Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব - ৫৩)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব - ৫৩)

সালিশির রায়

কিস্তি - ৫৩

সব থেকে উৎফুল্ল দেখায় শ্রাবণীকে। বিষয়টি নজর এড়ায় নি অঞ্জলিরও। এতদিন পরীক্ষার পড়া নিয়ে ব্যস্ততার কারণে তার অতটা খেয়াল হয় নি, কিন্তু এখন শ্রাবণীর আচরণটা তার কেমন অন্যরকম লাগে। যে শ্রাবণীর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১২ ঘণ্টা তার সঙ্গে গল্প না করলে ভাত হজম হত না সেই শ্রাবণীই এখন তাকে এড়িয়ে চলে। জোর করে কথা বলতে চাইলে 'হ্যা - হু' গোছের কথা বলে পাশ কাটিয়ে যায়। সব সময় যেন একটা ভাবের ঘোরে থাকে। ভাব গতিক খুব একটা সুবিধার লাগে না অঞ্জলির। কিন্তু কিছু আন্দাজও করতে পারে না সে। তাই খুব দুশ্চিন্তা হয় তার।গোপনে শ্রাবণীর উপর নজর রাখতে শুরু করে। কয়েকদিনের মধ্যেই কিছুটা আভাস পায় অঞ্জলি। সে লক্ষ্য করে দেখেছে শ্রাবণী সারাদিন একটা মনমরা ভাবের মধ্যে থাকলেও সকাল হলেই চনমনে হয়ে ওঠে। স্নান-টান করে একেবারে ফিটফাট।অঞ্জলি প্রথমে ভেবেছিল বাইরের ছেলেটা মাল নিতে আসবে বলেই হয়তো পেশাদারি কারণে নিজেকে ওই রকম ফিটফাট রাখে শ্রাবণী। কিন্তু কয়েকদিন লক্ষ্য করেই বুঝে যায় , শ্রাবণীর চোখের ভাষা তো সে কথা বলছে না। ছেলেটিকে দেখলেই মেয়েটার চোখে যেন অন্যরকম আলো জ্বলে ওঠে। ছেলেটাও চোখ সরাতে ভুলে যায়।
এমন কি মালপত্র নিয়ে ফিরে যাওয়ার সময়ও স্থান, কাল, পাত্র ভুলে দুজনে দুজনের দিকে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থাকে। গতিক যে খুব সুবিধার নয় তা বুঝতে আর বাকি থাকে না অঞ্জলির। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করতে গেলে দুজনেই বেমালুম অস্বীকার করে দেবে। তাই সুযোগের অপেক্ষায় তক্কে তক্কে থাকে সে।

                                                  কয়েকদিনের মধ্যে মিলেও যায় সেই সুযোগ। দুদিন ধরে ছেলেটি আসেনি , তাই খুব উতলা দেখাচ্ছিল শ্রাবণীকে। সেদিন সকাল থেকেই অলক্ষ্যে শ্রাবণীর গতিবিধির উপর নজর রাখছিল অঞ্জলি। হঠাৎ দেখে সাবিত্রীদির ঘর থেকে বেড়িয়ে চুপিসারে স্নানঘরের দিকে চলে যায় শ্রাবণী। তারপর খুব আস্তে আস্তে দরজা বন্ধ করে ভিতরে ঢুকে যায়। শ্রাবণীর আচরণে কেমন যেন খটকা লাগে তার। সে কাছে গিয়ে  শুনতে পায় শ্রাবণী যেন কার  সঙ্গে কথা কথা বলছে।  এতক্ষণে শ্রাবণীর ওইরকম আচরণের একটা ব্যাখ্যা খুঁজে পায় অঞ্জলি। তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে সাবিত্রীদির কাছে গিয়ে বলে -- তোমার ফোনটা একবার দেবে ?

