জিনিস বলে গণ্য হোতো না। তাছাড়া মা দুবেলাই রান্না করত,বাসি খাবার রাখার বা খাওয়ার চল ছিল না। নিজেদের একটা বাড়ি,তারপর আবার টিভি, ফ্রিজ একসঙ্গে! সব কেমন অবাক করা ঘটনা মনে হচ্ছিল। অথচ সবচেয়ে দামি যেটা সেই গাড়ি মানে এ্যাম্বাসাডার আমাদের একেবারেই ছোটো থেকে।সাদা অ্যাম্বাসেডর পুরোনো ও নতুন পাড়াতে আমাদেরই ছিল অনেকদিন পর্যন্ত। রাজুর বাবার সম্ভবত কালো ফিটন আর মৈত্র দাদুদের যে গোল বাড়িটায় খেলতাম তাদের গ্যারেজেও একটা ফিটন গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতো। অবশ্য সেই সময় গাড়ি বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় ছিল না। আমাদের এই নতুন বাড়িতে কোনো আসবাবপত্র ছিল না।পুরোনো বাড়িতে বড় ঘরে দুটো খাট জোরা লাগিয়ে শোওয়া হত।(এই খাটটা আমি জন্মানোর পর হাসপাতাল থেকে আমাকে নিয়ে আসার আগের মুহূর্তে আনা হয়েছিল।) বাবার ছোটো ঘরে ছোট্ট চৌকি,ঠাকুরঘরে একটা চৌকি আর অনেকগুলো ক্যাম্প খাট রাখা ছিল।যখনি কেউ আসত আমার দায়িত্ব ছিল সেই ক্যাম্প খাট খুলে বিছানা করার।আর ছিল ইজি চেয়ার। এই নতুন বাড়িতে এতগুলো ঘর।অথচ ফাঁকা। একদিন খুব ভোরে শুনলাম লরি করে আসবাব পত্র এসেছে বহরমপুর থেকে।আসবাব পত্র তাও আবার লরিতে!কি এসেছে দেখার জন্য ছুট্টে রাস্তায়। দেখি কাঠের নানা সাইজের সামগ্রী নামানো হচ্ছে।পরিপূর্ণ ভাবে বুঝতে পারলাম না সেগুলো কি! ক্রমশ দেখলাম সেগুলো এক এক করে জোরা লেগে তিনটে ঘরের খাট,দুটো ড্রেসিংটেবিল,আলমারি, ডাইনিং টেনিল,চেয়ার,পেলমেট, সোফা হল।এর মধ্যে সবচেয়ে আনন্দ হল পেলমেট দেখে।এর আগে বাবার বন্ধুদের বাড়িতে দেখেছি দরজা জানলার মাথার ওপর লাগানো কাঠের পেলমেট থেকে লম্বা ভারী পর্দা নেমে এসেছে মাটি অবধি।কেমন রহস্যময় লাগত ঘরগুলো নিয়নের আলোয়। আর পেলমেটের মাথায় রাখা নানা শোপিস। এবার আমাদের বাড়িতেও তাহলে লম্বা পর্দা হবে। ঝুম খুব সাজতে ভালোবাসত।মায়ের একটি মাত্র লাল লিপস্টিক সে যখনি পারত ঠোঁটে লাগিয়ে নিত। আমি আবার একদম লিপস্টিক লাগাতাম না।ড্রেসিং টেবিল আসায় বোনের সাজার সুবিধা হল।আর আমার নাচের।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নানা ভঙ্গিতে নাচ,মুখের অভিব্যক্তি, সব প্রাকটিস করতে শুরু করলাম। এখানে একটা বিশাল ঘর।সে ঘরের খাটটাও হল লম্বা ও চওড়ায় ঘর জোরা।বাবার ধারণা ছিল আমরা চিরকাল তিনবোন একসঙ্গে মায়ের পাশে সেই বিছানায় শোবো।তাই এমন ব্যবস্থা। কিন্তু পাশের ঘরেও খাট হয়ে যাওয়ায় অচিরেই আমি একা পাশের ঘরে থাকতে শুরু করলাম।প্রথম দিকে মনে হতো মায়ের খাটে চলে যাই।ক্রমশ একা শোওয়ার আনন্দ উপভোগ করতে লাগলাম। একা থাকতে থাকতে কতদিন সারারাত জানলায় বসে আকাশ দেখেছি,তারারা কেমন করে মিটমিট করে জ্বলছে,পেঁচার চোখ কিভাবে ঘুরে চলেছে,পুকুরে চাঁদের আলো কিভাবে মায়া জাল বিছিয়ে দিচ্ছে....। আর দেখতাম উল্টো দিকের মাটির বাড়ির বাসিন্দা আমার বয়সী দিলীপ নামের ছেলেটিকে।ভীষণ ফর্সা,সৌম দর্শন। আমি একটু কালোর দিকে,তাই দেখতাম। ক্রময় রাত বাড়তো। কদম গাছের ফাঁক দিয়ে অসংখ্য জোনাকির আলোয় ভরে যেত পিছনের জঙ্গল। আমি মনে মনে সেই জঙ্গলে হারিয়ে যেতাম।ভাবতাম টারজান আসবে।আমাকে শোঁ করে তুলে নেবে কোলে।তারপর ওই গাছের মধ্যে একটায় বাসা বাঁধব।তাকে শেখাবো মানুষের ভাষা। আর তার থেকে শিখব পাখির ভাষা,জীবজন্তুর ভাষা। কিন্তু হায়!টারজান এলো না।কত মায়াবী রাত এভাবেই কেটে গেল একা একা... তারপর ঝুম এলো আমার পাশে শুতে।অধিকাংশ রাত কেটে গেল গল্পে আর গানে। সঙ্গী হল কালো বিশাল টেপ রেকর্ডার টা।জমা হল শয়ে শয়ে ক্যাসেট।রবীন্দ্র, নজরুল,সিনেমা,আধুনিক,লোকসংগীত,গনসংগীত,ভক্তিগীতি, ভাগবত পাঠ,বেদ পাঠ সবই শুনতে শুরু করলাম। সেই সময় ওড়িশার তিন মেয়ে একসঙ্গে বেদ পাঠ করে ক্যাসেট করেছিল।সেই বেদের মন্ত্র উচ্চারণে মন্দ্রিত হল আমাদের বাড়ি। আমি নেশার মতো রোজ শুনতাম সেই পাঠ।ইতিহাসে পড়েছিলাম প্রাচীন পৃথিবীতে মেয়েরাও বেদ পাঠ করতেন।তারপর ধীরে ধীরে সে পাঠে নিষেধাজ্ঞা জারি করল ব্রাক্ষণ সমাজ।একে একে শিক্ষার দ্বার বন্ধ করে মেয়েদের এক অন্ধকার জগতে ঠেলে দিল। মাতৃকেন্দ্রীক সভ্যতা পুরুষের অধিকারে চলে গেল। আমি সেই অন্ধকার রাতগুলোতে সেই তিনমেয়ের বেদ পাঠের মধ্যে দিয়ে নারী জাতির আবার স্বমহিমায় বিরাজের মন্ত্র উচ্চারণে স্পন্দিত হলাম।

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register