Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

গল্পে পূর্বা ঘোষ

maro news
গল্পে পূর্বা ঘোষ

গোধূলি লগনে

হরিৎ আর শালুক কোথাও বেড়াতে গেলে মৃন্ময়ীদেবীকে সাধারণত ‘ছুটির খুশি' বৃদ্ধাবাসে সেই কদিনের জন্য রেখে যায়। মৃন্ময়ীদেবীর বয়স এই পঞ্চান্ন ষাটের আশে পাশে। শক্তপোক্ত গড়ন। রোগব্যাধির বালাই এখনও পর্যন্ত তার শরীর ছুঁতে পারেনি। শান্ত নির্বিরোধী মানুষ।স্বর্গগত স্বামী ওনার জন্য পেনশন আর কলকাতার পশ এলাকায় এই বাড়ীটা রেখে গেছেন, আর রেখে গেছেন একমাত্র সন্তান হরিৎকে। শালুক হরিতের স্ত্রী। দুজনে এক‌ই অফিসে কাজ করে। ওই অফিস থেকেই মন দেওয়া নেওয়া শুরু হয়ে এখন বিবাহিত জীবনে এসে ঠেকেছে। মৃন্ময়ীদেবী নিজের পূজোঅর্চনা, গল্পের বইট‌ই পড়া, ভক্তিগীতি শোনা এইসব নিয়েই থাকেন। ছেলে বৌমার কোন বিষয়েই তিনি নাক গলান না।
কিন্তু তিনি নাক না গলালে কি হবে শালুক কিছুতেই তার বোঁচা নাকটা শাশুড়ির ব্যাপারে না গলিয়ে থাকতে পারে না। এই সংসারে তিনি কতটুকু প্রয়োজনে লাগেন অথবা লাগেন না এবং ভবিষ্যতেও ওনার অবস্হানটা কিরকম হতে পারে এইসব নিয়ে যথেষ্ট চুলচেরা হিসাব-নিকাশ সে যথেষ্ট সময় নিয়ে করে করে একটা সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছে, যেটা এখন ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত করার অপেক্ষা।
যেমন এখন থেকেই মৃন্ময়ীদেবীর মাঝেমধ্যে বৃদ্ধাশ্রমে থাকার অভ্যাসটা একটু একটু করে তৈরী করে দেবার ব্যাপারে শালুক বেশ যত্নশীল। কারন হরিৎ আর শালুক যখন সন্তান নেবে তখন সেই সন্তান জন্ম নেবার এবং তাকে বড় করে স্কুলে যাবার বয়স পর্যন্ত পৌঁছে দেবার ঝামেলাটা তো মৃন্ময়ীদেবীকে দিয়েই করিয়ে নিতে হবে। তারপর ঐসব মিটে গেলে ওনাকে স্হায়ীভাবে বৃদ্ধাবাসে পাঠিয়ে দিলেই হল। সেইসময় হঠাৎ করে একেবারে বৃদ্ধাবাসে থাকতে গেলে ওনার মানিয়ে নিতে অসুবিধা হতে পারে, তারপর সেই নিয়ে আবার নানারকম ঝামেলা পাকবার‌ও সম্ভাবনা। তাই কোন‌ও রিক্স‌ই নেওয়া যাবে না। হরিৎকে ঠিক ধীরেসুস্থে ম্যানেজ করে নিলেই হল।
বৃদ্ধাবাসের খরচ ওনার পেনশনের টাকাতে না কুলালে সে নাহয় কিছু টাকা আর‌ও ধরে দেওয়া যাবে, কিন্তু বুড়ো মানুষের ঐ হাজার ঝক্কিঝামেলা কিছুতেই নেওয়া যাবে না। এই বাড়ীটা কোন একসময় লিখে নিলেই হবে। না লিখলেও কোন ব্যাপার না, হরিৎ মৃন্ময়ী দেবীর একমাত্র সন্তান, ওনার অবর্তমানে হরিৎই হবে বাড়ীর মালিক। আর উনি অন্য কিছু ভাববার মতো অত তুখোর মহিলাও নন।
শালুকের এই দীর্ঘ পরিকল্পনার কথা ও হরিতকে কিছুই জানতে দেয়না।
এই যেমন এখন বেশ বুদ্ধি করে বলে চলেছে যে “আমরা এতদূর এতদিনের জন্য বেড়াতে যাব আর মা যে এই বড় বাড়িতে একলা থাকবেন যদি শরীর অসুস্থ হয়ে পরে তাহলে কি খারাপ ব্যাপার হবে বলোতো? তারপর চোর-ডাকাত আসলে? হয়তো দেখা গেল কিছুই পেলনা সেই রাগে মার ওপর‌ই আক্রমন করে বসল”!
হরিৎ বোঝে প্রতিটা কথাই ভীষন ভাবে বাস্তব এবং যুক্তিযুক্ত!
শালুক হরিতের সাথে এই আলোচনাটা মৃন্ময়ী দেবীর সামনেই করতে থাকে।
মৃন্ময়ী দেবী বলেন “কিচ্ছু হবে না মা, আমি তো এখনও দিব্যি সুস্থ আছি, তোমরা ভালো ভাবে ঘুরে এসো তো দেখি”।
“আপাত দৃষ্টিতে এই বয়সে ওরকম মনে হয় মা যে আমি খুব সুস্থ। কিন্তু হঠাৎ করে কিছু হলে কাকে ডেকে পাবে তুমি! তাছাড়া কারো বাড়ি গিয়ে কতবার থাকবে, আমাদের ধরো মাঝে মধ্যেই বাইরে যেতে হয়। আজকাল তো কাজের লোকদেরকে বিশ্বাস করে বাড়ীতে রেখে যাব তার ও কোন উপায় নেই। খবরের কাগজে টিভিতে যা দেখায় তাতে তো একেবারে শিউরে উঠতে হয়।
অবশেষে শান্তিপ্রিয় নির্বিরোধী মৃন্ময়ী দেবী মনে খুব কষ্ট নিয়ে বৃদ্ধাবাসে থাকতে আসেন। শান্তশিষ্ট অতিথিপরায়ণ মৃন্ময়ীদেবীকে ওনার আত্মীয় স্বজনরা খুবই ভালোবাসে। এইসময় কারোর বাড়ী গিয়ে যদি উনি থাকতে যেতেন কদিনের জন্য তাহলে আগ্রহের আর আনন্দের সাথে তারা ওনাকে গ্রহণ করত। আবার কাউকে যদি নিজের কাছে নিজের বাড়ীতে ডেকে নিয়ে রাখবেন তাতে ছেলে-বৌমার আপত্তি, কিনা সবাই বলবে আমরা তাদের কাছ থেকে সুবিধা নিচ্ছি। অত‌এব কোনটাই হবেনা।
গতদুবারে একবার রাজস্হান আর একবার কেরলে বেড়াতে যাবার সময় মৃন্ময়ী দেবীকে ছেলে-বৌ এই “ছুটির খুশি” বৃদ্ধাবাসেই রেখে গিয়েছিল মোটামুটি পনের কুড়ি দিনের জন্য। ওরা ফিরে আসলে আবার বাড়ী ফিরে গিয়েছিলেন। এই দুবারে তিনি মনে মনে অত্যন্ত অপমানিত বোধ করেছেন। কিন্তু কাউকে কিছু বুঝতে দেননি। স্বামীর তথা নিজের বাড়িতে থাকা বা না থাকাটা অপরের মতের উপর নির্ভর করছে ভাবলেই মনের মধ্যে এক‌ই সাথে অপমান আর যন্ত্রনার অনুভূতি গুলো যেন ওনাকে অস্হির করে তোলে্।