তার কথা শুনে সাবিত্রীদি অবাক হয়ে বলে , সে কিরে ? এই তো শ্রাবণী তোর নাম করে ফোনটা নিয়ে গেল। তোর নাম করে তো এখন প্রায়ই ও ফোন নিয়ে যায়। তোর নাকি সাংবাদিকদের সঙ্গে কিছু কথা বলার আছে। তুই চাইলে আমি কি ফোন না দিয়ে পারি ? তোর ফোনের জন্যই তো আজ আমরা মানুষের মতো বাঁচার স্বাদ পেয়েছি।
যা বোঝার নিজে তা বুঝে গেলেও সাবিত্রীদিকে তা আঁচ করতে দেয় না অঞ্জলি। তাই বলে , তাহলে হয়তো আমার কাছেই নিয়ে গিয়েছে। যাই দেখি। বলে সোজা স্নানঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। টুকরো - টুকরো কথা কানে আসছিল তার। রীতিমতো অস্বস্তিও হচ্ছিল। এভাবে গোপনে কারও কথা শোনাটা যে উচিত নয় তা ভালোই জানে অঞ্জলি। কিন্তু এছাড়া হতভাগিনী মেয়েটাকে যে বাঁচানোরও কোন উপায় জানা নেই তার। তাই লজ্জার মাথা খেয়ে দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে সে। বেশ কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে বেরোতেই সে শ্রাবণীর হাত ধরে বলে, দে ফোনটা আমার হাতে দে।
তাকে ওই অবস্থায় দেখে হকচকিয়ে যায় শ্রাবণী। পাশ কাটিয়ে পালানোর চেষ্টা করে।তখন কঠিন স্বরে অঞ্জলি বলে - কি কথাটা কানে যায় নি ? ফোনটা দে বলছি ? এতক্ষণ ধরে কাকে ফোন করছিলি বল ?
--- কেন , তুমি তোমার দরকারে সাংবাদিকদের ফোন করতে পারো , আমি আমার দরকারে সন্দীপকে ফোন করতে পারি না ? ব্যবসার কত দরকার থাকে জানো ?
---- এই দেখ , এটাই হোল ঠাকুর ঘরে কে, আমি কলা খাইনি'র মতো কথা। আমি কিন্তু একবারও সন্দীপের কথা তুলি নি। নামটা তুইই টেনে আনলি। কথা বলতে তুই নিশ্চয় পারিস। কিন্তু ব্যবসার প্রয়োজনে কেউ স্নানঘরের দরজা লাগিয়ে ফোন করে না। আর মিথ্যা করে আমার নাম করেও ফোন আনার প্রয়োজন হয় না। কি রে ঠিক বলছি তো ? শোন আমার কাছে আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করিস না।

                এবারে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না শ্রাবণী।  অঞ্জলির পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলে , দিদি আমি মরেছি গো। আমি যে ওকে ভালোবেসে ফেলেছি।

--- সে আন্দাজ আমি আগেই করেছিলাম। তবে তুমি এখনও মরো নি, মরণ পাখা গলায় বেঁধেছো। এ ভালোবাসার কি দাম আছে ? হোমের মেয়েদের সবাই সস্তা আর ভোগের সামগ্রী ভাবে।
--- না দিদি , ও সে রকম ছেলে নয়। ও আমাকে বিয়ে করব বলেছে।
---- ওই রকম কথা প্রথম দিকে সবাই বলে। তারপর এঁটো পাতার মতো আস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলে দেয় ।
--- না , দিদি ও সত্যিই ভালো।
---- সত্যি ভালো তুই এর মধ্যে বুঝে গেলি ? তোর সব কিছু ও জানে, তুই ওর সব কিছু জানিস ?
--- আমি ওকে আমার জীবনের সব কিছু খুলে বলেছি। ও বলেছে , বাড়িতে বৃদ্ধা মা ছাড়া ওর আর কেউ নেই। মাকে ও আমার কথা বলেছে। বিশ্বাস না হয় , তুমি নিজে কথা বলে দেখ।
---- ঠিক আছে , আমি কথা বলব আগে। তুমি কাল সকালে ঘর থেকে বেরোবি না।
---- ঠিক আছে দিদি, তুমি যা বলবে তাই হবে।
---- হ্যা , কত একেবারে দিদির বাধ্য! দিদিকে বলেই যেন গলায় মরণ ফাঁস পড়েছে। বেশ অতই যদি দিদিকে ভক্তি, নে বলছি ওই সম্পর্ক থেকে সরে আয় তো দেখি ?
---- দিদি ওই কথাটি বলো না তাহলে মরে যাব। তাছাড়া তুমি আর যা বলবে সব করব। মরতে বললেও মরব।
---- তুই ভালো তো , এই বলছিস ওকে ছাড়তে বললে মরে যাবি , তখন দিব্যি মরার ভয় পাচ্ছিস। আবার বলছিস আমি মরতে বললে মরে যাবি। শোন , তোমাকে আপাতত কিছুই করতে হবে না। তুমি সাবিত্রদির ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে এসো। আর সাবিত্রীদিও কিছু বলার দরকার নেই। বলবে আমিই নিয়েছিলাম ফোনটা।
---- ও, দিদি-- দিদি আমার মিস্টি দিদি, বলে আনন্দে তার হাত দুটো ধরে পাক কতক ঘুরে নেয় শ্রাবণী।
--- ছাড়, ছাড়। ঘুরে পড়ে যাব যে এবার। বলে কোন রকমে শ্রাবণীর হাত থেকে রক্ষা পায় সে।