এবারে দূর্গা অষ্টমীতে বৈষ্নুদেবীকে পূজো দিয়ে খুব তৃপ্তি বোধ করল হরিৎ আর শালুক। আসলেই কাশ্মীর বেড়ানোর প্ল্যানটা এভাবেই করা ছিল যাতে ওরা অষ্টমীতে কাটরায় বৈষ্নুমাতাকে পূজো দিতে পারে।
দশমীর ভোরে বাড়ী ফিরে সারাদিন বিশ্রাম নেবার পর একাদশীর দিন হরিৎ মাকে বৃদ্ধাবাস থেকে আনতে গেল। মৃন্ময়ীদেবী বাড়ী আসার জন্য তৈরি হয়ে নেই, অথচ আগেই ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে ওনাকে আনতে যাওয়া হচ্ছে।
“মা তুমি তৈরি হ‌ওনি? সকালেই যে ফোন করে বলে দিলাম বারোটার সময় তোমাকে নিতে আসব”।
“আমি আর বাড়ী ফিরবোনা বাবা, তুমি বাড়ী ফিরে যাও”।
“কি বলছ তুমি মা”?
“হ্যাঁ বাবা, বাকী জীবনটা এই বৃদ্ধাবাসেই কাটিয়ে দেবো ঠিক করেছি”।