                       অঞ্জলি ভাবে , শুধু শ্রাবণীই নয় , সব মেয়েই একটু ভালোবাসার কাঙাল। একটু ভালোবাসা পেলেই আগে পিছে কিছু না ভেবে শিশুর মতো হয়ে ওঠে। জীবনে এত ধাক্কা খায় , তবু ভালোবাসা পেলে সব ভুলে যায়। সেও তো ওই বৃত্তের বাইরে নয়।সকালে ছেলেটি আসতেই একটু একা পেয়ে চোটে পাটে ধরে অঞ্জলি। প্রথমে একটু ভড়কে যায় সন্দীপ। অঞ্জলি তখন আরও কড়া সুরে বলে --- শ্রাবণীর আর তোমার কি ব্যাপার বলো তো ? তুমি ওর সব কিছু জানো ?

---- দিদি, আপনার কাছে কিছু লুকাবো না , আমি ওকে ভালোবাসি। ও আমাকে ওর জীবনের ঘটনা সব বলেছে।
ওই ঘটনাতে ওর তো কোন দোষ নেই। তাছাড়া ওর অতীত নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথাও নেই।
অঞ্জলি লক্ষ্য করে সন্দীপ খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে। বাইরে থেকে ছেলেটিকে দেখে ভালোই মনে হয় তার। তবু আর একটু বাজিয়ে নেওয়ার জন্য বলে , আমাদের সমাজে কিন্তু অতীতটাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয় বেশি। ভালোবাসার মোহ কেটে গেলে তখন পান থেকে চুন খসলেই অতীতটাকেই টেনে এনে মেয়েটাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে তোলা হয়।
--- সেটা অবশ্য আপনি ঠিকই বলেছেন। সে যারা করার করে , আমি আমার কথাটুকুই আপনাকে বলেছি।
---- ঠিক আছে , তুমি বাড়ির লোকদের সব বলেছ ? সব জেনেও তুমি শ্রাবণীকে বিয়ে করে ঘরে তুলতে পারবে তো ?
---- বাড়ির লোক বলতে রয়েছেন আমার। তাকে সব খুলে বলেছি। মা বলেছেন , আমি সুখী হলে তার কোন আপত্তি নেই। এখন আপনারা অনুমতি দিলেই -- --।
--- খুব যেন আমাদের অনুমতির অপেক্ষা করে বসে আছো ? দুজনেই তো মরে বসে আছো। এখন দেখি কি করে তোমাদের বাঁচনো যায়।
--- দিদি , তোমাকে আমাদের বাঁচাতেই হবে।
--- বললামই তো দেখছি। ততদিন তোমাদের বাপু মেলামেশা বন্ধ রাখতে হবে।
--- দোহাই দিদি , যা করার তাড়াতাড়ি কোর ?
--- কেন , তর সইছে বুঝি ? বেশ সে হবে ক্ষণ। তুমি এখন মালপত্র নিয়ে বিদেয় হও তো দেখি। আজ আমিই হিসেবপত্র দেখে নিচ্ছি।
সেদিন আর সামনে আসে না শ্রাবণী। কিন্তু দরজার আড়াল থেকে দুটো চোখ যে চাতকের মতো তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তা নজর এড়ায় না অঞ্জলির। সন্দীপের চোখ দুটোও যেন একবার শ্রাবণীকে খুঁজে বেড়ায়। অঞ্জলি বিষয়টির একটা নিষ্পত্তি করার কথা ভাবতে শুরু করে।

ক্রমশ..

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register