হরিৎ চমকে ওঠে, “সেটা হয় নাকি? তাছাড়া আমি চাইনা তুমি এখানে থাকো। তোমার শরীর , তারপর নিরাপত্তার জন্য কদিন এখানে ছিলে ব্যাস, আর তো দরকার নেই”।
“দেখো বাবা, সবসময় তোমাদের ইচ্ছা তোমাদের সুবিধা তোমাদের দরকার মত আমাকে চলতে হবে এমন তো কোন কথা নেই। আমি কক্ষনো এখানে আসতে চাইনি তোমরা নানারকম কথাবার্তা বলে আমাকে রেখে গেছ। প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগত, সবার সামনে বেরতে লজ্জাও করতো, সবাই কি বলবে? মুখে না বললেও মনে মনে ঠিক ভাববে ‘দেখো উপযুক্ত ছেলেবৌমা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়েছে ছি ছি! তবে কিছুদিন থাকতে থাকতে এখন আমার বয়সী সবার সাথে মিশে বেশ ভালই লাগছে, কে কাকে কি বলবে বলো সবার তো এক‌ই হাল”!
“এখন থেকেই যদি এই বৃদ্ধাবাসে থাকতে চাও তাহলে যে অনেক টাকা অগ্রিম জমা দিতে হবে, শুধু তোমার পেনশনের টাকায় হবে না মা। আর আমি তোমার এখানে থাকার ব্যাপারে কোন সাহায্য‌ই কিন্তু করব না”।
“না না বাবা আমার এখানে থাকার জন্য তোমাকে কিচ্ছু করতে হবেনা। আমি আমার ব্যাবস্হা করে নিয়েছি, আমাদের বাড়ীটা আমি এই বৃদ্ধাবাসের নামে লিখে দিয়েছি! আমার মতো আরও কতজন আছে তারা যাতে সামান্য খরচে, কোনক্ষেত্রে হয়তো বিনা খরচেই সেখানে থাকতে পারে সেই শর্তেই এটা আমি করেছি। তাছাড়া এখনও আমি যথেষ্ট সুস্থ সবল আছি, কিছুটা অন্তত পরিশ্রম করার ক্ষমতা এখনও আমার আছে। এই বৃদ্ধাবাসের বডির সাথে আলোচনা সাপেক্ষে কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, আমি অনুসারে আমি কাজ শুরু করতে চলেছি”।
তোমরা দুজনেই খুব বড় চাকরী করো, তোমাদের যথেষ্ট আর্থিক সংগতি আছে যা দিয়ে একটা ফ্ল্যাট অথবা বাড়ী তোমরা অনায়াসেই করে নিতে পারবে।সেই ব্যবস্থাই তারাতারি করে ফেল। ছয়মাসের মধ্যে তোমরা বাড়ী ছেড়ে দেবে সেটা আমি ওদের জানিয়ে দিয়েছি”।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register